সাঈদী প্রসঙ্গে এএইচআরসি প্রতিনিধির বক্তব্য; সমালোচনা করলেন মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদরা

সাঈদী প্রসঙ্গে এএইচআরসি প্রতিনিধির বক্তব্য; সমালোচনা করলেন মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদরা

জামায়াতে ইসলামী নেতা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধের বিষয়টিকে হালকা করে দেখানোর জন্য এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের (এএইচআরসি) একজন প্রতিনিধির সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদরা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের মামলার অপরাধীদের রক্ষা করতে, এটি উৎসাহিত করে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।

এএইচআরসি অ্যান্ড এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের পক্ষ থেকে লিয়াজোঁ অফিসার মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে টম ল্যানটোস হিউম্যান রাইটস কমিশন আয়োজিত সাম্প্রতিক এক ব্রিফিংয়ে অংশ নেন। সেখানে তিনি সাঈদীর বিষয়ে কিছু মন্তব্য করেন।

টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনের ওয়েবসাইটে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আশরাফুজ্জামান বলেন, “সাঈদী একজন ইসলামিক স্কলার…। শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে আপনি যদি বিরোধী দল বা ভিন্নমতাবলম্বীদের সঙ্গে থাকেন তাহলে, আপনার জানাজা বা সামাজিক স্বীকৃতির অধিকার পাবেন না। এটি কোনো নতুন ঘটনা নয়।”

তারা বলেন যে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে 'রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার' হিসেবে চিত্রিত করেছে এইচআরসি। ১৯৭১ সালে তিনি যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, সে সম্পর্কে বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা এটি। একই সঙ্গে তার মৃত্যুর পর জামায়াত-শিবিরের লোকেরা যে সহিংসতা চালিয়েছে সে বিষয়কেও হালকা করা হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদরা আরো বলেন, ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী স্ক্রিনিং সেন্টার সাঈদীকে তাদের ‘নো ফ্লাই’ তালিকায় যুক্ত করেছিলো। সন্দেহভাজন উগ্রপন্থী ও সন্ত্রাসীদের সে দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে সেই তালিকায় নাম যুক্ত করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন-এর ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশিদের হত্যার বিষয়টিকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কথা উল্লেখ করেন তারা। বলেন, এএইচআর-এর বিবৃতিটি এই সমর্থনকে অস্বীকার করে।

মুক্তিযোদ্ধা অজয় দাশগুপ্ত বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দেখানোর জন্য পাঁচ সাংবাদিকের ওপর হামলা, ব্যস্ততম হাসপাতালের সামনে জামায়াত শিবিরের লোকজন রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টিসহ দিনব্যাপী সহিংসতার ঘটনায় নীরব থাকায় তাকে জামায়াতের মুখপাত্র বলে মনে হয়েছে।”

তিনি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ জার্নালিস্ট (আইএফজে) এর আহ্বানের কথা উল্লেখ করে বলেন, “এই সাংবাদিকদের ওপর নৃশংস হামলার ঘটনার দ্রুত তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। তারপরও, সাঈদীকে তার পৈতৃক বাড়িতে দাফন করা হয়েছে এবং তার জানাজায় তার অনুসারীরা অংশ নিয়েছে। অথচ আশরাফ তার দাফনের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে সরকারকে দোষারোপ করেছেন।”

অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, “পাকিস্তানি বাহিনী ও সাঈদীর দল লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে এবং তাদের ধর্ষণ ও নির্যাতনসহ ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণার অভাব প্রকাশ করে এই বিবৃতি।যুদ্ধাপরাধীদের 'ভুক্তভোগী' হিসেবে চিত্রিত করে এ ধরনের আখ্যান আগে পশ্চিমা দেশগুলোতে জামায়াতের ভাড়া করা লবিস্টরা প্রচার করেছিলো।”

নুরেমবার্গ ও টোকিও বিচারের সময় যুদ্ধাপরাধের বিচারে পশ্চিমা শক্তিগুলো যে মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে তার উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা-শিক্ষাবিদরা বলছেন, “বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে নতুন মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে।

মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদরা বলেন, “পাঁচ দশক ধরে সাঈদীর মতো যুদ্ধাপরাধীদের হাতে স্বজন হারানো লাখ লাখ মানুষের পরিবার ন্যায়বিচার পায়নি। কারণ বিএনপি-জামায়াতের আমলে পরিকল্পিতভাবে এদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিলো।” তারা উল্লেখ করেন যে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এড়াতে এবং এই অপরাধীদের দায়মুক্তির সংস্কৃতি অব্যাহত রাখতে, কয়েক দশক ধরে ভুল তথ্য প্রচার করা হচ্ছিলো।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুরে হত্যা, ধর্ষণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর, অগ্নিসংযোগ ও অপহরণের দায়ে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে তার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন। ২০১৭ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ আদালত সাঈদীর রিভিউ আবেদন খারিজ করে দণ্ড বহাল রাখেন।