৯ অগাস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। আর্ন্তজাতিক দিবসটি বিশ্বের ৯০টি দেশে ৩৭০ বিলিয়ন আদিবাসীরা উদ্যাপন করেন। সারা বিশ্বের সঙ্গে এই দিবস পালিত হবে ভারতেও। সরকারি হিসেব অনুসারে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৮.৬ শতাংশ তপশিলী উপজাতিভুক্ত। সংখ্যার নিরিখে যা ১০ কোটির বেশি। ভারতীয় সংবিধানের ৩৪২ নম্বর অনুচ্ছেদে ৭৩০টিরও বেশি তপশিলী উপজাতি গোষ্ঠীকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে (তথ্যসূত্র: আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রক, ২০২২)। ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশ্ব আদিবাসী দিবসটি পালন ৪৯/২১৪ বিধিমালায় স্বীকৃতি পায়। প্রতি বছর ৯ অগাস্ট উদ্যাপন করেন। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালকে আদিবাসীবর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। ভারতসহ অন্যান্য দেশেও আদিবাসী জনগণ তাদের ভূমির অধিকার, অঞ্চলের অধিকার, নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও ভাষার পরিচয়, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ও নাগরিক মর্যাদার স্বীকৃতি দাবীতে দিবসটি পালন করেন।
২০২১ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, “জনজাতি গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিতে বীরসা মুন্ডার জন্মদিন ১৫ নভেম্বরকে জনজাতি গৌরব দিবস হিসেবে উদযাপন করা হবে। আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা এবং ভারতীয় শৌর্য্য, আতিথেয়তা ও জাতীয় গর্বকে এর মাধ্যমে সকলের মাঝে তুলে ধরা হবে।” (তথ্যসূত্র: পিআইবি, ১০ নভেম্বর, ২০২১)। ভারতে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে প্রায় ১২.৩২ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৫২৪.৮৭ কোটি টাকা যা ২০২২-২৩ বর্ষে বাড়িয়ে হয় ৮ হাজার ৪৫১.৯২ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ভারতে, ২০০৬ সালের বনভূমি অধিকার রক্ষা আইনে বলা হয়েছে, জঙ্গল বা তার ধারেকাছে বসবাসকারী পরিবারগুলিকে জমির মালিক হিসেবেই গণ্য করা হবে৷ কিন্তু সরকারি সরকারি সহায়তার অভাবে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সেই সংক্রান্ত নথিপত্র দেখাতে পারেননি বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে বসবসাসকারী বনবাসীরা৷ এরফলে ২০১৯ সালে অন্তত ১৭টি রাজ্য থেকে ১০ লাখেরও বেশি বনবাসী উপজাতি ও অন্যান্য জনজাতি পরিবারগুলিকে উচ্ছেদের নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট৷ বিভিন্ন আদিবাসী অধিকার রক্ষা গোষ্ঠীগুলি তখন অভিযোগ করে যে, চূড়ান্ত শুনানির দিনে তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য সরকারের তরফে কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না৷ একেবারে প্রথম থেকে এই সমস্যার সমাধানে সরকার উদাসীন থেকেছে। ফলে ২০০৬ সালের জনজাতি গোষ্ঠীগুলির অরণ্যের অধিকার আইনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়৷ বিগত তিন বছরে, ২০১৯-২০২১, ৫৫৪.৩ বর্গ কিলোমিটার বনভূমিতে খনি-রাস্তা-সেচ প্রকল্প রূপায়ন করার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ১১২.৭৮ বর্গ কিমি বনভূমি ব্যবহার করা হয়েছে খনি প্রকল্পের জন্য। ১০০.০৭ বর্গ কিমি সড়ক নির্মাণ, ৯২.২৭ বর্গ কিমি সেচ, ৬৯.৪৭ বর্গ কিমি প্রতিরক্ষা, ৫৩.৪৪ বর্গ কিমি জলবিদ্যুৎ, ৪৭.৪০ বর্গ কিমি বিদ্যুৎ পরিবহন, ১৮.৯৯ বর্গ কিমি রেল প্রকল্পের জন্য বনভূমি থেকে অ-বনজ কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ১৮ জুলাই ২০২২, সংসদে এই তথ্য পেশ করেছিলেন কেন্দ্রীয় বন, পরিবেশ ও জলবায়ু দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী অশ্বিনী চৌবে।
২০২৩ সালের অগাস্ট মাসে বাদল অধিবেশন চলছে ভারতের সংসদে। ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য মণিপুরে চলা কয়েক মাস ব্যাপী গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং অচলাবস্থা নিয়ে সংসদের দুই কক্ষেই যখন বিরোধী পক্ষ সরকারকে জবাবদিহি করাতে চেয়ে ব্যস্ত, তখন অধিবেশনের পঞ্চম দিনে বিতর্কিত বন সংরক্ষণ (সংশোধনী) বিল লোকসভায় পাশ করিয়ে নিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। তারপরের সপ্তাহে তা রাজ্যসভাতেও পাশ হয়ে বর্তমানে আইনে রূপান্তরিত হতে চলেছে। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় পরিবেশ বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের তরফ থেকে ২০০৩ সালের ফরেস্ট কনজার্ভশন রুল-এ বিবিধ সংশোধনীর মাধ্যমে অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে গ্রামসভার তরফ থেকে তাদের সংশ্লিষ্ট বনাঞ্চলে বিভিন্ন প্রকল্পে অনুমতি প্রদান করা বা না করার সাংবিধানিক এবং আইনি অধিকার খর্ব করা হয়েছে, নির্দিষ্ট বনভূমির চরিত্র বদলের নিয়মকানুনকে শিথিল করা হয়েছে এবং বনভূমির সংরক্ষণের নামে বেসরকারিকরণের পথ খুলে দেওয়া হয়েছে। বিলটির ভূমিকা পর্বে ‘আর্থিক প্রয়োজন’ শব্দবন্ধের উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে ‘সংরক্ষণের এবং বনাঞ্চল পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে, বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে, বনাঞ্চলের সাংস্কৃতিক এবং পরম্পরাগত মূল্যবোধ বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে এবং অর্থনৈতিক প্রয়োজনের সাথে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা না বাড়ানোর সাযুজ্যের উপায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন’। এক্ষেত্রে কার বা কাদের অর্থনীতিক প্রয়োজনের কথা বলা হচ্ছে, তা অনুধাবন করাই এই বিলের মূল বিষয়। ‘অর্থনৈতিক প্রয়োজনের’ নামে এই প্রস্তাবিত সংশোধনীর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার মূলত বনসংরক্ষণ আইনের আওতা থেকে আরো বেশি বনাঞ্চল ও বিভিন্ন প্রকল্পকে ছাড় দিতে চাইছে। গত তিন বছরে কেন্দ্রীয় সরকার অবাধে বনাঞ্চলকে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছিল বরিষ্ঠ স্বাধীন গবেষক কুমার রাণা-র সঙ্গে। তিনি জানালেন, “ডিফরেস্টেশন-এর ইতিহাস ৪০০ বছরের পুরনো। ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন, ডিফরেস্টেশন, গ্রোথ অফ ক্যাপিটালিজম, এগুলো সব একসঙ্গেই এসেছে। এই যে ভারতে বিলটা পাশ হয়ে গেল যে জঙ্গলের বর্ডারের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে গাছ কেটে ফেলা যাবে, এইটার মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর নির্বুদ্ধিতা কাজ করছে। মানুষের সমাজের একটা অংশ নিজেদের স্বার্থের জন্য সমগ্র হিউম্যান স্পিসিস-কে বিপদে ফেলে দিল। আদিবাসীদের যে ফিলজফিকাল আউটলুক, সেদিক থেকে তারা, যারা আদিবাসী নন, তাদের থেকে অনেক অ্যাডভান্সড। সবক্ষেত্রে অবশ্যই নয়। আর আমি এটা কোনও আদিবাসী রোম্যান্টিসাইজেশন-এর জায়গা থেকেও বলছি না। আদিবাসীরা বিশ্বাস করেন যে এমন কিছু ধ্বংস করা উচিত নয়, যা আমরা সৃষ্টি করতে পারব না। জঙ্গলের বিষয়টিকেও এই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে। প্রাকৃতিক জঙ্গল হল এমন একটি বিষয় যা আমরা সৃষ্টি করতে পারি না। প্রকৃতির উদ্দেশ্য, নিয়মাবলীর মধ্যে কিছু বিষয় আছে, যার মধ্যে এটি তৈরি হয়। আমাদের দেশে নিয়মগিরি বা ছত্তিশগড়ে প্রচুর জঙ্গল নষ্ট হয়েছে। আমরা চাইলেই তা তৈরি করে ফেলতে পারব না। সারা দেশের মোট জঙ্গলের ৩০-৪০ শতাংশ আমরা ধ্বংস করে দিয়েছি। কারণ আমাদের জঙ্গলের কাঠ চাই, জঙ্গলের নীচের খনিজ চাই। এরফলে এক ব্যাপক অংশের মানুষের ক্ষতি হচ্ছে। সেই জায়গায় কী করে জঙ্গলকে রক্ষা করতে পারি, তা নিয়ে আমাদের আদিবাসীদের সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। মনে রাখতে হবে পাহাড়িয়াদের সিড কাল্টিভেশনে যে গাছ কাটা হয়, তা জঙ্গল ধ্বংস করা নয়। জঙ্গলে চাষবাসের জন্য কিছু গাছ ৫/৬ ফিট ওপর থেকে কেটে দেওয়া হল, ফেলে দেওয়া ডালপালা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সাঁওতালরা এসে সংগ্রহ করে নিয়ে যান। কারণ কাঁচা কাঠ কাটা মানা। এই দূরদর্শীতাকে এই আইন পাশের সময় স্বীকৃতি দেওয়া হল না। সারা পৃথিবী যখন বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে, আমাজন-এ আন্দোলন চলছে, ভারতে আদিবাসী ও অন্যরা আন্দোলনে শামিল হচ্ছেন, সেখানে সরকার কারও কথা না শুনে বিল পাশ করল। আমাদের দেশে একদিকে রাম মন্দির তৈরি হওয়া থেকে অন্যদিকে আদিবাসী বিরোধী এই বিল পাশ হওয়া এই পুরোটাই হয়েছে পুঁজির স্বার্থে। এই জঙ্গল কাটা হলে তার ঠিকা পাবেন আদানি-আম্বানিরা।”
এই বিলের ১(ক) নং ধারার (১) এবং (২) নং উপধারায় বিশদে বলা হয়েছে কোন কোন ধরণের বনভূমি এবং কী ধরণের প্রকল্পকে উপরোক্ত ছাড়ের আওতায় রাখা হয়েছে। ১ নং উপধারায় ১৯৯৬ সালের আগে শুরু হওয়া সকল প্রকল্প, যা নাকি ‘বনভূমির চরিত্রবদল করেছিল’, তাদের সকলকে এই ছাড়ের আওতায় আনা হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে এই পদক্ষেপকে ঠিক মনে হতে পারে কারণ তা বহুকাল আগেই শুরু হয়ে যাওয়া প্রকল্পগুলিকে বৈধতা প্রদান করছে। কিন্তু আসলে বনের অধিকার আইন পাশ হয়ে যাওয়ার পরে এই সকল বনভূমিই সেই আইনের আওতায় চলে আসে এবং আদিবাসী ও অন্যান্য বনবাসী মানুষের স্বার্থরক্ষার স্বপক্ষে কাজ করে। এমন বহু উদাহরণ আছে যেখানে এই সকল অধিকারকে ১৯৯৬ সালের আগের প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে মান্যতাই দেওয়া হয়নি।
২ নং ধারায় বিভিন্ন ধরণের জমিকে ছাড়ের আওতায় রাখা হয়েছে যার ফলে সমগ্র বনভূমির এক বৃহদংশকেই উপরোক্ত আইনপ্রদত্ত সুরক্ষার বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরকারের তরফে আদিবাসী এবং অন্যান্য পরমম্পরাগতভাবে বনবাসী মানুষের এই বনভূমির উপর সকল অধিকার খর্ব করার চেষ্টা করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, জঙ্গলের সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার অবধি অঞ্চলকে বনসংরক্ষণ আইনের সুরক্ষার থেকে এই ছাড়ের আওতায় আনা হচ্ছে। একাধিক পরিবেশবিদের তরফ থেকে হিসেব করে দেখা হয়েছে যে এই ছাড়ের আওতায় আসতে চলেছে প্রায় ১৩ লক্ষ বর্গকিলোমিটার জমি যা সামগ্রিকভাবে সেই সকল অঞ্চল যার বড় অংশই বনভূমি, তার প্রায় ৪০ শতাংশ। এই ছাড় দেওয়া হয়েছে ‘জাতীয়স্বার্থে কৌশলগতকারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প’ অথবা ‘প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত’ কিংবা ‘জনহিতকারী প্রকল্প’-কে। এখানে নির্দিষ্ট করে কোথাও সরকারের নাম নেই। এর ফলে প্রত্যক্ষভাবে আদিবাসী এবং অন্যান্য বনবাসী মানুষের জীবন-জীবিকার অধিকার খর্ব করা হবে বনের অধিকার আইন এবং বন সংরক্ষণ আইনকে সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করে। এই ছাড়ের আওতায় ‘বৃক্ষ, বাগিচা অথবা বনসৃজন যা নথিভুক্ত সরকারি জমিতে হয়নি’-কে নিয়ে আসা হয়েছে যার ফলে ব্যক্তিমালিকানাধীন বনভূমিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিরোধীদের স্বরও খুব শক্তিশালী হয়ে উঠতে দেখা যায়নি। সে প্রসঙ্গে কুমার রাণা বললেন, “বিরোধীদের মধ্যে একমাত্র রাহুল গান্ধী নিয়মগিরির সময়ে আদিবাসীদের লড়াই সেলিব্রেট করেছিলেন। বাকি বিরোধীরা কেউ করেননি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় কেন্দ্রে বিজেপির সর্বতোভাবে বিরোধীতা করলেও নিজের রাজ্যে দেউচা-পাঁচামি করছেন। সরকারি টাকায় এর প্রচার হয়েছে। অযোধ্যা পাহাড় কাটা হচ্ছে। ঝাড়খন্ডে বিজেপি সরকার যে ছোট নাগপুর পেনিনসুলা অ্যাক্ট ছিল, সেই আইনই বদল করে দিল। সেক্যুলার আন্দোলন সেই কারণেই খুব স্ট্রং হচ্ছে না, কারণ তা শুধু ধর্মকেন্দ্রীক হতে পারে না, এর সঙ্গে যুক্ত সমস্ত মানুষের জীবন। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আদিবাসীদের শিক্ষার যা সমস্যা ছিল তা বহুগুণ বেড়ে যাবে। ডিফরেস্টেশন-এর সঙ্গে আদিবাসীদের সামগ্রিক অনুন্নয়নের আরেকটি যে যোগসূত্র আছে তা হল, যখন জঙ্গল কাটতে যাওয়া হয়, তখন আদিবাসীরা যে বাধা দেন, তা রাষ্ট্র কর্তৃক দমন করতে এত সময় চলে যায় যে, আদিবাসীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির উন্নয়নে সরকার আর সময় পায় না। এটা ঔপনিবেশিক সময় থেকেই হয়ে আসছে। স্বাধীন ভারতের সরকার এটা পরিবর্তন করতে পারতেন। তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন করল না, কিন্তু আদিবাসীদের ঘরবাড়ি, বসত, একটা জনগোষ্ঠীর ইতিহাসকে মুছে দিতে চাইছে।”
ইতিমধ্যে এই আইনের বিরুদ্ধে সচেতন নাগরিক, প্রকৃতিবিদ, পরিবেশবিদ এবং পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতরা প্রতিবাদ করতে শুরু করেছেন। ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছিল পশ্চিমবঙ্গের বনাধিকার ও প্রকৃতি বাঁচাও আদিবাসী মহাসভার সদস্য সৌরভ প্রকৃতিবাদীর সঙ্গে। এই আইন এবং তার প্রভাব নিয়ে তিনি বললেন, “স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন পাহাড়ের মানুষ এবং অরণ্য। তাদের অধিকার রক্ষা, তাদের জীবন ও জীবিকাকে সুরক্ষিত করার জন্য খাতা-কলমে কিছু উদ্যোগ দেখালেও তা পূরণ হয়নি সঠিকভাবে। বিভিন্ন সরকার তাদের শাসনকালে ভিন্ন ভিন্ন কর্পোরেটদের সাহায্য করে গিয়েছেন। বর্তমান সরকারও একই পথে হাঁটছেন এবং বলা যায় অন্য সরকারের তুলনায় বেসরকারি হাতে জঙ্গল-জমিকে তুলে দেওয়ার কাজ সবচেয়ে বেশি এই সরকারই করেছে। আমরা এর বিরুদ্ধে নিয়মিত জনমত গঠনের চেষ্টা করছি এবং পাহাড়ের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে জানাচ্ছি যাতে এই আন্দোলন জারি থাকে। অন্যদিকে এই আইন তৈরির আগে থেকেই বনাঞ্চল ধ্বংস করে ইকো-ট্যুরিজমের নামে প্রচুর রিসর্ট গড়ে উঠেছে যারা প্রধানত পরিবেশকে নোংরা করছে এবং অরণ্যের স্বাভাবিকতাকে নষ্ট করছে। আমরা স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিলে এইরকম কিছু বেআইনি রিসর্টকে বাধ্য করেছি তাদের কাজকর্মকে বন্ধ করার জন্য।”
এর সঙ্গে ভারতীয় আদিবাসী ভূমিসমাজ, পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী কল্যাণ সমিতি (পুরুলিয়া), দেউচা পাঁচামি গ্রামসভা সমন্বয় কমিটি, উত্তরবঙ্গ বনজন শ্রমজীবী মঞ্চগুলি আলাদাভাবে বা একসঙ্গে এই আইনের বিরোধিতায় নেমেছে। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি দেশের নানান জায়গায় এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন রাজনৈতিক কর্মী এবং সাধারণ মানুষেরা। এক সর্বভারতীয় অনলাইন সংসবাদ মাধ্যমে, আরাভল্লি বাঁচাও নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম সদস্য নীলম আলোয়ালিয়ার বলেছেন, “অনুমান করা হচ্ছে যে প্রায় ৩৯০৬৩ হেক্টর বন সমগ্র ভারত জুড়ে সেক্রেড গ্রোভের অধীনে রয়েছে যা স্থানীয় সম্প্রদায়গুলো সুরক্ষিত করে রেখেছেন এবং তারাই এর পরিচালনা করছেন। বন সংরক্ষণ সংশোধনী বিলটি চারটি রাজ্য এবং দেশের বাকি অংশ জুড়ে বিস্তৃত ৬৯০ কিলোমিটার আরাবল্লি রেঞ্জ জুড়ে জমিগুলিকে ধ্বংস করবে। এছাড়াও, হরিয়ানা আরাবল্লিসের ৫০০০০ একর এলাকা অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে কারণ এই বনগুলিকে এখনও 'ডিমড ফরেস্ট' হিসাবে ঘোষণা করা হয়নি।”
ফারাই দিওয়ান প্যাটেল, একজন পরিবেশবিদ এবং সেভ মোল্লেম টিমের পরিবেশ কর্মী, তিনিও এক সর্বভারতীণ অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, “গোয়ার সালসেতে রাইয়া গ্রামের যুবকরা তাদের গ্রামের একটি ঝরনাকে কেন্দ্র করে সেখানে প্রতিবাদ করেছিল। কারণ যদি এই নতুন সংশোধনী বিল পাশ হয়, তাতে ঝরনাটির ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে যাবে।”
ভারতের বন জরিপের ২০২১ সালের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে সামগ্রিক ভূখন্ডের মাত্র ২১.৭ শতাংশ বনাঞ্চল এবং ২.৯ শতাংশ ভূখন্ড বৃক্ষ আচ্ছাদনের আওতায় রয়েছে যা সব মিলিয়ে মোট ২৪.৭ শতাংশ হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এই ২৪.৭ শতাংশও আদতে চা বাগান, ফল বাগিচা এবং মরুভূমির কিছুটা গাছপালাকে হিসেবের মধ্যে ধরে তবে পাওয়া যাচ্ছে, অর্থাৎ সত্যিকারের বনভূমির পরিমাণ এই ২৪.৭ শতাংশের চেয়েও কম। ভারত সরকারের ‘গ্রীন মিশন’-এর এস্টিমেটস কমিটি তাদের ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের রিপোর্টে জানিয়েছিল যে “আমাদের কার্বন সঞ্চয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আরো ৩ কোটি হেক্টর বনভূমির প্রয়োজন।” বনসৃজনের বেশিরভাগ কর্মসূচীই গ্রহণ করা হচ্ছে আদিবাসী এবং উপজাতিভুক্ত মানুষের জমিতে। এই সকল মানুষের অধিকারকে সুরক্ষিত করার পরিবর্তে তাদেরই জমি সরকারিভাবে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে নতুন করে বৃক্ষরোপনের জন্য।
ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহল সংগঠনের সদস্য নকুল চন্দ্র বাস্কে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভয়েস অফ আমেরিকা-কে জানান, “এই বিলটি পাশ হওয়ার সাথে সাথেই আমরা এর প্রতিবাদ করতে শুরু করি। পূর্বে আদিবাসী ও জঙ্গলবাসীদের বসবাসের জন্য যে আইন ছিল, নতুন সংশোধিত আইনে তা সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বিলটি আসার পরেই আমরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে অভিযোগ জানিয়েছি এবং সাধারণ মানুষের সাথে কথাবার্তা বলে আন্দোলন চালাচ্ছি। আগামী ১২ অগাস্ট আমরা এই বিলের বিরুদ্ধে কর্মসূচিউ গ্রহণ করেছি।”
ভয়েস অফ আমেরিকা-কে পশ্চিমবঙ্গের অযোধ্যা পাহাড়ে প্রকৃতি বাঁচাও ও আদিবাসী মহাসভার সদস্য সুপেন হেমব্রম জানালেন, “জল-জঙ্গল ও জমির লড়াই আমাদের দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। প্রাণ ও প্রকৃতিকে নষ্ট করার বিরুদ্ধে অযোধ্যায় আমরা লড়াই করছি প্রায় অনেক দিন। গ্রামসভা আইনটিকে ঠিকঠাকভাবে রূপায়ণ করা হলে এই নতুন আইনটিকে রোধ করা সম্ভব। নতুন আইনটি মূলত জঙ্গল ও জঙ্গলের মানুষদের ধ্বংস করে দেওয়ার আইন। আমরা ইতিমধ্যে মানুষের সাথে মিলে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। ৯ অগাস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস। আমরা অযোধ্যা পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় সভা করব।”