এবারের ঈদে আরামদায়ক হবে যেসব পোশাক

এবারের ঈদে আরামদায়ক হবে যেসব পোশাক।

গ্রীষ্মকাল চলে গেলেও গরমটা যেনো রয়েই গেছে বাংলাদেশের আবহাওয়ায়। মাঝেমাঝে এক পশলা বৃষ্টি হলেও তাপমাত্রার আধিক্য, আর্দ্রতার কারণে অসহনীয় গরম ও প্রচুর ঘাম হয় এই মৌসুমে। তাই এ সময়ের জন্য আরামদায়ক ও ঘাম শোষণ করে এ ধরণের ঢিলেঢালা পোশাক খুব স্বস্তিদায়ক। তাছাড়া ঈদ-উল-আযহাও দোরগোড়ায়। তাই স্টাইল এবং আরাম দুটোকেই প্রাধান্য দিয়ে পোশাক তৈরি করার সময়ে এবারের পোশাকের ডিজাইনে আরামদায়ক কাপড়, হালকা রং ও কাটের দিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন ফ্যাশন ডিজাইনাররা। এছাড়া ড্রেসের নেকলাইন, স্লিভ, বটমের বিভিন্ন প্যাটার্ন এবং ডিজাইনে নতুনত্ব আনছেন।

পোশাকের ধারণায় এসেছে পরিবর্তন

কয়েক বছর আগেও নারী-পুরুষ উভয়ের পোশাকের ক্ষেত্রেই ফিটেড বা আঁটোসাঁটো পোশাকের চল ছিলো। মেয়েদের পোশাকে বডি ফিটেড, লং গাউন টাইপের পোশাক, ছেলেদের ক্ষেত্রে স্লিম ফিট শার্ট-পাঞ্জাবির চল ছিলো ট্রেন্ডি। কিন্তু এবার যেনো সারা বিশ্বেই পোশাকের ট্রেন্ড বদলাতে শুরু করেছে। সত্তর দশকের ঢিলেঢালা পোশাকের চল আবার ফিরে আসতে চলেছে। ফ্যাশন হাউজ ‘সেইলর’-এর সিনিয়র ডিজাইনার শায়লা শারমিন নূর, ভয়েস অফ আমেরিকা-কে বলেন, “যেহেতু গত দুই বছর ধরে অতিরিক্ত গরম পড়ছে, সে কারণে পুরো বিশ্ব জুড়েই লুজ ফিটেড প্যাটার্নের পোশাকের ট্রেন্ড চলছে। এ ধরনের পোশাক দেখতে ওভারসাইজ লাগতে পারে কিন্তু এটাই আসলে এখন ট্রেন্ডি ফ্যাশন। লুজ ফিটেড পোশাক আরামদায়ক হয়। বিশ্বের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ডিজাইনার এ ধরণের পোশাক গত দুই বছর থেকেই তৈরি করছেন। এবার বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ডিজাইনাররা এই প্যাটার্ন ফলো করছেন। সাধারণত পোশাকের ফিটিং নিয়ে আমরা বাংলাদেশী ডিজাইনাররা কম কাজ করি। তবে এবার ইন্টারন্যাশনালি এটা খুব ডমিনেট করছে তাই আমরাও পোশাকের ক্ষেত্রে লুজ ফিটেড ফ্যাশনটা ফলো করছি।” শায়লা শারমিন জানালেন পোশাকের কাট ও প্যাটার্নের ক্ষেত্রে তাদের ফ্যাশন হাউজ কিছু পরিবর্তন এনেছেন। বললেন, “আগে শোল্ডার জয়েন্ট হতো। এখন ড্রপ শোল্ডার অর্থাৎ টি-শার্ট, পোলো শার্ট কিংবা ক্যাজুয়াল লুকের পোশাকের ক্ষেত্রে স্লিভের যে রাউন্ডটা আগে ফলো করা হতো সেখান থেকে কমপক্ষে ২-৩ ইঞ্চি বেশি করে রাউন্ড করে যতটা ঢিলেঢালা করা যায় তা করা হচ্ছে।”

ফ্যাশন হাউস ‘লা রিভ’-এর ডিজাইনার মারুফা ইয়াসমিন জানালেন, ফ্যাশন হাউজটি এবার ‘বিলঙ্গিং’ বা ‘সংযুক্তি’ শিরোনামের থিম নিয়ে কাজ করছে। মারুফা বলেন, “বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে এখন হিলিং বা শারীরিক-মানসিক-আত্মিক উন্নয়নের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। হিলিং পাওয়ার বলতে বোঝায় সব কিছুর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া। আর এই শক্তির উৎস অনেক। সেটা হতে পারে পরিবার, পরিবেশ, প্রকৃতি, মহাজাগতিক ও আধ্যাত্মিক প্রাণশক্তি। নিজেকে এ সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত করতে পারা হিলিং-এর একটি অংশ। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই আমরা এবারের সামার-এর এবং ঈদের কালেকশনটাকে সাজিয়েছি। নারী, পুরুষ, শিশুদের পোশাকের কালেকশনে আমরা এই থিমটাকে মাথায় রেখে ডিজাইন করেছি।”

গ্রীষ্মকালীন রং মিশেছে উৎসবের পোশাকেও

মারুফা জানালেন তাদের ব্র্যান্ড এবার থিমের সঙ্গে মিল রেখেই পোশাকের কালার প্যালেট নির্বাচন করেছে। কালারের মধ্যে কিছু কসমিক শেড ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ওয়াটার মার্ককে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এর পাশপাশি ইন্ডিগো, ডার্ক অলিভ, পাউডার ব্লু, ওয়াইন রেড, বার্গেন্ডি, ভার্মিলন, ডাস্টি রোজ, পিচ, বেবি পিংক, গ্রাউন্ডেড ব্রোঞ্জ আর সোনালী রংয়ের একটা ইফেক্ট তাদের কালেকশনে বেশি দেখা যাবে।

শায়লা শারমিন জানালেন, “গ্রীষ্মকালে সবসময় স্মুদ ও সফিস্টিকেটেড কালারগুলোর ব্যবহার হয়। এবারের ট্রেন্ডের যে কালারগুলো আমরা ফলো করছি সেগুলো হল লাইট ল্যাভেন্ডার, লাইট অলিভ ও একদম লাইট গোল্ডেন শেড। এই তিনটা কালারই মূলত সামারের কালার। এ কালারগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের ড্রেসের কালারগুলোকে এবার হাইলাইট করা হয়েছে। এছাড়াও মাল্টিকালারের কালেকশন থাকছে সব জায়গায়। তবে বেশিরভাগ কালার হচ্ছে লাইট কালারগুলো।”

ফ্যাশন ডিজাইনার শেখ সালাউদ্দিন সমীরণ ভয়েস অফ আমেরিকা-কে বললেন, গরমে জমকালো রং থেকে সরে এসে হালকা রংকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। যেমন লাইট প্যাস্টাল, এ্যাকোয়া, সী গ্রীন, লাইট পিংক, লাইট ইয়েলো, লেমন ইয়েলো এগুলো আই সুদিং বা চোখের পক্ষে আরামদায়ক হয়। তবে তিনি মনে করেন, আমাদের দেশে (বাংলাদেশ) পোশাকের ক্ষেত্রে উৎসবকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয় সেটা যে সিজনেই হোক না কেনো। তাই উৎসব থাকলে গ্রীষ্মেও চড়া রঙগুলো ব্যবহার হয়। তিনি বলেন, “পোশাকের ক্ষেত্রে সিজনকে প্রাধান্য দিয়ে সেই সিজনের একটি রংকে বেস করে ফ্যাশন গড়ে ওঠার চল এখনও আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি।”

আরামের জন্য সুতি কাপড়েই থাকছে নির্ভরতা

এবারের ঈদে আরামদায়ক হবে যেসব পোশাক।

সুতি কাপড়ের ঘাম শোষনের ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। পরতে আরামদায়ক। নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবার পোশাকেই সমান কদর সুতি কাপড়ের। গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতে প্রধান ফেব্রিক হিসেবে সুতি বা কটন তাই জনপ্রিয়। সে কারণে ডিজাইনাররাও পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখেন কটনের ওপর। কটন, রেয়ন, নীট ফেব্রিকস, দেশী তাঁত কাপড়কে গরমের জন্য আরামদায়ক বলছেন ফ্যাশন ডিজাইনাররা। পাশাপাশি ঈদ-উল-আযহার কথা ভেবে সফট সিল্ক, লিনেন, ক্রেপ সিল্ক, বিসকস, সুতি, তাঁত, এ্যান্ডি কটন, এ্যান্ডি কটন, মসলিন, জর্জেট কাপড়ও ব্যবহার করছেন পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে। সমীরণের মতে, গরমে সুতি কাপড়টাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। এছাড়া যেহেতু ঈদ তাই, লিনেন, তাঁত ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, “ঈদ বা যে কোনো উৎসবে আরামদায়ক পোশাকের পাশাপাশি মানুষ কিছুটা জমকালো পোশাকও পরে। ফেব্রিক অনুযায়ী এসব পোশাকে কারচুপি, এম্ব্রোয়ডারি, হ্যান্ড স্টিচ, হ্যান্ড পেইন্ট ইত্যাদি ব্যবহারে এক্সক্লুসিভ করা হয়।”

সেইলর-এর এবারের কালেকশন নিয়ে শায়লা জানালেন, “সামার-এ যেহেতু আমরা কটন ও রেয়নকে প্রেফার করি সে কারণে সামার-এআমরা পার্টি লুকের বা খুব গর্জিয়াস কোন পোশাক করছি না। এছাড়া সামার-এ সব সময় স্ক্রিন প্রিন্ট, খুবই লাইট হ্যান্ড এমব্রয়ডারি এ ধরনের কাজই আমরা করে থাকি। চাকরিজীবী মহিলাদের জন্য আমরা একদমই কটন কিছু টু-পিস এবং থ্রি পিসের কালেকশন করেছি। যথারীতি ওগুলোর প্যাটার্ন হচ্ছে লুজ ফিটেড। শিশুদের জন্য নিট ফেব্রিকসের ড্রেস রেখেছি। নিটেড টি শার্ট, টপস, লং ফ্রকও করেছি। জেন্টসদের জন্য নতুন আইটেম হলো ক্যাজুয়াল শার্ট। এটা সামার বেসড করা হয়। হাল্কা রঙের ওপর অলওভার প্রিন্ট দিয়ে কিছু কাজ করা হয়েছে।” মারুফা জানালেন, লা রিভ-এর কালেকশনে স্ক্রিন প্রিন্ট বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া এবার রংকে প্রাধান্য দিয়ে মিরাজ পেইন্টিং, মার্স ইন্সপিরেশন পেইন্টিং, চেক, স্ট্রাইপ, ফ্লোরাল প্রিন্ট ব্যবহার করেছেন তাঁরা। পোশাকগুলোতে কারচুপি, এম্ব্রোয়ডারি ও কিছু হ্যান্ডস্টিচের ব্যবহার হয়েছে।

পোশাকের কাট ও প্যাটার্নেও এসেছে বৈচিত্র

ডিজাইনার শায়লা জানালেন পোশাকের নেক লাইনের ক্ষেত্রে এখন পরিবর্তন আনা হয়েছে। তিনি জানালেন, আগে বাংলাদেশের ডিজাইনাররা নেক লাইন নিয়ে খুব কম কাজ করতেন। গত বছর থেকে তাঁরা পোশাকের নেক লাইনটা যাতে কমফোর্টেবল হয়, কিন্তু দৃষ্টিকটু না হয় সেরকম রাখার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, “এর আগে কয়েক বছর ধরে আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে বোট নেক, হাইনেক, রাউন্ড নেক ফ্যাশন খুব চলছিল। এবার আমরা নেকের ডিজাইনে ভেরিয়েশন এনেছি। ঢিলেঢালা টাইপের ভি নেক, আঙ্গারাখা নেক এ ধরনের নেক পোশাকে আমরা ব্যবহার করছি।”

মারুফা জানালেন তাঁরা প্যাটার্ন ও কাটের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন অঙ্গনের সাথে মিল রেখে শল, কিহোল নেক, বিশপ স্লিভস, বিলো-নি হেমলাইন ও গাউন লেংথকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। এর পাশাপাশি ফ্লেয়ার, লেয়ার, গ্যাদারিং, স্মোকিং এসব স্লিভের কাজ করা হয়েছে। গরমের কথা মাথায় রেখে কাফতান কাট-ও রাখা হয়েছে। তিনি মনে করেন, নারীদের জন্য কিমানো স্লিভ ও কাফতান প্যাটার্নের টিউনিক গরমে বেশি আরামদায়ক। পুরুষের জন্য গরমের উপযোগী পোশাক কটনের ফতুয়া ও কমফোর্ট শার্ট, শর্ট স্লিভ কটন শার্ট এবং ছেলে শিশুদের জন্য সুতির পাঞ্জাবি, রাউন্ড নেক টি-শার্ট, ফতুয়া গরমে পরানো যেতে পারে। মেয়ে শিশুদের জন্য কটন বা বিসকস ফেব্রিকের ফ্রক, টিউনিক, কাফতান প্যাটার্ন টিউনিক পরার পরামর্শ দেন তিনি।

তাঁদের ফ্যাশন হাউজ থেকে ঈদ-উল-আয্‌হা কালেকশনে গরমের উপযোগী করে নারীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের টিউনিক, শ্রাগ, কোটি, কামিজ, পালাজো, টপ, লুজ প্যাটার্ন শার্ট এবং শাড়ির কালেকশনে হাফসিল্ক, কটন, মসলিনের ওপর ডিজাইন করা হয়েছে বলে জানান। পুরুষের পোশাক নিয়ে সমীরণ বললেন, “ছেলেদের পাঞ্জাবীর প্যাটার্নে বিশেষ কোনো বৈচিত্র নাই। ট্র্যাডিশনাল ফ্যাশনই ব্যবহার করা হয়। তবে এ সময়ে পাঞ্জাবীর নেক লাইনে কিছু বৈচিত্র আনা হচ্ছে। স্লিভের কাফ, বাটন এসবের ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনা হচ্ছে। এছাড়া অলওভার স্ক্রিন প্রিন্ট, সেল্ফ প্রিন্ট, জ্যাকার্ড ফেব্রিকস ব্যবহার করা হচ্ছে।”