রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পাগল’ প্রবন্ধে বলেছেন – “কিন্তু এই দিনই আমাদের বড়ো দিন - - এই অনিয়মের দিন, এই কাজ নষ্ট করিবার দিন। যে দিনটা আসিয়া আমাদের প্রতিদিনকে বিপর্যস্ত করিয়া দেয় সেইদিন আমাদের আনন্দ। অন্যদিনগুলি বুদ্ধিমানের দিন, সাবধানের দিন, আর একটা দিন পুরা পাগলামির কাছে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ-করা।”
যে নিয়মে আমরা প্রতিদিন চলি তার বাইরে গিয়ে অন্য একটা দিন চলা প্রয়োজন। কিন্তু, “কী রে! বেলা দশটা তো হয়ে গেল এবার ওঠ আর আলসেমি করিস না। দিনদিন একটা কুড়ে তৈরি হচ্ছে” – নানা রকম ভাবে এই ধরণের কথাগুলির সঙ্গে কমবেশি আমরা সকলেই পরিচিত। ছোটোবেলা থেকেই বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে থাকা অনুমতি প্রায় কেউই পাই না কারণ এটাকে খারাপ অভ্যাস ভাবা হয়। সামাজিক বিচারের মাপকাঠিতে অলসতা কখনই কাম্য নয়। Idle mind is devil’s factory – এই প্রবাদটি শুনেই আমাদের বড় হয়ে ওঠা। কিন্তু একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে এই বিষয়টিকে নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে – অলসতা মানে শুধুই খারাপ নয়, তার ভালো দিকও আছে। নিত্যদিনের জীবনের ব্যস্ততার থেকে দূরে নিজের সঙ্গে খানিক ‘কোয়ালিটি’ সময় কাটানোও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার পাভলভ হাসপাতালের মনোবিজ্ঞানী গীতশ্রী সাহা ভয়েস অফ আমেরিকা-কে বলেন, “আমরা কালকে কী খাবো এই ভাবনা মানুষের মধ্যে অবশ্যই থাকবে এবং থাকাটাও জরুরি। কিন্তু তার সঙ্গে একটা দিন শুধুমাত্র নিজের জন্য বেহিসাবী হয়ে উঠলে পরবর্তী দিনগুলিতে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পাওয়া যায়। আমাদের কর্মময় জীবনে এইরকম অলস দিনের প্রয়োজন যা মানুষদের সম্মৃদ্ধ করে উত্তরণের দিকে নিয়ে যায়। দিনটি নিজের মতো করে উদ্যাপন করার মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতে দিনগুলি আরও রঙীন হয়ে ওঠে।” এই ‘মি টাইম’-এর কথা মাথায় রেখে ১০ই আগস্ট পালিত হয় ‘বিশ্ব অলসতা দিবস’।
আলস্যের জন্য একটি দিন…
এই দিনটির ইতিহাস নিয়ে সুস্পষ্ট কোনও গল্প জানা যায় না। তবে বলা হয়, ১৯৮৪ সালে কলম্বিয়ার ব্যস্ততম নগরী বলে খ্যাত ইতাগুইয়ে শিল্প, বাণিজ্য ও সংস্কৃতি উৎসবের শেষদিনে সূচনা হয় এই দিনটির। তারপর থেকে ২৭ বছর ধরে স্থানীয়ভাবেই দিনটিকে ধুমধাম করে পালন করতো বাসিন্দারা। পরে ২০১২ সালে ‘বিশ্ব অলসতা দিবস’ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় এই দিনটি।
এইদিনটির বিশেষ উদ্দেশ্য হল – ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত জীবনে বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা। আধুনিক বিশ্বের মানুষের রিল্যাক্স করতে এবং শিল্প, সংস্কৃতির সঙ্গে বিশ্রাম উপভোগ করতে শিখতে হবে। তাই আলসেমি দিবসের এই ব্যতিক্রমী আয়োজন। একই সঙ্গে শিল্প, সংস্কৃতি উপভোগে অবসরের গুরুত্বও প্রকাশ পায় এর মধ্য দিয়ে। মহা ধুমধামে দিনটি উদযাপন করেন ইতাগুই শহরের বাসিন্দারা। এদিন মাঝ রাস্তায় বিছানা পেতে অবসর সময় কাটান তারা। মূলত হাসি-আনন্দের মধ্য দিয়ে, ব্যস্ত জীবনে অবসর সময়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলার পাশাপাশি পুরো আয়োজনের করে চেষ্টা করা হয় আলসেমিকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে তুলে ধরার।
কেন হঠাৎ আলসেমির দরকার...
ছোটবেলা থেকেই আমাদের একটু একটু করে কর্মব্যস্ত জীবনের সঙ্গে পরিচয় ঘটতে থাকে। প্রতি মুহূর্তে আমাদের ব্যস্ত হতে, নানান কার্যকলাপ করতে এবং চ্যালেঞ্জ নিতে শেখানো হয়। কারণ কঠোর পরিশ্রম, কর্মক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু এই একভাবে কাজ করতে করতে একবিংশ শতকে মানুষ অনেকাংশে যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। কিন্তু কেউ যদি এই একঘেয়েমির থেকে সাময়িক বিরতি চায় সেক্ষেত্রে ‘অলস’ - তকমা জোটে তার কপালে। সাধারণত এখনও, সমাজ অলসতাকে খারাপ অভ্যাস মনে করে। এটা নৈতিকভাবে ভুল। আর অলস ব্যক্তিকে উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন বলেই চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু অলসতা কি শুধুই নেতিবাচক?
চিকিৎসক আর মনোবিদরা জানাচ্ছেন জৈবিক প্রয়োজনেই বিশ্রাম নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই দীর্ঘকালীন বিরামহীন কাজ শরীর ও মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম যথাযথ না হলে নতুন উদ্যমে পরবর্তী কাজ সহজে হয় না। তবে বিশ্রাম অর্থে বিছানায় শুয়ে মুঠোফোনে রিলস দেখা বা সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটা নয়। এতে হিতে বিপরীত হয়। দীর্ঘক্ষণ এই মোবাইলের ব্যবহার চোখ ও মাথার অনেক সমস্যা ডেকে আনে। তাই ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসগুলি যথাসম্ভব দূরে সরিয়ে আলস্যে ভরা বিশ্রাম হতে পারে নিশ্চিন্তে ঘুম অথবা করতে পারেন আপনার পছন্দের কাজগুলি যা আপনার আগামীদিনের জন্য মানসিক ও শারীরিক শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করবে। ‘বিশ্ব অলসতা দিবস’ অলসতা উদযাপন করার একটি দুর্দান্ত উপায়, এটি আপনার অলস দিনটির সুবিধা নেওয়ার একটি ভাল সুযোগও বটে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রাক্তন ক্লিনিকাল কাউন্সেলার সৌমিতা চক্রবর্তী ভয়েস অফ আমেরিকা-কে বলেন, “Taking Break from the busy schedule of everyday and spending a day in ‘pajama’ is very essential for us.” এইরকম ছুটি মস্তিষ্কের বিশ্রামের সঙ্গে আমাদের শরীরকেও পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করে। তিনি আরও বলেন, “ঘুম প্রসঙ্গে যদি বলা যায় তাহলে বিভিন্ন গবেষণা থেকে আমরা দেখি যে – আরইএম স্লিপ অর্থাৎ গাঢ় ঘুম আমাদের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। আবার আমরা যি না ঘুমিয়েও আমাদের পছন্দ মতো কাজ করতে থাকি তাহলে হ্যাপি হরমোন আমাদের শরীর থেকে নির্গত হয় যা শরীর ও মনকে সতেজ রাখে।” সৌমিতা নিজের জন্য প্রতিটি মানুষের সময় রাখা বিষয়ে জানালেন, “প্রতিটি মানুষের উচিত নিজেদের সময় ও সুযোগ বুঝে নির্দিষ্ট সময় অন্তর এইরকম একটা দিন বা নিদেন পক্ষে একটা বেলা অলসভাবে নিজের মতো করে কাটানো। এই মি টাইম কাটানোর জন্য অপরাধবোধ বা গ্লানিবোধের কোনো কারণই থাকা উচিত নয়।”
তবে চিকিৎসকদের পরামর্শ - যখন আরাম করি অনেক সময়েই ভুলে যাই সঠিক মাত্রায় জল ও খাবার খাওয়ার কথা। সেই বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।
কী কী করা যেতে পারে...
যদিও বিশ্ব অলসতা দিবসে, যতটা সম্ভব কম কাজ করা উচিত। তবে অলস হওয়ার অর্থ এই নয় যে আপনার কোন পরিকল্পনা বা দায়িত্ব নেই—আপনাকে কেবল নিশ্চিত করতে হবে যে সেই পরিকল্পনাগুলি এমন হওয়া উচিৎ যা আসলে আপনার উপকার করবে! আপনাকেই বেছে নিতে হবে ব্যস্ত জীবনধারার জন্য কোন ক্রিয়াকলাপগুলি সবচেয়ে ভাল কাজ করবে। তাই আপনি যদি একটু অন্যভাবে দিনটিকে উদযাপন করতে চান তাহলে বেশ কিছু কাজ করতে পারেন -
-
পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান - নিত্যদিনের ব্যস্ততায় আমরা সবসময়ে পরিবারকে তেমন সময় দিয়ে উঠতে পারি না। তাই এইদিনে কিছুক্ষণ পরিবারের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিয়ে ভালো সময় কাটাতে পারেন।
-
পোষ্যর সঙ্গে খেলাধুলো - বাড়িতে পোষ্য থাকলে তার/তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন। এতে শারীরিক ও মানসিক উদ্বেগ অনেকটাই কমে।
-
বই পড়া - বই পড়া একটি আকর্ষণীয় ও আনন্দদায়ক বিষয়। এটি সংস্কৃতি এবং জীবনধারা সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারে। তাই বিশ্ব অলস দিবসে, একটি ভাল বই নিয়ে পড়া দারুণ আরামদায়ক হতে পারে।
-
সিনেমা/নাটক দেখা - ভালো কোনও সিনেমা বা নাটক দেখা যেতে পারে। তবে সেটি মুঠোফোনে না দেখাই ভালো। ছোট স্ক্রিনে বেশিক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে আবার চোখ এবং মাথার ব্যথা শুরু হতে পারে।
-
গান শোনা, ছবি আঁকা - গান শুনতে ও ছবিও আঁকতে পারেন। আবার চাইলে কোন বাদ্যযন্ত্রও বাজাতে পারেন। অনেকক্ষেত্রে এই বিষয়গুলি থেরাপির কাজ করে ভালো। দৈনন্দিন নানা চিন্তা থেকে এগুলি আপনাকে দূরে রাখবে।
-
বাগান করা - অনেকেরই গাছের শখ থাকে। সেক্ষেত্রে এই বিশেষ দিনটিতে আপনি আপনার বাগানটিকে আরও খানিকটা গুছিয়ে তুলতে পারেন।
-
রান্না করা - রান্নাও একটা শিল্প। অনেকেই রান্না করতে এবং খাওয়াতে বেশ পছন্দ করেন। এইদিনে তারা মনের মতো দু’ একটা পদ রান্না করতে পারেন।