আন্তর্জাতিক ইশারা ভাষা দিবস: ইশারা ভাষা অনুবাদকের গুরুত্ব বুঝে প্রয়োজন সর্বস্তরে সচেতনতা

একজন শিক্ষার্থী ইশারা ভাষা শিখছে।

"ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ধনিয়াখালি নামের গ্রামে একটি মেয়েদের হোম ছিল। সেখানে ২০১২/১৩ সালে একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সিঁড়ির নীচ থেকে একটি মেয়ের লাশ পাওয়া যায়। সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী মেয়েটি মূক ও বধির। দশ বছর ধরে প্রত্যক্ষদর্শী মেয়েটিকে প্রায় প্রতি মাসে কোর্টে যেতে হয় এবং জবানবন্দি দিতে হচ্ছে। বর্তমানে মেয়েটির শারীরিক অবস্থা প্রচণ্ড অবনতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ফলত দশ বছর আগেকার ঘটনা তাঁর পক্ষে ঠিকঠাক মনে রাখাও একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় অপজিশনের উকিল বারবার মেয়েটিকে পাগল প্রমাণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রথমে বেঙ্গল পুলিশ (ওয়েস্ট বেঙ্গল অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ) এই কেসের দায়িত্ব নেয়, তারপর কেস যায় সিবিআই (কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা)-এর হাতে। কিন্তু সুরাহা কিছুই হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীর নিয়মিত বয়ান রেকর্ড করাও একটা সমস্যার বিষয়। পুলিশ এবং উকিলদের নানান কটূক্তি শুনতে হচ্ছে।”

সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ ইন্টারপ্রেটার-এর বাস্তব অভিজ্ঞতা

কথাগুলি ভয়েস অফ আমেরিকা-কে বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ ইন্টারপ্রেটার রজনী বন্দ্যোপাধ্যায়। ২৩ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাইজ ল্যাঙ্গোয়েজ বা ইশারা ভাষা দিবস। বিশ্বজুড়ে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ বা ইশারা ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করা এবং সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ অনুবাদকদের নিয়ে নানান অনুষ্ঠান, কর্মশালার আয়োজন হয়। রজনী বন্দ্যোপাধ্যায় সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ অনুবাদক হিসেবে কাজ করছেন প্রায় দশ বছর ধরে। বিভিন্ন কর্মশালা, আলোচনাসভা, অনুষ্ঠান তো বটেই, তিনি মূলত কাজ করে যাচ্ছেন মূক ও বধির মানুষদের বিভিন্ন কারণে যখন আইনি সহায়তার প্রয়োজন হচ্ছে, সেখানে ইশারা ভাষা অনুবাদক হিসাবে।

ভয়েস অফ আমেরিকা-কে তিনি আরও জানাচ্ছেন, “ধনিয়াখালির ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী মেয়েটির বয়স বেড়েছে, সে কারণে তার মানসিক ও শারীরিক ভারসাম্য কিছুটা নষ্ট হচ্ছে। দশ বছর আগে সে যা দেখেছিল এখন তার পক্ষে সবটা মনে রাখা স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু পুলিশ, কোর্ট এবং অপজিশনের উকিল তা কিছুতেই মানতে পারছে না। একজন সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ অনুবাদক হিসেবে আমাকে নিয়মিত হেনস্তা করা হচ্ছে। ওদের দাবি আমি মেয়েটিকে সাহায্য করে যাচ্ছি, মেয়েটি যা বলছে আমি তা ঠিকভাবে অনুবাদ করছি না। এটি একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ঘটনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূক ও বধির ছেলে-মেয়ে, বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে সংগঠিত কোনো অপরাধের কেস থানায় ডায়েরি করানো দায় হয়ে উঠে। তার প্রথম কারণ সাংকেতিক ভাষা বুঝতে না পারা, দ্বিতীয়ত সাংকেতিক ভাষার অনুবাদক না থাকা। আরেকটি কারণ আমরা বুঝতে পারি না, তা হল সংকীর্ণ মানসিকতা। 'বোবাদের আবার কিসের কেস' এই মানসিকতা প্রায় সমস্ত জায়গায় রয়েছে।”

পরিসংখ্যান ও যৌন হেনস্থার ঘটনায় আইনি ক্ষেত্রের বাস্তবচিত্র

ভারতবর্ষে বর্তমানে ২ কোটি ৫০ লক্ষ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ রয়েছেন (সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা)। কিন্তু সেই তুলনায় অনুবাদকের সংখ্যা খুবই কম।

২০১২ সালের পকসো (প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট) ও ২০১৩-এর সিলএএ (ক্রিমিনাল ল’ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) অনুযায়ী প্রতিবন্ধকতাযুক্ত কোনও শিশু বা মহিলা যখন যৌন হেনস্থার অভিযোগ করছেন তখন রাজ্যর নির্দিষ্টভাবে তাতে হস্তক্ষেপ করা বাধ্যতামূলক। এই দু’টি আইন অনুযায়ীই রাজ্য প্রশাসনকেই অভিযোগকারীর জন্য স্পেশাল এডুকেটর ও আরসিআই নথিভুক্ত সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ ইন্টারপ্রেটার-এর পরিষেবার ব্যবস্থা করতে হবে।

কিন্তু বাস্তবে থানাগুলিতে অনুবাদকের কোনো তালিকা নেই। রজনী বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, “পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত থানাতেই সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ অনুবাদকের তালিকা নেই। কিছু জায়গায় এখন তালিকা পাওয়া গেলেও সব অনুবাদক সক্রিয় নয় এবং কিছু জায়গায় টাকা দিতে হবে না এই ভেবে বাড়ির লোকজনকে দিয়েই ইন্টারপ্রেট করিয়ে নেওয়া হয়। এতে করে প্রকৃত সত্য সামনে আসে না। ভিক্টিম সঠিক বিচার পায় না।”

আইনজীবী যা বলছেন

আমাদের দেশে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলারা শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে ‘সফ্ট টার্গেট’। কারণ বিচারালয়ে এদের বয়ান দিতে হয় ইন্টারপ্রেটারের মাধ্যমে। সেখানে বাস্তব আর ব্যাখ্যার ফারাক থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। তাই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলারা নির্যাতিত হলে অপরাধীর সাজার ঘটনা হয় না বললেই চলে। আবার প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে অনেক অভিভাবকই থানা পুলিশ করতে চান না। অনেকক্ষেত্রে নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে লোক জানাজানির ভয়ে সামাজিক ছুঁৎমার্গের কার‍্যণে অভিভাবকরা বিষয়টি চেপে রাখেন।

কলকাতা হাইকোর্ট-এর আইনজীবী সোহম ব্যানার্জী ভয়েস অফ আমেরিকা-কে জানালেন, "কোন অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হ'লে তবেই একজন অভিযুক্ত অপরাধীর তকমা পায়, এবং তার শাস্তি নির্ধারণ করা হয়। এই অভিযোগ প্রমাণ করার যে দায়িত্ব, তা বর্তায় প্রসিকিউশনের উপর । অভিযোগ প্রমাণের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হ'ল ভিক্টিম-এর ভার্সান-এর কোরোবরেশন। কাজেই মহিলাদের উপর হিংসার ঘটনার ক্ষেত্রে সারভাইভিং ভিক্টিমের সাক্ষ্যই, অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ।

ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট-এর সেকশন ১১৯ অনুযায়ী বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীর সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করার সময় কোর্ট ইন্টারপ্রেটার কিংবা স্পেশাল এডুকেটর-এর সাহায্য নিতে পারে, এবং সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির ভিডিওগ্রাফি করতে হয়।

সঠিকভাবে একজন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের সময় আদালত ভিক্টিম-এর আন্ডারস্টান্ডিং ক্যাপাসিটি যাচাই করার পাশাপাশি, ইন্টারপ্রেটারের হলফও গ্রহণ করে । কাজেই, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মহিলার উপর ঘটা হিংসার ঘটনায় একজন ইন্টারপ্রেটার বা স্পেশাল এডুকেটর-এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।"

ইশারা ভাষা গ্লবসের মাধ্যমে শেখানো হচ্ছে।

সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ ইন্টারপ্রিটেশন হিসাবে উপার্জন

পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে রিহ্যাবিলেটশন কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (আরসিআই)-তে নথিভুক্ত আছেন এমন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার-এর সংখ্যা ৬২। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ অনুবাদকদের নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বেতনভাতা। পশ্চিমবঙ্গে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ অনুবাদকদের জন্য কোনো সরকারি চাকরি নেই। সবটাই করতে হয় বেসরকারিভাবে। তাতে তাদের বেতনভাতার নিশ্চয়তা একেবারেই থাকে না। অথচ বারেবারেই বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসে পেশাগতভাবে এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীতার এবং সঠিক প্রশিক্ষণ শেষে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে বহু তরুণের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হওয়ার কথা।

রজনী বলছেন, “সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ অনুবাদকরা প্রায় সবাই ফ্রিল্যান্সিং করেন। তাদের কারোরই স্থায়ী কোনো কাজ নেই। এদিকে কোর্ট বা থানা থেকে ডাক এলে আপনাকে যেতেই হবে, নয়তো কোর্ট আপনার বিরুদ্ধে সমন জারি করতে পারে। কিছু মাস আগে আমার হাত ভেঙে গিয়েছিল, কোর্ট থেকে ডাক আসায় নিজের অবস্থান জানাই, কিন্তু কোর্ট তা কিছুতেই মানতে চায়নি। পরবর্তীতে কোর্টে গিয়ে আমাকে প্রমাণ করতে হয় যে আমার হাত ভাঙা এবং সেই কারণে আমি সইটুকুও করতে পারবো না। মূক ও বধিরদের সঙ্গে তো বটেই আমাদের সঙ্গেও নিয়মিত এই বৈষম্যমূলক আচরণ চলছে। অপজিশন থেকে নানারকম ধমকি চলতে থাকে। সরকারের লোকজনও আমাদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করে। সরকারি সহযোগিতা না পাওয়ার কারণে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ অনুবাদক হিসেবে কেউ নিজের পেশা বাছাই করতেও অসুবিধেয় পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে এমন উদাহরণ আছে।”

সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ ও অনুবাদকের গুরুত্ব বুঝে সচেতন উদ্যোগ প্রয়োজন

ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছিল দীর্ঘদিনের প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মী স্বাতী চক্রবর্তীর সাথে। তার মতে, “আমাদের দেশে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ নিয়ে সচেতনতা খুবই কম। বিদেশে যেরকম বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং সরকারি স্থানে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ অনুবাদক থাকেন এখানে তা নয়। আমাদের দেশে নেই বললে ভুল। বহু আগে দূরদর্শনে ছিল। এখন নেই। শহরের কিছু জায়গায় এখন সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ শেখানো হয়, অনুবাদকও আছেন কিন্তু গ্রামাঞ্চলে তা একেবারেই নেই। ফলে নানারকম নির্যাতনের ঘটনা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এই সমস্ত বিষয়ে ভিক্টিম কোনো সাহায্য পান না। পশ্চিমবঙ্গে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ অনুবাদকদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। তাদের যখন বিভিন্ন সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ অনুবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাদের জন্য কোনো সাম্মানিক থাকে না। একটি কনফারেন্সে যখন একজন অনুবাদক কাজ করেন তাকে সারাদিন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কিন্তু যোগ্য সাম্মানিক পান না। সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ অনুবাদকদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই সারা দেশ জুড়েই বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। সরকার বহু আগে সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ অনুবাদক নিয়োগ করেছিল কিন্তু তাদের সাম্মানিকের পরিমাণ একজন শিক্ষকের থেকেও অনেক কম। কিন্তু বিভিন্ন স্কুলে নিয়োগ হওয়া সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ অনুবাদকরা কিন্তু দুই বছরের স্পেশাল বি-এড করেই কাজে যোগ দিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের গোসাবা এবং বাসন্তি ব্লক বিরাট এলাকা জুড়ে। সেখানে ৭ জন স্পেশাল এডুকেটর ছিলেন। এখন মাত্র ১ জন আছেন। তো এতে করে প্রয়োজন অনুসারে সাধারণ মানুষ যেমন সুবিধে পাচ্ছেন না, তেমনি নতুন মানুষ এই কাজে যোগ দিচ্ছেন না কর্মক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার জন্য।”