ভারতের স্বাধীনতা ও অবিভক্ত বাংলার আপামর জনজাতির জীবন সংগ্রামের ইতিহাসে ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ এই নামটি অন্যতম একটি চালিকাশক্তি। দাসত্বের শৃঙ্খলে আবিষ্ট জাতিকে শোষণ ও অত্যাচারের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার বলিষ্ঠ ডাক তিনি দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যখন খ্যাতির মধ্যগগনে, সেই সময় রবীন্দ্রবলয়ের প্রভাবমুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব সাবলীল ভঙ্গিতে রচনা করতে থাকেন একের পর এক সাহিত্য। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর হয়েছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের কবি পরিচিতি প্রধান হলেও, সৃষ্টির জগতে তাঁর সঙ্গীতের অবদান শ্রোতাদের মনে আবেগের সঞ্চার করেছে এ কথা বললেও অত্যুক্তি হয় না। জীবৎকালে প্রায় ৩৫০০-এর বেশি গান রচনা, সুরারোপণ, গানের নতুন ধারা তৈরি সব মিলিয়ে নজরুলগীতি এক কালজয়ী সৃষ্টি।
বাংলায় নজরুলগীতিচর্চা
একটা সময় ছিল যখন ‘রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা’ এই শব্দবন্ধটি প্রায় সবার মুখে মুখে ফিরত। আবার একসময়ে রেকর্ড প্লেয়ার, ক্যাসেট বা সিডির দোকানের তাকগুলোতেও কিন্তু ইন্দুবালা, সুপ্রভা সরকার, পূরবী দত্ত, ফিরোজা বেগম, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়- প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পীদের নজরুলগীতির রেকর্ড প্লেয়ার, ক্যাসেট বা সিডি সহজেই চোখে পড়ত। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ছবিও একই। সেখানকার মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে নজরুলের যেন অবাধ যাতায়াত। নজরুল চর্চার জন্য যেমন রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, তেমনি সঠিক অর্থে নজরুলের গান, বিশেষ করে শিক্ষা-প্রচার-প্রসারেরও ব্যবস্থা রয়েছে। কারণ অবশ্যই নজরুল তাঁদের জাতীয় কবি।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে দেখলে দেখা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই চিত্রটা অনেকাংশে পরিবর্তিত। তরুণ প্রজন্মের সঙ্গীতশিল্পী সোমঋতা মল্লিকও এই বিষয়ে বলেন,“২০০৭-২০০৮-এ আমি দেখতাম যে আমার চারপাশে সেই অর্থে সারা বছর ধরে যতটা বেশি রবীন্দ্রনাথের চর্চা হত, সেইভাবে নজরুল চর্চা হচ্ছে, এরকম কিছু চোখে পড়ত না।” নজরুলগীতি চর্চার পারিবারিক আবহে বড়ো হয়ে ওঠা সোমঋতা ও তাঁর বোন যৌথ উদ্যোগে তৈরি করেন ২০০৮ সালে মে মাসে ‘ছায়ানট কলকাতা’। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত নিরলসভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নজরুল সৃষ্টিকে গান, পাঠ, তথ্যচিত্র, সাংস্কৃতিক সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে আরও ছড়িয়ে দিতে।
পশ্চিমবঙ্গে নজরুলগীতি চর্চার ক্ষেত্রে এই ভাঁটার কথা স্বীকার করে নেন সঙ্গীতশিল্পী শ্রীমতী বনানী দে। দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছরের সঙ্গীত জীবনের অভিজ্ঞতা তিনি ভাগ করে নেন ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে। তিনি জানান- ছোটবেলা থেকেই সহজাত ভঙ্গিতেই নজরুলগীতির চর্চা তিনি করেছেন। তাঁর অভিমত, “সেই সময়ে নজরুলগীতি শুধু মানুষের ধারণাই বদলে দেয়নি, সঙ্গীতকে বাঁচিয়ে রাখার কাজও করেছে। হয়ত সুরের জটিলতা বা বিভ্রান্তির জন্য কিংবা নজরুলের গান অভ্যাসের জন্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা যে বিশেষভাবে প্রয়োজন সেই কারণেই হোক- এই চর্চা থিতিয়ে পড়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।”
তবে বিগত তিন/চার বছর ধরে এই সামগ্রিক চিত্রের খানিক পরিবর্তন কিন্তু দুই প্রজন্মের শিল্পীই কিন্তু লক্ষ্য করেছেন।
সঙ্গীতে নজরুলের অবদান
বাংলা সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারাকে নজরুল পুষ্ট করেছেন। বাংলায় সর্বপ্রথম সার্থক ভাবে তিনি যেমন গজল গান রচনা করেছেন, তেমনই ইসলামি গানের সঙ্গেও পরিচয় ঘটান। বহু রাগরাগিনী সৃষ্টি করেছেন গানের বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। গানের ক্ষেত্রে নজরুলের এত ব্যাপ্তি নিশ্চয়ই তাঁর গানের সাফল্যের একটা বড়ো কারণ। তাঁর গানে তিনি রাগসংগীতকে অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন।
পেশায় পদার্থ বিদ্যার অধ্যাপক হলেও নজরুলের গানের প্রতি ছোটবেলা থেকে এখনও এক গভীর আকর্ষণ অনুভব করেন নজরুল সঙ্গীতশিল্পী সঞ্চারী গোস্বামী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের গান নিয়ে চিন্তন, অধ্যয়ন ও গভীর উপলব্ধি তিনি ভাগ করে নেন ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে। তিনি নজরুল গানের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় আলাদা করে বলেন। গানের বাণী ও গানের সুর। গানের বাণীর বিষয়ে তিনি বলেন- “ নজরুল সবসময় বিষয়কে গানে সহজ করে ধরেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা বলতে চেয়েছেন সরাসরি বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের গান অধিকাংশ ক্ষেত্রে গভীর জীবনবোধ দিয়ে বুঝতে হয়। 'মরণ বলে আমি তোমার জীবনতরী বাই'-- এ কথা গভীর বোধ ছাড়া বোঝা অসম্ভব। নজরুল সেখানে আলাদা। তিনি অনেক বেশি সরাসরি বলেন, 'মৃত্যু নাই, নাই দুঃখ, আছে শুধু প্রাণ'। তাঁর গানে রূপকের ব্যবহারও বেশ উল্লেখযোগ্য বিষয়। 'সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে তুমি আমারে ছুঁইয়াছিলে', 'গানগুলি মোর আহত পাখির সম', 'আমি সূর্যমুখী ফুলের মত' সবেতেই রূপক ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু প্রতিবারেই তিনি শ্রোতাকে বুঝিয়ে চলেছেন তার কথার মানে”।
আর সুর প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত- নজরুল অবলীলায় শাস্ত্রীয় সংগীত, লোকগানের বিভিন্ন আঙ্গিক, নাটকীয়তাকে তাঁর গানে ব্যবহার করেছেন। তাঁর গানের সুর বৈচিত্র্যর ব্যাপ্তি কোন কোন সময়ে রবীন্দ্রনাথের গানের চেয়ে বেশিই মনে হয়।
বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অভ্র বসু মনে করেন- “শুধু সুরের মূল্যেই নয়, কথার মূল্যেও তাঁর গান অনবদ্য। বিশেষত তাঁর প্রেমের গানের গভীরতা আমাকে বিশেষ করে টানে। কবি হিসেবে নজরুলের কিছু সীমাবদ্ধতার কথা আমরা সকলেই মানি। কিন্তু গানের ছোট্ট পরিসরে তাঁর গানের কাব্যমূল্য খুব বেশি”।
শিল্পী বনানী দে আবার জানান- “নজরুলের গানের ব্যাকরণের বেড়ি শক্ত না হলেও তাল-সুরের বিষয়ে নজরুল কিন্তু খানিকটা রক্ষণশীল ছিলেন (যদিও গায়কের ক্ষমতা অনুযায়ী সঙ্গীতের ধরণ বুঝে সামান্য সুরের পরিবর্তনের স্বাধীনতা তিনি দিয়েছেন)।”
অভ্র বসু আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন- “নজরুলের গান নিয়ে বাঙালির আগ্রহের একটা ভাঁটা ইদানীং লক্ষ্য করি। দুই তিন দশক আগে থাকলেও ইদানীং বিশুদ্ধ নজরুল গাইবার মানুষ প্রায় দেখিই না, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে। অবাক লাগে, সিনেমাতেও নজরুলের গানের ব্যবহার খুবই কম। কিন্তু নজরুলের গানের আরো প্রসারের সম্ভাবনা ছিল”।
বর্তমানে নজরুলের গান নিয়ে বাংলাদেশে যেভাবে চর্চা হচ্ছে, তাতে স্বল্প পরিচিত গানের পাশাপাশি তাঁর রচিত ও সুর দেওয়া বহু হিন্দি গানও আমাদের সামনে আসছে।
আজকের ও আগামীর প্রজন্মের জন্য নজরুলগীতি-
নজরুলগীতি বিষয়ে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে আরও সচেতন ও সংবেদনশীল হতে বনানী দে পরামর্শ দেন- নজরুলগীতি চর্চা করতে প্রাথমিক প্রয়োজন নান্দনিক চেতনা এবং সুর তাল ছন্দের প্রতি বিশেষ বোধ থাকা। শুধু গান গাওয়াই মুখ্য নয় তার সঙ্গে সঙ্গে কাব্যগুণ উপলব্ধি করা ও গভীর মননশীল পাঠক হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাঁর গানকে গভীরভাবে জীবনবোধ দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে আমাদের।
সোমঋতা আবার সচেতনতা বৃদ্ধির প্রথম ধাপ হিসেবে বাংলা ভাষার চর্চার ওপর গুরুত্ব দেন। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানান যে এখনকার শিশুদের মধ্যে অনেকেই কবিতা বা গান বাংলা হরফে পড়তে পারে না। সেক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে ইংরেজি হরফে বাংলা পড়ার বা লেখার প্রবণতা দেখা যায়। তাই বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসা বাড়ানো প্রয়োজন, কারণ হিসেবে তিনি বলেন- “আমরা যদি একটি গান বা কবিতার অর্থ বুঝতে না পারি, তাহলে আমরা বিষয়বস্তুর সঙ্গেও সম্পৃক্ত হতে পারব না, ফলত আমাদের মধ্যে গান বা কবিতার প্রতি ভালবাসাও তৈরি হবে না। আর ভালবাসা তৈরি না হলে আমরা তা সঠিকভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হব না। তাই আমি মনে করি, গান গাওয়া বা কবিতা বলার করার আগে আমাদের প্রথমে তাঁর অন্তর্নিহিত অর্থ বোঝা ভীষণ জরুরি। আর ভাষা সেক্ষেত্রে প্রাথমিক চাবিকাঠি”।
বহুদিন আগেই কাজী নজরুল ইসলাম বলে গেছেন যে ‘সাম্যের গান গাই/ আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই’। অর্থাৎ নারী পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়ে তাঁর অনেক গান রয়েছে। নারী জাগরণের জন্য, নারীদেরকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি লিখেছেন,
‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা।
জাগো স্বাহা সীমান্তে রক্তটীকা’ ।