মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষায় করণীয়

বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস ২০২৩ এর প্রতিপাদ্য

“২০৩০ সালের মধ্যে ঋতুস্রাবকে দৈনন্দিন জীবনের একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।” -এটি বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস ২০২৩-এর প্রতিপাদ্য । ঋতুস্রাব বা মাসিকের কারণে কোনো নারী যেন তার স্বাভাবিক জীবনে পিছিয়ে না পড়েন তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এই প্রতিপাদ্যটি ঠিক করা হয়েছে। মাসিক ও মাসিকের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর মে মাসের ২৮ তারিখ সারা বিশ্বে মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস পালন করা হয়। মাসিক স্বাস্থ্যবিধি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অর্থাৎ সামগ্রিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করে। মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নারীর প্রজনন জীবনে বিশাল ভূমিকা পালন করে। তাই দিবসটির উদ্দেশ্য হলো বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে ঋতুস্রাব, মাসিক বা পিরিয়ডকালীন সময়ে স্বাস্থ্যসুরক্ষায় করণীয় এবং পিরিয়ডের সাথে সম্পর্কিত রোগের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

নারীর স্বাভাবিক জীবনচক্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ পিরিয়ড। এর সঙ্গে সন্তান ধারণের সক্ষমতা সম্পর্কিত। এই খুব স্বাভাবিক বিষয়টি এখনো বাংলাদেশে স্বাভাবিক আলোচনার বিষয় নয়। এখনো এ বিষয়গুলোকে গোপনীয়, একান্ত মেয়েলি বলে গন্য করা হয়। মাসিক নিয়ে অনেক কুসংস্কার সমাজে প্রচলিত। তবে আশার কথা হলো বাংলাদেশে দিন দিন বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে। সাধারণত ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে নারীর পিরিয়ড শুরু হয় এবং ৫০ থেকে ৫২ বছর বয়স পর্যন্ত এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি চলে। এ সময়কালের মধ্যে নারীর সন্তান ধারণের সক্ষমতা থাকে।

পিরিয়ডকালীন শারীরিক স্বাস্থ্য সচেতনতা

বেশিরভাগ নারী ও কিশোরী মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখনো জনসমক্ষে কথা বলতে দ্বিধা করেন। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন ফলোআপ সার্ভে ২০১৮ (প্রকাশিত ডিসেম্বর, ২০২০) অনুযায়ী বাংলাদেশে মাত্র ৫৩ শতাংশ স্কুলছাত্রী মাসিকের ব্যাপারে জানে। ৩০ শতাংশ ছাত্রী মাসিক চলাকালে স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। ৩৪ শতাংশ কিশোরী স্কুলে মাসিকের সময় পুরোনো কাপড় ব্যবহার করে। মাত্র ৬২ শতাংশ কিশোরী স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড ব্যবহার করে। স্কুল না থাকলে কিংবা বাসায় থাকলে পুরোনো কাপড়ের ব্যবহার বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে ৩৯ শতাংশ কিশোরী পুরোনো কাপড় এবং ৫৬ শতাংশ কিশোরী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে বলে জরিপে জানা যায়। এর মধ্যে ৭৯ শতাংশ কিশোরী ভালো পানি ও সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে কাপড়গুলো পুনরায় ব্যবহার করে। মাত্র ২১ শতাংশ কিশোরী এ কাপড়গুলো বাড়ির বাইরে রোদে শুকাতে পারে। এই জরিপ থেকে বোঝা যায় মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতায় আমাদের নারীরা এখনও অনেক পিছিয়ে।

পিরিয়ডকালীন শারীরিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা-র সঙ্গে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আসমা-উল-হুসনা। তাঁর পরামর্শগুলো হলো -

১) পিরিয়ডের সময় কাপড় ব্যবহার না করে স্যানিটারি ন্যাপকিন (ওয়ানটাইম কটন প্যাড) ব্যবহার করা অধিক স্বাস্থ্যসম্মত। বিশেষ করে কিশোরীরা প্রতি দুই থেকে তিন ঘন্টা অন্তর স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তন করবে। এমনকি বাসার বাইরে স্কুল বা কলেজে থাকলেও এ কাজটি করতে হবে। অধিক সময় ন্যাপকিন পরিবর্তন না করলে জরায়ু মুখে ইনফেকশন হতে পারে। আমরা কিশোরী/অবিবাহিত নারীদের মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করি। কাপ ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি না জানা থাকলে ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাছাড়া কাপ ব্যবহারে দরকার সঠিক স্যানিটেশন। ঘরের বাইরে থাকলে কাপ খুলে পরিষ্কার করা কষ্টসাধ্য। সব সময় কাপ ব্যবহারের পরে ফুটন্ত গরম পানিতে ফুটিয়ে রাখতে হবে। পরিষ্কার করে হাত ধুয়ে কাপটি ধরতে হবে। সেজন্য বাইরে থাকলে মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা উচিৎ নয়।

২) মাসিক চলাকালীন নিয়মিত গোসল করতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। কোনো ধরণের সাবান ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ বেশিরভাগ সাবান ক্ষারীয় পদার্থ দিয়ে তৈরি। ক্ষারীয় পদার্থ ভ্যাজাইনাল এরিয়ার এ্যাসিডিক পরিবেশকে ধ্বংস করে দেয় ফলে ইনফেকশনের ভয় থাকে।

৩) মাসিকের সময় প্রচুর পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। বিশেষ করে কিশোরীদের খাওয়াদাওয়ায় পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। এ সময় নারীদের অনেক রক্তক্ষরণ হয়, হরমোনাল ইমব্যালেন্স হয়, মানসিক অবস্থার বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। পেটে ব্যথা, শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা, মানসিক অবসাদ, বিরক্তি দেখা দিতে পারে। তাই এ সময়ে খাওয়া দাওয়ার বাড়তি যত্ন নেয়াটা প্রয়োজন। মাছ, মাংস, ডিম, বাদাম, তরল খাবার বেশি খেতে হবে, ফলমূল খেতে হবে। যাতে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে পাশাপাশি শারীরিক পুষ্টি নিশ্চিত হয়।

৪) পিরিয়ডের সময়ে হালকা ব্যায়াম, সাধারণ গতিতে ৪০ থেকে ৫০ মিনিট হাঁটা খুব দরকার । এর ফলে পিরিয়ডের সময়ে ভারী রক্তপাত, তলপেটে ব্যথা, ব্যাক পেইন ইত্যাদি কমে যাবে। আবার যাদের কম রক্তপাত হয় তাদের ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক রক্তপাত হবে। কারণ হাঁটার ফলে শরীরে একটা হরমোনাল রিসাইক্লিং হয়, মস্তিষ্ক থেকে এন্ডোরফিন হরমোন বের হয়, যেটি আমাদের মধ্যে একধরনের সুখানুভূতি তৈরি করে যা শরীরকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখে, মানসিক অবসাদ কাটাতে সাহায্য করে। তবে এ সময় ভারী ব্যায়াম, সাঁতার, সাইকেল চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে।

৫) মাসিক চলাকালীন অনেকের প্রচন্ড তলপেট ব্যথা, কোমর ব্যথা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। এছাড়া হট কম্প্রেশনও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।

৬) অনিয়মিত মাসিক, অতিরিক্ত রক্তপাত, অথবা তীব্র ব্যথাসহ যেকোনো জটিলতায় অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

পিরিয়ডকালীন মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা

মাসিক চলাকালীন নারী শরীরের হরমোনাল পরিবর্তন হয়। এই হরমোনটির নাম ইস্ট্রোজেন হরমোন, এটি প্রধানত স্ত্রী হরমোন। একটি মাসিক চক্র শেষ হলে ইস্ট্রোজেন ক্ষরণ অল্প অল্প করে বাড়তে থাকে। ১৪-১৫ দিনের মাথায় তা পৌঁছে যায় সর্বোচ্চ মাত্রায়, যাকে বলে ওভল্যুশন। এরপর দ্রুত কমতে থাকে ইস্ট্রোজেন নিঃসরণ। আবার পরের মাসিকের শুরুর পর থেকে অল্প অল্প করে নিঃসরণ বাড়ে। ইস্ট্রোজেনের এই উত্থান-পতনই মেয়েদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন বা মুড সুইংয়ের জন্য দায়ী। এটি প্রি–মিনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম সংক্ষেপে পিএমএস Premenstrual syndrome (PMS) নামে পরিচিত— জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোছা. মালেকা পারভীন। ভয়েস অফ আমেরিকা-র সঙ্গে আলাপকালে তিনি পিরিয়ডকালীন মানসিক স্বাস্থ্যের পরিবর্তন এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিয়ে কথা বলেছেন।

ড. মোছা. মালেকা পারভীন বলেন, “এ সময় মুড সুইং হয়। তবে গর্ভাবস্থায় ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিবর্তন খুব বেশি হয়। এমনকি সন্তান প্রসবের পরেও ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে মুড সুইং দেখা যায়। নিয়মিত মাসিক চলাকালীনও ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিবর্তনের কারণেই মুড সুইং হয়। প্রি–মিনস্ট্রুয়াল সিনড্রোমের মধ্যে অবসাদ, হঠাৎ রেগে যাওয়া, উদ্বেগ, মানসিকভাবে ভেঙে পড়া, অস্থিরতা, হতাশা ইত্যাদি লক্ষণগুলো রয়েছে। বেশিরভাগ নারীর ক্ষেত্রেই এ ধরণের সমস্যাগুলো কম-বেশি দেখা যায় এবং এ বিষয়গুলো মাসিক চক্রাকারে চলতে থাকে। প্রতি মাসে মাসিক শুরুর এক সপ্তাহ আগ থেকেই অর্থাৎ মাসিকচক্রের ১৪তম থেকে ২৮তম দিনের মধ্যেই পিএমএস হয়। এ সময় যে শুধু মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হয় তা নয় বরং শারীরিক নানান সমস্যায় দেখা দেয় যেমন মাইগ্রেন বা মাথা ধরা, খাবার অনিচ্ছা, বমি হওয়া, অ্যাসিডিটি ইত্যাদি। তাই এ সময়ে নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য তথা সার্বিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়া প্রয়োজন। এ সময় নারী ইমোশনালি ইমব্যালেন্স থাকে। এ অবস্থাকে ‘রোলার কোস্টার অফ ইমোশন’ বলা হয়ে থাকে। পিএমএস-এর ক্ষেত্রে এ্যাংজাইটি লেভেল কখনও হাই হতে পারে, কখনও লো হতে পারে। কারো সাথে কথা বলতে ভালো না লাগা, একা থাকতে ইচ্ছে হওয়া, লোকজনের কথাবার্তায় বিরক্ত লাগা ইত্যাদি সাইকোলজিকাল পরিবর্তন এ সময় ঘটে থাকে। এই সমস্ত লক্ষণ বেড়ে গেলে তাকে প্রি–মিনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিসঅর্ডার (পিএমডিডি) Premenstrual dysphoric disorder (PMDD) বলা হয়। ”

তিনি আরো বলেন, “এসব ক্ষেত্রে মেডিকেশনের চাইতে লাইফ স্টাইল পরিবর্তন বেশি কার্যকর। এই ওঠানামা বয়ঃসন্ধিকালে একরকম হতে পারে। আবার আমরা দেখি মায়েদের প্রথম সন্তান হবার পরে যখন মাসিক চক্র শুরু হয় তখন ইস্ট্রোজেন হরমোন বেশি পরিবর্তিত হয়। তাই সে সময়ে নতুন মায়েদেরও বেশি মাত্রায় মুড সুইং হয়ে থাকে। এছাড়া পরিবেশগত কারণেও নারী শরীরে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হতে পারে। অতিরিক্ত গরম আবহাওয়ায় মাসিক চলাকালীন সময়ে অস্বস্তি, গরম অনুভব করা, হট ফ্ল্যাশ ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। অন্য কোনো হরমোনের সমস্যাজনিত অসুখ যেমন থাইরয়েড, ডায়াবেটিস ইত্যাদি থাকলেও মাসিক চলাকালীন হরমোনাল কনফ্লিকটিং সিচুয়েশন তৈরি হতে পারে। যার ফলে এ সময়ে মানসিক ও শারীরিক অস্বস্তিগুলো বাড়তে পারে।”

ভালো থাকতে করণীয়:

যদিও এই সমস্ত বিষয় প্রাকৃতিকভাবেই মাসিক চক্রের সাথে সম্পর্কিত। তাই সমস্যার সমাধান না হলেও সমস্যাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনবার জন্য কিংবা মাসিক চলাকালীন ভালো থাকবার জন্য করণীয় বিষয়ে জানালেন ড. মোছা. মালেকা পারভীন। তিনি বলেন,

১) এ সময়ে পরিবার ও কাছের মানুষগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে পিরিয়ডের কথা জানাবার এবং রিলাক্স করবার পরিবেশ থাকলে নারী অনেকটাই সুস্থ বোধ করবে। এ সময় যদি অন্তত এক সপ্তাহের জন্য একজন নারীর কাজের চাপ তার সংসারে এবং কর্মক্ষেত্রে কমানো যায় সে ক্ষেত্রে সে অনেকটাই চাপমুক্ত থাকতে পারে। সেজন্য চারপাশের মানুষের সহযোগিতা ছাড়া এর কোন বিকল্প নেই। এজন্য মাসিক যে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং এই সময় যে নারীর শরীরে এ ধরনের স্বাভাবিক পরিবর্তনগুলো হয় সে সম্পর্কে অধিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

২) মেডিটেশন, যোগব্যায়াম এ সময়ের জন্য বেশ কার্যকর। মুড সুইং কমায়, এ্যাংজাইটি কমায়। পিএমএস-এর জন্য দায়ী হরমোনকে প্রতিহত করে।

৩) পর্যাপ্ত ঘুম শরীরকে রিলাক্স করে। মানাসিক চাপ কমায়। তাই এ সময়ে রাত না জেগে সঠিক সময়ে এবং ছয় থেকে আট ঘন্টা ঘুমাতে হবে।

৪) এ সময়ে ডায়েটের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মানসিক অবসাদের কারণে মাসিক চলাকালীন জাঙ্ক ফুড, ফাস্ট ফুড, মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ার ইচ্ছে হতে পারে। কিন্তু এ ধরনের খাবার খেলে মাসিকের সময় অ্যাসিডিটির সমস্যা বাড়তে পারে। তাই এ সময় স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করা উচিত।