বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলার ব্যাপক অঞ্চল নিমজ্জিত হয়েছে। জলবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ। অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে বিভিন্ন এলাকায় ভূমিধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সাগরে মৌসুমিবাযু সক্রিয় থাকায় সমুদ্রবন্দর গুলোতে সতর্ক সংকেত অব্যাহত রয়েছে। তবে, আবহাওয়া দপ্তর বলেছে, মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) সকাল ৯টা থেকে শুরু করে পরবর্তী ৭২ ঘন্টায়, বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত কমতে পারে।
কক্সবাজার জেলায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দী
টানা বৃষ্টি, জোয়ারের পানি ও পাহাড়ি ঢলে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার ১৫টি ইউনিয়নের ২ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে, চকরিয়া উপজেলার ১২টি ও ঈদগাঁও উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন। এছাড়া, কম-বেশি প্রতিটি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে।
এদিকে, মেরিন ড্রাইভ, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টসহ উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আবহাওয়ার অফিস।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের আঞ্চলিক কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা দুলাল চন্দ্র দাশ জানান, “জেলায় রবিবার (৬ আগস্ট) বিকাল ৩টা থেকে সোমবার (৭ আগস্ট) বিকাল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১০৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এরমধ্যে সোমবার সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ৮১ মিলিমিটার।” আগামী তিনদিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
জানা গেছে, বৃষ্টি, জোয়ারের পানি এবং পাহাড়ি ঢলে চকরিয়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে মানুষ। চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী জানান, “পাহাড়ি ঢলে মাতামুহুরি নদীতে ভেসে আসা কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে রশিদ নামের এক যুবক নিখোঁজ হন। দুপুর ১টার দিকে নিখোঁজ যুবকের মরদেহ বিকাল ৩টার দিকে নদীর লক্ষ্যরচর মোহনা থেকে উদ্ধার করা হয়।”
তিনি আরো জানান, “পাবর্ত্য এলাকা ও চকরিয়া থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে আসায়, মাতামুহুরী নদীতে প্লাবন দেখা দিয়েছে। পাহাড়ি ঢল, বৃষ্টি ও জোয়ারের ঢেউয়ে বাঁধ ভেঙে বিভিন্ন ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে।”
চকরিয়ার একটি পৌরসভা ও ১৮ টি ইউনিয়নের মধ্যে পৌরসভাসহ ১২ ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। এর মধ্যে, ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়েছে কাকড়া, লক্ষ্যরচর, বুমুবিল ছড়ি, সুরেজপুর-মানিকপুর, কৈয়ারবিল, কোনাখালী ইউনিয়ন।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান জানান, “১২টি ইউনিয়নের ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি প্রবেশ করায়, নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মাতামুহুরী নদীতে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। প্লাবিত এলাকার লোকজনকে সরকারি সহায়তা দেয়া শুরু হয়েছে। প্লাবিত এলাকার লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হচ্ছে।”
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানান, “টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে উপকূলীয় ও কিছু পাহাড়ি অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে চকরিয়া এবং পেকুয়ায় বেশি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার পানিবন্দী মানুষদের নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে। ইতোমধ্যে চকরিয়ায় ৭ হাজার এবং পেকুয়ায় ২০ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন।”
এদিকে, সামুদ্রিক জোয়ারের ঢেউয়ে মেরিন ড্রাইভ, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা পয়েন্ট, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। মেরিন ড্রাইভের কিছু অংশে জিও ব্যাগে বালির বাঁধ তৈরি করে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।
ফেনীর ৮ গ্রাম প্লাবিত
ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ফেনীতে মুহুরী নদীর পানি বিপদ সীমার ১০০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে অন্তত ৮ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ২০০ শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। প্রায় ১২০ সেক্টর রোপা আমান এবং ১০ হেক্টর বীজতলা তলিয়ে গেছে।
সোমবার (৭ আগস্ট) ২৪ ঘণ্টায় ফেনী জেলায় ১৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (ফুলগাজী-পরশুরাম) মো. মনির আহমেদ জানান, “সোমবার সকাল ৯টায় ফুলগাজী ও পরশুরামে মুহুরী নদী বিপদ সীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো।” চলতি বর্ষা মৌসুমে মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া তিন নদীর বেড়িবাঁধের ২০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। ইতিমধ্যে মুহুরী নদীর ফুলগাজী উপজেলার উত্তর দৌলতপুর ও উত্তর বরইয়া অংশে অন্তত ১০ মিটার করে ২০ মিটার ভেঙে গেছে।”
ফুলগাজী সদর উপজেলার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার (সদস্য) জামাল উদ্দিন বলেন, “মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের দুটি স্থান ভেঙে উত্তর বরইয়া, বিজয়পুর, কিসমত বিজয়পুর, দক্ষিণ বরইয়া, জগৎপুর, উত্তর দৌলতপুর, দক্ষিণ দৌলতপুর, বনিকপাড়াসহ অন্তত ৮ গ্রামের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।ঘর-বাড়ি তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে শত শত মানুষ।
উত্তর বরইয়া গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, “পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির কারণে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভেঙে পানিতে তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। আমাদের কান্না কেউ শুনতে পায় না। সকালে হঠাৎ করে বাড়িতে পানি ঢুকে পড়ে। ঘরে হাঁটু পরিমাণ পানি।”
ফুলগাজী উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি অফিসার কে এইচ এম মনজুরুল ইসলাম বলেন, “এ বন্যায় ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় প্রায় ১২০ সেক্টর রোপা আমান এবং ১০ হেক্টর বীজতলা পানির নিচে রয়েছে। এছাড়া সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। এখনো ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ হয়নি।” ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া ভূইয়া ২০০ শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আরিফুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, “ নদীতে পানির প্রবাহ কিছুটা কমলে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা হবে।”
নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদ শাহরিয়ার জানান, “মুহুরী-কহুয়া-সিলোনীয়া নদ-নদীর দু'পাশে ১২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। বাঁধের যে কয়েকটি স্থান ভেঙেছে, পানি নেমে গেলে মেরামত করা হবে।”
ফেনী জেলা প্রশাসক মোছাম্মদ শাহীনা আক্তার বলেন, “জেলা প্রশাসন নিয়মিত মনিটর করছে; বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। প্রাথমিকভাবে তাদের জন্য ২ লাখ টাকা ও সাড়ে তিন মেট্রিক টন চাউল বরাদ্দ দিয়েছি। পানিবন্দি মানুষের জন্য শুকনো খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
দীঘিনালা-লংগদু সড়ক যোগাযোগ বন্ধ