হৃদয় নিয়ে যুগে যুগে কত গান, কত কবিতা। হৃদয়কে জানার, বোঝার কত আকুতি। এর সঙ্গেই অবশ্য চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী নিজের হৃদয়ের ঠিকঠাক যত্ন নেওয়াও খুবই জরুরি। ‘বিশ্ব হার্ট দিবস ২০২৩’ সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। এই বছর এই দিবসটির থিম হলো “Use Heart, know Heart” অর্থাৎ 'হৃদয়ের ব্যবহার করুন, হৃদয়ের যত্ন নিন'। কারণ হৃদয়টি কত অমূল্য তা জানলেই তো আমরা তার আরো বেশি যত্ন নিতে পারবো।
প্রতি বছর ২৯ সেপ্টেম্বর পালিত হয় ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’। হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং করোনারি হার্ট ডিজিজ, কার্ডিওভাসকুলার ডিজঅর্ডারের মতো জীবননাশী রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ২০০০ সাল থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এই বছর ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’-এ বিশ্বের প্রত্যেককে তাদের হৃদয়ের যত্ন নেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। তাই এবারের থিমটি প্রথমে নিজের হৃদয়কে অর্থাৎ হৃৎযন্ত্রের সুস্থতার ব্যাপারে জানার উপর জোর দেয়। সারা বিশ্বে হার্টের সুস্থতা সম্পর্কে অধিকতর জানা ও হৃদরোগ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিই এই দিবসটির লক্ষ্য। মানুষ যত বেশি এ সম্পর্কে জানবে তত বেশি হার্টের যত্ন নিতে পারবে এবং এ সম্পর্কিত শারীরিক সমস্যা মোকাবেলায় সফল হতে পারবে, এমনটাই মত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের।
হৃদরোগে মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি
হৃৎপিণ্ড মানবদেহের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গগুলির মধ্যে একটি যার অকার্যকারিতায় মৃত্যু অনিবার্য। কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্য এবং নির্দিষ্ট জীবনযাত্রার অভ্যাস সম্পর্কে সচেতনতার অভাব বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। প্রতি বছর, প্রায় ১.৭ কোটি মানুষ হৃদরোগে মারা যান, যা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রায় ৩১ শতাংশ। হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং অন্যান্য হৃদরোগ ও হৃৎপিন্ডের অসুস্থতাজনিত কারণ পৃথিবী জুড়ে বহু মানুষের মৃত্যুর অন্যতম সাধারণ কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে যার দুই-তৃতীয়াংশের বসবাস বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়। উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করা না হলে বুকে ব্যথা, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইল এবং হার্ট বিট অনিয়মিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর Monitoring the situation of Bangladesh জরিপের অন্তর্ভুক্ত Determination of Causes of Deaths by Verbal Autopsy (VA) নামক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ হৃদরোগ। এই জরিপের ফলাফলে মৃত্যুর ১৫টি কারণ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মৃত্যুর ঘটনা সংঘটিত হয়েছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে এবং হৃদযন্ত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগের কারণে। ২০২১ সালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে প্রতি এক হাজার জনসংখ্যায় মৃত্যু হয়েছে ২২ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষের। এছাড়াও হৃদযন্ত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে মৃত্যু হয়েছে ৫ দশমিক ১ শতাংশ মানুষের। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মোট মৃত্যুর ২৩ শতাংশ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে সংঘটিত হয়। হৃদরোগে শুধু বয়স্করাই নয় মারা যাচ্ছে শিশুরাও। অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর ঘটনার ৫ দশমিক ৮ শতাংশ ঘটে হৃদরোগের কারণে। এমনকি ১ বছরের কম বয়সী শিশুরাও হৃদরোগে আক্রন্ত হয়ে মারা যাচ্ছে।
হৃদরোগের কারণ ও লক্ষণ
বাংলাদেশের জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. সাজিদ হোসেন খান হৃদরোগের কারণ সম্পর্কে ভয়েস অফ আমেরিকা-কে বলেন,
হৃদরোগের ঝুঁকির কারণসমূহ দুই ভাগে ভাগ করা যায়। কিছু কারণ অপরিবর্তনীয়। যেমন: মানুষের বয়স,বংশ, লিঙ্গ ও ভৌগোলিক অবস্থান। আর কিছু কারণ বা ঝুঁকি রয়েছে যা পরিবর্তন বা নিয়ন্ত্রণ করে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। যেমন:
- ধূমপান, তামাক, জর্দা গ্রহণ ও মদ্যপান
- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাই কোলেস্টেরল
- অতিরিক্ত ওজন
- অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ
- ফাস্ট ফুড, জাংক ফুড অতিরিক্ত মাত্রায় খাওয়া
- দুশ্চিন্তা, মানসিক অশান্তি, স্ট্রেসফুল জীবন যাপন করা।
এ ধরণের অভ্যাসগুলো পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস ও হৃৎপিন্ড সুস্থ রাখা সম্ভব। ডা. সাজিদ হোসেন খানের মতে একজন রোগীর হৃদরোগ হয়েছে কিনা সেটা বোঝার প্রাথমিক লক্ষণগুলো হলো:
- বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করা
- শ্বাসকষ্ট এবং বুক ধড়ফড় করা
- বুকের মাঝ বরাবর ব্যথা ও চাপ অনুভব করা
- ব্যথা গলা ও চোয়ালের দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে মনে হবে
- প্রচন্ড ঘাম হতে পারে
- রোগী ফ্যাকাসে হয়ে যেতে পারে
- রোগীর পালস কমে যেতে পারে আবার হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে।
- বমি হওয়া
- শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া
- হঠাৎ করে রক্তচাপ অনেক কমে যাওয়া
হৃদযন্ত্রের সুস্থতায় সচেতনতা ও হৃদরোগ এড়াতে চিকিৎসকদের পরামর্শ
বাংলাদেশের মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. খন্দকার মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম ভয়েস অফ আমেরিকা-কে বলেন, “ঢাকা শহরের বায়ুদূষণে মানুষ শ্বাসতন্ত্রের নানা অসুখে ভুগছে এবং হৃদরোগও বেড়েছে। তিনি বলেন হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে আমরা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাইডলাইন অনুযায়ী যেসব পরামর্শ দেই তার মধ্যে রয়েছে :
- ধূমপান বর্জন করা
- সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা
- তৈলাক্ত ও চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা
- ফলমূল ও শাকসবজি বেশি খাওয়া
- লবণ ও চিনি কম খাওয়া
- শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
- নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করা
- বেশি করে হাঁটার অভ্যাস করা
- উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা
- বাচ্চাদের গলাব্যথা ও বাতজ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া
- বয়স ৪০ বা তার বেশি হলে প্রতি ৬ মাসে ১ বার রক্তে চর্বির পরিমাণ পরীক্ষা করানো
- যাদের পরিবারে হৃদরোগের ইতিহাস রয়েছে তাদের বেশী সাবধানতা অবলম্বন করা
- মনের প্রভাব শরীরের ওপর পড়ে। কাজেই আমাদের যতদূর সম্ভব দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করা উচিত। এজন্যে নিয়মিত নামাজ প্রার্থনা, মেডিটেশন করা যেতে পারে।
যাদের হৃদরোগ আছে কিংবা হৃদযন্ত্রের কোনো সমস্যা আছে, যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, পরিবারের হৃদরোগের ইতিহাস আছে তাদের জন্য ডা. সাজিদ হোসেন খানের পরামর্শ হলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাইডলাইন অনুযায়ী নিয়মসমূহ মানার পাশাপাশি আরো কিছু বিষয়ে, বিশেষ করে খাবারের নিয়মাবলী খুব কঠোরভাবে মানতে হবে। যেমন:
- করোনারী হৃদরোগ আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ এবং সম্পৃক্ত ফ্যাটযুক্ত খাবার যেমন- কলিজা, মাছের ডিম, খাসি-গরুর চর্বিযুক্ত মাংস, হাঁস-মুরগীর চামড়া, হাড়ের মজ্জা পরিহার করতে হবে
- ঘি, মাখন, ডালডা, মার্জারিন, নারিকেল ও নারিকেলের তৈরী খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে
- বাইরের খাবার যেমন: ফাস্ট ফুড, বেকারি সামগ্রী, ভাজা পোড়া খাবার ইত্যাদি খাওয়া যাবে না কেননা এসব খাবারে ট্রান্সফ্যাট রয়েছে যা হৃদরোগের জন্য দায়ী
- পূর্ণ ননীযুক্ত দুধ ও দই এর পরিবর্তে অল্প
ননীযুক্ত দুধ ও দই খেতে পারবেন
- উচ্চ রক্তচাপের রোগী এবং হৃদরোগ আক্রান্ত রোগীরা বাড়তি লবন এড়িয়ে চলবেন (এমনকি ভাজা লবনও পরিহার করতে হবে
- দিনে ২-৩ কাপের বেশি চা বা কফি গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে
- যতটা সম্ভব দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে
- ডায়বেটিস থাকলে চিনি, মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। বেশি মিষ্টিযুক্ত ফল, অধিক শর্করা সমৃদ্ধ সবজি যেমন- আলু, মিষ্টি আলু, কচুর মুখী, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি হিসাব করে খেতে হবে।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে এবং যাদের হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদের ক্ষেত্রে কী ধরণের খাবার গ্রহণ উপকারী সে ব্যাপারে ভয়েস অফ আমেরিকা-র সঙ্গে কথা বলেছেন পুষ্টিবিদ ও এভার কেয়ার হাসপাতাল, ঢাকার প্রিন্সিপাল ডায়েটিশিয়ান তামান্না চৌধুরী। তার পরামর্শ অনুযায়ী,
- উপকারী এবং অসম্পৃক্ত চর্বিজাতীয় খাবার বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ, ছোট মাছ, মাছের তেল খেতে পারবেন
- প্রচুর পরিমানে ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে কারণ এসব খাবার শরীরে স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে। এক্ষেত্রে শিম ও মটরশুঁটি জাতীয় সবজি, কলাই ও ডাল জাতীয় শস্য এবং ফলমূল, হোলগ্রেইন আটার রুটি লাল আটা, লাল চালকে প্রাধান্য দিতে হবে
- উদ্ভিজ্জ তেল বিশেষ করে সূর্যমুখীর তেল, সয়াবিন তেল, সরিষার তেল রান্নায় ব্যবহার করা যাবে তবে অলিভ অয়েল ব্যবহার করলে শুধু সালাদে ব্যবহার করা যাবে (রান্নার জন্য নয়)
- সব ধরণের ডাল বিশেষ করে ছোলার ডাল, মুগ ডাল খেতে পারবেন। প্রতিদিন এক মুঠ বাদাম (কাঠবাদাম, চিনাবাদাম) খাওয়া উপকারী
- প্রোটিনের উৎস হিসেবে চামড়া ছাড়ানো মুরগির মাংস খাদ্য তালিকায় যোগ করতে হবে
- বিভিন্ন ধরণের রঙিন শাকসবজি যেমন, লাল শাক, পালং শাক, কলমি শাক, পাট শাক, মিষ্টিকুমড়া, শাক, পর্যাপ্ত পরিমানে খেতে পারবেন। লাউ, চালকুমড়া, ঝিঙা, চিচিংগা, শশা, ধুন্দল, লেটুসপাতা পর্যাপ্ত পরিমানে খেতে পারেন
- ফলের মধ্যে পেয়ারা, আপেল, নাসপাতি, আমড়া, আমলকি, জাম্বুরা, জাম পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারবেন। মিষ্টি ফল যেমন, আম, তরমুজ, কলা, মাজিলা, পাকা পেঁপে হিসাব করে খেতে হবে
- প্রতিদিন ১০-১২ গ্লাস পানি পান করতে হবে তবে যাদের পানি পানে সীমাবদ্ধতা রয়েছে তারা সেই অনুযায়ী ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
প্রতিদিন ব্যায়ামকে ‘হ্যাঁ’ বলুন
চিকিৎসকদের মতে, হৃদরোগ প্রতিরোধে শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হার্ট সুস্থ রাখতে শারীরিক শ্রম, খাবার দাবার ও পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন । ডা. সাজিদ হোসেন খান বলেন, “সপ্তাহে অন্তত কমপক্ষে পাঁচ দিন ৩০ মিনিট করে হাঁটা, জগিং, এই জাতীয় ব্যায়াম করা উচিত। অর্থাৎ সপ্তাহে ১৫০ মিনিট ব্যায়াম করাকে আমরা উৎসাহিত করি। হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য যে কোন সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে আমরা এই পরামর্শ দিয়ে থাকি।” ডা. মুজাহিদের মতে, হার্টের জন্য দরকার একটু দ্রুত গতিতে হাঁটা যা হার্ট রেট বাড়াতে সহায়তা করবে। আবার হাঁটা ছাড়াও সাঁতার ও সাইক্লিংয়ের মতো ব্যায়াম হার্টকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। এছাড়া নামাজ পড়া, বাসায় বা কর্মক্ষেত্রে হেটে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা, কাজের ফাঁকে অফিস বা বাসাতেই হাঁটা, ছাদে হাঁটা কিংবা অফিসে আসার সময় বা বাসায় যাওয়ার সময় গাড়ী একটু দুরে রেখে হেঁটে যাওয়া এগুলোও ফিজিক্যাল এ্যাকটিভিটিজ-এর মধ্যে পড়ে।
তবে যাদের হৃদরোগ আছে কিংবা ডায়েবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা আছে তাদের ক্ষেত্রে আগে শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কোন ব্যায়াম কার্যকর হবে তা ঠিক করে নেয়া উচিৎ বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।