দাঙ্গার ৪র্থ রাতে ফরাসি পুলিশের সাথে যুবকদের সংঘর্ষ; ১৩০০ গ্রেফতার

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের শহরতলিতে পুলিশের গুলিতে নিহত ১৭ বছর বয়সী নাহেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চলমান বিক্ষোভের তৃতীয় রাতে একটি রাস্তা পরিষ্কার করেছে পুলিশ। ৩০ জুন, ২০২৩।

বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও, চতুর্থ রাতে ফ্রান্সের আশেপাশের শহরগুলিতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়, গাড়ি ও ভবনে অগ্নি সংযোগ এবং দোকান লুটপাট করা হয়। শনিবার পুলিশের গুলিতে নিহত ১৭ বছর বয়সী নাহেলের কবর দেওয়ার জন্য তার পরিবার এবং বন্ধুরা যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেই সময় শহর জুড়ে অশান্তির আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

সরকার বলছে, কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে সহিংসতা কমতে শুরু করেছে, কিন্তু ক্ষয় ক্ষতি এখনো ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে। প্যারিস থেকে মার্সেই এবং লিয়ন এবং ফরাসি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলিতেও বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। ফরাসি গায়ানায় বুলেটের আঘাতে ৫৪ বছর বয়সী একজন বিক্ষোভকারী মারা যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ঘোষণা করেছে, শনিবার ভোরে ফ্রান্সের আশেপাশে ১,৩০০ জনেরও বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশের গুলিতে নাহেলের (যার শেষ নাম প্রকাশ্যে আসেনি), মৃত্যুর আগেও দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং বর্ণবৈষম্যের সাথে লড়াই করে এমন আবাসন প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত তরুণ এবং পুলিশের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে উত্তেজনা চলে আসছে। কিন্তু চলমান এই দাঙ্গাটি কয়েক বছরের মধ্যে ফ্রান্সের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা এবং প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর উপর নতুন চাপ সৃষ্টি করেছে। ম্যাক্রোঁ বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের রাস্তার বাইরে রাখার আবেদন জানানএবং সহিংসতায় ইন্ধন যোগানোর জন্য সামাজিক মাধ্যমকে দোষারোপ করেন।

শনিবার নাহেলের পরিবার এবং বন্ধুরা তার নিজ শহর নান্তেরে একটি অন্ত্যেষ্টি সভার আয়োজন করছিল। মঙ্গলবার সেখানে তার মৃত্যুর পর, প্যারিসের শহরতলিতে ক্ষোভ দেখা দেয় এবং অতি দ্রুত তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলেছে, শুক্রবার রাতে এবং শনিবার ভোরে ২,৫০০ টিরও বেশি জায়গায় অগ্নি সংযোগ করা হয়। এ সময় ১,৩০০ জনেরও বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগের রাতে, দেশব্যাপী ৯১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। শহর জুড়ে ৫০০টি ভবনকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়, ২,০০০ গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং কয়েক ডজন দোকান-পাট ভাংচুর করা হয়।

যদিও রাতভর গ্রেপ্তারের সংখ্যা এখনও সর্বোচ্চ ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মতে, ফ্রান্সের আশেপাশে আগের রাতের তুলনায় কম অগ্নি সংযোগ, গাড়ি পোড়ানো এবং থানায় হামলা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমানিন বলেছেন, সহিংসতা "তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম" ছিল।

সারা রাত ধরে চলা সংঘর্ষে ৭৯ জন বিক্ষোভকারীসহ শত শত পুলিশ এবং দমকলকর্মী আহত হয়েছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ ঠিক কতজন বিক্ষোভকারী আহত হয়েছে, সেই সংখ্যা প্রকাশ করেনি। ন্যান্টেরের মেয়র প্যাট্রিক জ্যারি বলেছেন, ফ্রান্সকে সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় "পরিবর্তনের জন্য চাপ" দিতে হবে।

ক্রমবর্ধমান সঙ্কটের মুখে যে শত শত লোককে গ্রেপ্তার এবং ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তা সত্ত্বেও ম্যাক্রঁ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা থেকে বিরত ছিলেন,তবে ২০০৫ সালে একই পরিস্থিতিতে এই বিকল্পটি ব্যবহার করা হয়েছিল।

এর পরিবর্তে, তার সরকার আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের সংখ্যা বাড়িয়েছে। ৪৫,০০০ পুলিশ রাতারাতি মোতায়েন করা হয়েছে, এছাড়া ছুটিতে থাকা কয়েকজনকে ফেরত নিয়ে আসা হয়েছে।

প্যারিস এবং অন্যান্য ফরাসি শহরগুলি গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসের জন্য ১০,৫০০ অলিম্পিয়ান এবং লক্ষাধিক দর্শকের আয়োজক হওয়ার ঠিক এক বছরের কিছু আগে এই সহিংসতা ঘটে। অলিম্পিকের প্রস্তুতি অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।

নাহেলকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় হত্যার প্রাথমিক অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রাথমিক অভিযোগের অর্থ হলো তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেটরা অন্যায় করা হয়েছে বলে দৃঢ়ভাবে মনে করেন, তবে মামলাটি বিচারে পাঠানোর আগে আরও তদন্ত করতে হবে। নান্টেরের প্রসিকিউটর প্যাসকেল প্রাচে বলেছেন, প্রাথমিক তদন্তে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ওই অফিসারের অস্ত্র ব্যবহার আইনত ন্যায়সঙ্গত ছিল না।

নাহেলের মা, মৌনিয়া এম, ফ্রান্স ফাইভ টেলিভিশনকে বলেছেন, তিনি কেবল ওই অফিসারের উপর রাগান্বিত ছিলেন, সব পুলিশের উপর নয়।

তিনি বলেন, "একজন পুলিশ অফিসার তার বন্দুক উঁচিয়ে আমাদের শিশুদের উপর গুলি চালাতে পারে না, আমাদের শিশুদের জীবন কেড়ে নিতে পারে না।" পরিবারটি আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত।

ফ্রান্সে কয়েক দশক ধরে বর্ণ বৈষম্য একটি নিষিদ্ধ বিষয় ছিল, যা আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ণান্ধ সর্বজনীনতার মতবাদের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু, নাহেলের হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে, ফরাসি বর্ণবাদ বিরোধী কর্মীরা পুলিশের আচরণ সম্পর্কে নতুন করে অভিযোগ করেছেন।

গত বছর ট্রাফিক স্টপ না মানায়, তেরো জনকে গুলি করে হত্যা করেছিল ফরাসি পুলিশ। এ বছর একই পরিস্থিতিতে নাহেলসহ আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যুগুলি ফ্রান্সে আরও জবাবদিহিতার দাবিকে প্ররোচিত করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার পর বর্ণবৈষম্যের ন্যায়বিচার চেয়ে প্রতিবাদের অনুরূপ।