২২ বছর বয়সী ইরানী তরুণী মাহসা আমিনির পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ১০ মাস পর, তার মৃত্যুর ব্যাপারে তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি করতে, ইরানি কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার নিন্দা করেছেন জাতিসংঘের তদন্তকারীরা। ইরানের তথাকথিত নৈতিকতা পুলিশ, হিজাব বা হেড স্কার্ফ দিয়ে সঠিকভাবে চুল ঢেকে না রাখার অভিযোগে আমিনিকে গ্রেপ্তার করেছিল।
ইরানের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের চেয়ারপার্সন সারা হোসেন বলেছেন, "দশ মাস পরও... আমিনির পরিবারের সত্য ও ন্যায়ের অধিকার প্রাপ্তি অপূর্ণই রয়ে গেছে।"
"আমরা উদ্বিগ্ন যে, অভ্যন্তরীণ তদন্তগুলিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের নিয়ম এবং মানগুলির মধ্যে ঘাটতি রয়েছে। যার মধ্যে তাত্ক্ষণিকতা, স্বাধীনতা এবং স্বচ্ছতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।"
১৬ সেপ্টেম্বর আমিনির মৃত্যুর পর শুরু হওয়া বিক্ষোভের সাথে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তের জন্য, তিন সদস্যের মিশন গত ২৪ নভেম্বর, ২০২২ সালে গঠিত হয়। মিশনটি , বিশেষত নারী ও মেয়েদের সম্মান সম্পর্কিত প্রথম মৌখিক আপডেটটি, বুধবার জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের কাছে উপস্থাপন করেছে।
যদিও ইরানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলি আর বিশ্ব মিডিয়ার মনোযোগে তেমন প্রাধান্য পায় না।প্যানেল বলছে, দেশটির পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে। এতে বলা হয়, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক, যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা, নির্যাতন, জোরপূর্বক গুম এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের মৃত্যুর খবর শোনা ও পাওয়া যাচ্ছে।
হোসেন উল্লেখ করেছেন, ইরান সরকারের ঘোষণা যে তারা বিক্ষোভের সাথে জড়িত ২২,০০০ লোককে ক্ষমা করেছে, এটা "ইঙ্গিত করে, আরও অনেককে আটক করা হয়েছে কিংবা অভিযুক্ত করা হয়েছে।"
ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন বলেছে, আটকে থাকা বাকিদের মধ্যে অন্তত ১৭ জন সাংবাদিক তাদের বিক্ষোভের প্রতিবেদন করার জন্য এবং বিক্ষোভকারীদের রক্ষাকারী অনেক মানবাধিকার আইনজীবী এবং অন্যান্য আইনজীবীরা রয়েছেন। এতে আরও বলা হয়, যেসব নারী ও মেয়েরা দেশের জোরপূর্বক পর্দাপ্রথার আইন মেনে চলতে অস্বীকার করে, তাদের গ্রেফতার ও আটক করা হচ্ছে এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে সংরক্ষিত অধিকার প্রয়োগের জন্য প্রতিবাদকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
নভেম্বর থেকে, এ পর্যন্ত অন্তত ২৬ জন ব্যক্তিকে বিক্ষোভের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে এবং আরও কয়েক ডজন মৃত্যুদণ্ড যোগ্য অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে বা তার মুখোমুখি হয়েছে৷
তিনি বলেন, "সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে নির্যাতনের মাধ্যমে নেওয়া ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তিসহ ন্যায্য বিচার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগের মধ্যেই , তাড়াহুড়ো করে বিচারের পর সাতজনের মৃত্যুদন্ড ইতোমধ্যেই কার্যকর করা হয়েছে।"
তদন্তকারীরা ইরানি কর্তৃপক্ষকে ফাঁসি বন্ধ করার জন্য এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশে তাদের বৈধ অধিকার প্রয়োগ করার জন্য ও বিক্ষোভের রিপোর্ট করার অভিযোগে আটক সকলকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্যানেলটি বিবেচনাধীন দুটি খসড়া প্রস্তাবের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা "জোর করে পর্দা করার বিধান লঙ্ঘনের জন্য" নারী ও মেয়েদের শাস্তি বাড়াবে। আইন করা হলে, তারা সতর্ক করে দিয়েছে "এই সব প্রস্তাব নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, হয়রানি এবং নির্বিচারে আটকে রাখা এবং প্রবেশের বৈষম্যের ঝুঁকি বাড়াবে।"
ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের সদস্য শাহীন সরদার বলেন, "হিজাব আইন আরও কঠোর হতে চলেছে... সঠিকভাবে হিজাব না পরা একটি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এর জন্য আরও কঠিন শাস্তি হবে।"
চেয়ারপারসন হোসেন বলেন, মিশন বারবার কর্তৃপক্ষের কাছে ইরান সফরের অনুমতি চেয়েছে, যাতে তদন্তের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা যায়। তিনি বলেন, মিশন সরকারী কর্মকর্তা এবং সরকারী কর্তৃপক্ষসহ বিক্ষোভ দ্বারা প্রভাবিত বা জড়িতদের সাথে সরাসরি দেখা করা এবং তাদের কথা শোনা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে।
তিনি বলেন, "তবে, আমরা এখনও দেশে তথ্য এবং অবাধ প্রবেশাধিকারের জন্য আমাদের অনুরোধের সাড়া পাইনি।"
গত সেপ্টেম্বরের দেশব্যাপী বিক্ষোভকারীরা যে "নিছক সহজ এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ" করেছিলেন তদন্তকারীদের এমন বর্ণনাকে ইরান নাকচ করে দিয়েছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের হাই কাউন্সিল ফর হিউম্যান রাইটস এর মহাসচিব কাজেম গারিব এবাদি কাউন্সিলকে বলেছেন, "বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ দাঙ্গা উস্কে দেওয়ার সাথে জড়িত ছিল।
তিনি অভিযোগ করেন, "সন্ত্রাসীরাও ঘটনাস্থলে প্রবেশ করেছিল এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত প্রায় ১০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। দাঙ্গার সময় ৮,০০০ টিরও বেশি অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়, এবং ৭৫ জনের বেশি আইন প্রয়োগকারী বাহিনীসহ সাধারণ মানুষ দাঙ্গাকারীদের হাতে শহীদ হয়েছিল।"
তদন্তকারীরা তাদের দিক থেকে, ইরানের সরকারকে তাদের আদেশের সাথে সহযোগিতা করার জন্য এবং ক্ষতিগ্রস্ত সকলের "প্রমাণ প্রদানে বাধাহীন এবং নিরাপদ সুবিধা আছে" তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। তারা আরও বলেছে, ইরানকে অবশ্যই প্রতিবাদের সাথে সম্পর্কিত অপরাধের জন্য দায়ীদের বিচার করতে ও উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে এবং সমস্ত ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন ২০২৪ সালের মার্চের অধিবেশনে কাউন্সিলের কাছে তাদের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে।