বাংলাদেশে আটকে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার জোরপূর্বক নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে বলে এক প্রতিবেদন প্রকাশ হবার পর, মানবাধিকার কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জাতিসংঘের একজন সিনিয়র বিশেষজ্ঞ বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশকে পাইলট প্রত্যাবাসন প্রকল্প “অবিলম্বে স্থগিত করতে হবে”।
প্রতিশোধের ভয়ে নাম পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক, বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ ভাসান চরের এক রোহিঙ্গা শরণার্থী ভিওএ-কে বলেছেন, "সপ্তাহ দুয়েক আগে, [বাংলাদেশের] কিছু সরকারি কর্মকর্তা আমাদের [রোহিঙ্গা] সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজন সদস্যকে মিয়ানমারে না ফিরলে সহিংসতার হুমকি দিয়েছেন।"
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় গত ৮ই জুন জারি করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে, মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টার টম অ্যান্ড্রুজ বলেছেন, এমন প্রতিবেদন সামনে এসছে যে, বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করার জন্য "প্রতারণামূলক ও জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা" গ্রহণ করছে।
অ্যান্ড্রুজ তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন, "সবার আগে মিয়ানমারের পরিস্থিতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ, টেকসই এবং স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযোগী হতে হবে।"
"তাই আমি অবিলম্বে প্রত্যাবাসন পাইলট প্রোগ্রাম স্থগিত করার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ করছি।"
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য এর আগেও, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে দু’বার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দু’বারই সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর, আবারও মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ প্রায় ১,১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রত্যাবাসনের জন্য নতুন করে আরেকটি প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে গত দুই সপ্তাহ ধরে, এটি প্রকাশ্যে এসেছে যে, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে ইচ্ছুক নয়। তারপরও বাংলাদেশি কর্মকর্তারা জবরদস্তিমূলক কৌশল অবলম্বন করছেন।
সোমবার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা শরণার্থী ভিওএ-কে বলেছেন, “দুই সপ্তাহ আগে, কিছু [বাংলাদেশের] সরকারী কর্মকর্তা কয়েকজন প্রভাবশালী [রোহিঙ্গা] দলীয় নেতাদের মাধ্যমে আমাদের বলেছিলেন যে, প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবার যদি তারা মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করে, তবে তাদেরকে দুই হাজার ডলার করে দেওয়া হবে”।
তবে, রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, তারা বর্তমানে মিয়ানমারে ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছেন।
কক্সবাজারভিত্তিক রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতা ও মানবাধিকার রক্ষাকারী এইচটওয়ে লুইন বলেছেন, বাংলাদেশে উদ্বাস্তুরা "অবর্ণনীয় কষ্টের" সম্মুখীন হচ্ছে, এবং তারা সবাই মিয়ানমারে তাদের " আদি ভূমিতে" ফিরে যেতে চায়, যদি কেবল সরকার সরকারীভাবে এই সম্প্রদায়টিকে সংসদে "রোহিঙ্গা হিসাবে সরকারী জাতিসত্তা" বলে স্বীকৃতি দেয়।
লুইন ভিওএ-কে বলেছেন, "আমরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার উপর জোর দিয়েছি, যার মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের সিত্তওয়ের আইডিপি [অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের] শিবির থেকে তাদের মূল গ্রামে পুনর্বাসন করা, তাদের পূর্ণ নাগরিকত্বের অধিকার দেওয়া, তাদের নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, এবং চলাফেরার স্বাধীনতা, সেইসাথে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করা। ঠিক যেই রকম অধিকার মিয়ানমারের অন্য ১৩৫টি জাতিগত গোষ্ঠী ভোগ করছে।”
২০১৭ সালের সহিংসতায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে যাবার পর, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের অনেককে সিত্তওয়েতে একটি উন্মুক্ত বন্দী শিবিরে আটকে রাখে, যেখানে তাদের মধ্যে এক লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা এখনও অবমাননাকর এবং অবহেলিত অবস্থায় বাস করছে।
কক্সবাজারে বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান মঙ্গলবার বলেছেন, প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত প্রস্তুতি এখনো "প্রক্রিয়াধীন"।
রহমান ভিওএ-কে বলেন, "এটা সত্য নয় যে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। এছাড়া মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য কাউকেই আমরা নগদ প্রণোদনা দিইনি।"
এইচআরডাব্লিউ-এর রবার্টসন বলেছেন, মিয়ানমারের রাজ্য প্রশাসনিক পরিষদ জান্তা রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের মূল দাবিগুলোর কোনো সমাধান করতে মৌলিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
"কিন্তু রোহিঙ্গারা জানে যে, যদি তারা তাতমাডোর নিয়ন্ত্রণে মিয়ানমারে ফিরে যায়, তাহলে আবারও সেই নৃশংসতার মুখোমুখি হতে হবে, ঠিক যেমনটা ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্য থেকে তাদের হত্যা, ধর্ষণ এবং ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।"