প্রচণ্ড গরমে সুস্থ থাকার উপায়

প্রতীকী ছবি

“বড়ো গরম! ভারি গরম! ঠাণ্ডা সরবত আনো।/হাত পা কেমন করছে ছনছন! জোরে পাখা টানো”- উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির এই কথা যেন সেই মার্চ মাস থেকে শুরু হয়ে এখন মে মাস জুড়ে পশ্চিমবঙ্গবাসী প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে। বৈশাখ নয় চৈত্রের শেষেই গরমের দাপটে নাজেহাল হয়েছিল আপামর বাংলা, যদিও বৈশাখ শুরু হতেই চিত্রটা সামান্য হলেও অন্যরকম হয়। এইসময়ে খুবই কম হলেও কালবৈশাখীর ঝড়বৃষ্টির কিছুটা হলেও রাজ্যের কোথাও কোথাও মানুষজনকে স্বস্তি দিয়েছিল। তবে এই স্বস্তির স্থায়িত্ব খুব বেশিদিনের হয়নি। আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা করছেন, চলতি মে ও আগামী জুন মাসে গরমের তীব্রতা আরও বাড়বে। প্রবল তাপপ্রবাহ সঙ্গে রোদের চোখ রাঙানির শিকার হবে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশের মানুষও। তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৪০-৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। বর্তমানে প্রতিদিনের জীবন যাপনে এই দাবদাহ থেকে নিজেকে সুস্থ রাখাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কী কী পদ্ধতিতে নিজেকে সুস্থ রাখা যায় তার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তীব্র তাপপ্রবাহে বিপদের লক্ষণ

এই তীব্র গরমে শরীরের ও বাইরের তাপমাত্রার পার্থক্যের জন্য সাময়িক ভাবে – মাথাঘোরা, দুর্বল লাগা, গা বমি ভাব, সাময়িক জ্ঞান হারানো, জ্বর জ্বর ভাব দেখা যায়। এছাড়াও যে দুটি বিষয়ে ডাক্তারও বিশেষ উদ্বিগ্ন থাকেন সেইগুলি হল - হিটস্ট্রোক ও মাসল ক্র্যাম্প।

  • হিটস্ট্রোক – পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার ‘নরবি সুপার স্পেশ্যালিটি হসপিটাল’-এর কনসাল্টেন্ট ফিজিশিয়ন ডাঃ সুমন ঘোষ জানান – “আগে যেমন সাধারণভাবে ভাবা হত হিটস্ট্রোকে বয়স্ক মানুষজনই আক্রান্ত হতে পারেন, সেই ধারণা আজ ভ্রান্ত। বরং যেকোনো বয়সের মানুষ এর শিকার হতে পারেন। দীর্ঘক্ষণ রোদে একটানা কাজ করে গেলে হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনা থাকে। এটি মূলত দুরকমের হতে পারে –

১। এক্সরসানল হিটস্ট্রোকঃ মূলত অল্প বয়স এবং মাঝারি বয়সী মানুষদের।

২। নন-এক্সরসানল হিটস্ট্রোকঃ শিশু ও বয়স্কদের।

লক্ষণ প্রথমে দুর্বল ভাব -ঝিমিয়ে পড়া-অসংলগ্ন কথা- খিঁচুনি এমনকি মৃত্যু

সাবধানতা অল্প এবং মাঝারি বয়সীদের ক্ষেত্রে দীর্ঘক্ষণ রোদে কাজ না করা, বাচ্চা ও বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে সকাল ১১ থেকে বিকেল ৪/৫ পর্যন্ত বাইরে যথাসম্ভব না বেরোনো।

  • মাসল ক্র্যাম্প - এই বিষয়ে ডাঃ সুমন ঘোষ বলেন – গরমকালে যে ঘাম ও ইউরিনের মাধ্যমে শরীরের জল বেরিয়ে যায় এ আমরা সকলেই জানি, কিন্তু আরও বেশ কিছু পদ্ধতিতে আমাদের শরীরের জল বেরিয়ে যায় যা আমরা দেখতে পাই না, একে এক কথায় ইন্সেনসেবল ওয়াটার লস বলা হয়। যেমন আমাদের ফুসফুস থেকে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ও ত্বকের সাহায্যে জল বেরোয়। এই গরমে প্রচণ্ড ভাবে শরীরে জলের ঘাটতি হতে থাকে যার প্রভাব প্রথমেই পড়ে আমাদের মাংসপেশিতে।

লক্ষণ মাংশপেশির ফোলা ভাব, মাংসপেশির কোষের ক্ষয় এবং শেষে পেশিতে অসম্ভব ব্যথা শুরু

সাবধানতা পর্যাপ্ত জল পান, সঠিক মাত্রায় ভিটামিন- সি, ভিটামিন- ই গ্রহণ। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কমপক্ষে ৩-৪লিটার/দিন আর শিশুদের ২-৩মিলিলিটার/ কেজি (শরীরের ওজনের পরিমাপ অনুযায়ী)*

*তবে কিডনির সমস্যা ও কো মর্বিডিটি থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।

হিটস্ট্রোকের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর উপায়

পথ চলতে গিয়ে যদি দেখেন কেউ হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন সেক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে দ্রুত কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এই বিষয়ে ‘লাইফ সেভিং সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার’ ইন্সট্রাকটর শ্রী রূপক দে পরামর্শ -

  • প্রথমেই অসুস্থ ব্যক্তিকে ছায়ায় বা অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা জায়গায় নিয়ে গিয়ে সুপাইন পজিশনে রাখতে হবে।
  • পাখা রয়েছে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে পাখার স্পিড বাড়িয়ে যথা সম্ভব জামা কাপড় খুলে বা ঢিলে করে দিতে হবে যাতে শরীরের অতিরিক্ত তাপ বেরিয়ে যেতে পারে।
  • ভেজা তোয়ালে দিয়ে গলার চারপাশ ও মুখ মুছিয়ে দিতে হবে। সরাসরি মাথায় ও গায়ে জল দেওয়া যাবে না।
  • জ্ঞান থাকলে অল্প অল্প করে চামচের মাধ্যমে শুধুমাত্র জল খাওয়ানো যেতে পারে।
  • অজ্ঞান হয়ে পড়লে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের প্রবাহ বুঝে প্রয়োজনে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে। আর শ্বাসরূদ্ধ হলে CPR (cardiopulmonary resuscitation) দিতে হবে।
  • পরিস্থিতি গুরুতর হলে এ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

প্রবল গরমে প্রতিদিন যে উপায়ে সুস্থ থাকবেন

বিশেষজ্ঞরা তীব্র গরমে রোজকার জীবনে সুস্থ থাকার বিষয়েও বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন-

  • হাল্কা সুতির পোশাক, সানগ্লাস, ছাতা বা টুপির ব্যবহার করা।
  • শরীরে জলের ঘাটতি এড়াতে পর্যাপ্ত পরিমাণে (দিনে ৩/৪ লিটার) জলপান করা। যারা রোদের তীব্রতার মধ্যেও বাইরে কাজে বেরোচ্ছেন তারা যদি ORS বা নুন চিনি মেশানো এক বোতল জল সঙ্গে নিয়ে বেরোতে পারেন তা হলে ভাল, খেয়াল রাখতে হবে যাতে কোনভাবেই শরীরে জল ও সোডিয়াম পরিমাণ না কমে যায়।*
  • ‘অ্যাবট নিউট্রিশন’-এর নিউট্রিশন অ্যাডভাইজর ইপ্সিতা চক্রবর্তী বলেন, “গরমে বাইরে থেকে বাড়িতে আসার পর নুন চিনির জল, ডাবের জল, বাটার মিল্ক, ফলের রস খাওয়া যেতে পারে।” যদিও তিনি ফলের রসের চাইতে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় কমপক্ষে দুটি গোটা ফল যুক্ত করার কথা বলেন। শরীরে জলের পরিমাণ ও ভিটামিনের মাত্রা ঠিক রাখে এমন ফল যেমন শসা, তরমুজ, জামরুল, লেবু এছাড়াও আপেল, কলার সঙ্গে ফাইবার জাতীয় মরসুমি ফল খাওয়া যেতে পারে। তিনি এও বলেন- “দুপুরের ও রাতের খাবারের সঙ্গে টক দই রাখলে ভাল হয়। রাতে টক দই খাওয়া নিয়ে অনেকের ভ্রান্ত ধারণা আছে। ফ্রিজের থেকে বের করে সঙ্গে সঙ্গে কিছু খেলে যে কোন সময়তেই আমাদের ঠাণ্ডা লাগতে পারে। যদি সাধারণ তাপমাত্রায় এনে তা খাওয়া যায় তাতে কোন সমস্যা হবে না।” চিনি ও তেলের ব্যবহার যথাসম্ভব কম করে সহজপাচ্য খাবার, সঙ্গে প্রচুর সবুজ টাটকা মরসুমি শাকসবজি খাদ্যতালিকায় থাকতে হবে।*
  • বর্তমানে যেরকম জীবনধারায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পরেছি সেক্ষেত্রে শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত যোগা আর প্রাণায়ামের প্রয়োজন। এইক্ষেত্রে স্ট্রেচিং, হাল্কা জগিং, ভুজঙ্গাসন, পদ্মাসন, পবনমুক্তাসন, সূর্যনমস্কার ইত্যাদি আসন এবং প্রাণায়ামের মধ্যে কপালভাতি, অনুলোম বিলোম, শীৎকারী ও শীতলি করা যেতে পারে শরীরকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য। এগুলোর মধ্যে দিয়ে আমাদের ফুসফুস ও হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা, হজমশক্তি বাড়বে এবং শরীরের তাপসহনের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে। **

* কো মর্বিডিটি থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।

** শারীরিক গঠন, কো মর্বিডিটির লক্ষণ জেনে নিয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষকের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন।

যে যে কাজগুলি এই গরমে না করাই বাঞ্ছনীয়

গরমের সময় শুধুমাত্র আমরা বেশ কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকলেই অনেক বড় বিপদের থেকে রক্ষা পেতে পারি। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন-

  • অতিরিক্ত রোদে জরুরি কাজ না থাকলে বাইরে না বের হওয়াই বাঞ্ছনীয়। জগিং, যোগা বা জিমের মত শারীরিক পরিশ্রম ও ঘাম বের করে দেওয়ার মত কাজ সাধারণত সকাল ১০/১১ থেকে বিকেল ৪/৫ টার মধ্যে না করাই উচিৎ।
  • ফাস্ট ফুড, ডিপ ফ্রায়েড খাবার, মাংস বা অতিরিক্ত প্রোটিন জাতীয় খাদ্য, প্যাকেট করা ঠাণ্ডা পানীয়, মদ্যপান, অতিরিক্ত চা, কফি এড়িয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। এই ধরণের খাবার আমাদের শরীরে জলের অতিরিক্ত চাহিদা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর জল রেচনের মাধ্যমে বেরও করে দেয়, যে বিষয়ে আমরা অনেকসময়ে সচেতন থাকি না।
  • এছাড়াও ডাঃ ঘোষ বলেন, “প্রেশার, ডায়াবেটিসের এমন অনেক ওষুধ আছে যা আমাদের ইউরিনের মধ্যে দিয়ে জল, লবন, শর্করা ইত্যাদিকে বের করে দেয়। গরমে অতিরিক্ত এই মিনারেল বেরিয়ে গেলেও সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই কো মর্বিডিটি আছে এমন মানুষরা অবশ্যই তাদের ওষুধ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলবেন।”
  • যোগা থেরাপিস্ট রূপক দে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা জানান, তিনি বলেন- “সোশ্যাল মিডিয়া দেখে অনেকের মধ্যেই শরীরচর্চা করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা অনেকসময়ে শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।” প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব শারীরিক গঠন, কো মর্বিডিটির লক্ষণ কী আছে সেটি আগে ভাল করে জেনে নিয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষকের সাহায্যেই শরীরচর্চার করার পরামর্শ তিনি দিয়েছেন।