বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার ওপর লেখা একটি বইয়ে ‘ইতিহাস বিকৃতি’ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘অবমাননার’ অভিযোগে দেশটির শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেট সভায় ‘অপরাধী’ ঘোষণা করে জানানো হয়েছে, ইতিমধ্যে তিনি অবসরে গেলেও ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একাডেমিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না। পাশাপাশি প্রকাশনা সংস্থার বিরুদ্ধে ‘যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা’ নিতে সরকারকে ‘অনুরোধ’ জানানো হয়েছে।
২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘হিস্টোরাইজিং ১৯৭১ জেনোসাইড: স্টেট ভার্সেস পারসন’ বইটির বিষয়ে ২৯ মার্চ থেকে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে ‘অভিযুক্ত’ অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ৬ এপ্রিল নিজের বিভাগ থেকে অবসর প্রস্তুতি ছুটিতে (এলপিআর) চলে যান এবং বেশ কয়েকটি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে উপাচার্যের কাছে আবেদন করেন। এক যুগের বেশি সময় আগে ১০৬ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করে দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)। ইউপিএল-এর ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেছে, তাদের স্টকে বইটি এখন নেই। দাম বলা হয়েছে ৩৪ ডলার। তবে শোরুম মূল্য লেখা ৯৫০ টাকা।
অধ্যাপক ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের গৃহীত সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ‘শিক্ষক নেটওয়ার্ক’ । ৩ মে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, ‘‘সিন্ডিকেটের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী। এই সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ ১৯৭৩-এর মূলনীতির বিরুদ্ধে গেছে এবং বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করেছে।’’
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। পাশাপাশি সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত জীবনবৃত্তান্তে ইমতিয়াজ আহমেদ উল্লেখ করেছেন, তিনি এখন পর্যন্ত লেখক, সহলেখক কিংবা সম্পাদক হিসেবে ৩৩টি বই এবং ৯টি মনোগ্রাফের কাজ করেছেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একাধিক শীর্ষস্থানীয় জার্নালে তার ১২০টি রিসার্চ পেপার ও scholarly articles প্রকাশিত হয়েছে।
পুরনো বইয়ের কারণে সমালোচনায় পড়ার আগে কয়েক বছর ধরে 'সরকারের পক্ষে'ই বেশি কথা বলতে শোনা গেছে ৬৫ বছর বয়সী এই অধ্যাপককে। মুক্তিযুদ্ধ এবং গণহত্যার বিষয়েও দীর্ঘদিন ধরে সোচ্চার তিনি।
হঠাৎ যেভাবে আলোচনায়
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, মুক্তিযোদ্ধা এবং গণহত্যা বিষয়ক আরেক গবেষক শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ২৯ মার্চ বিডিনিউজ নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে নিবন্ধ লেখেন। ‘ঢাবি অধ্যাপকের বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর উপর অমার্জনীয় লেখনী’ শিরোনামের ওই মতামত কলামে তিনি দাবি করেন, ‘‘ইমতিয়াজ আহমেদ তার বইয়ে লিখেছেন যে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ বলার পর ‘জয় পাকিস্তান’ বলে ভাষণ শেষ করেছিলেন। বইটির ৪০ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত অধ্যাপক ইমতিয়াজ লিখেছেন তিনি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিজে হাজির হয়ে বঙ্গবন্ধুকে ‘জয় পাকিস্তান’ বলতে শুনেছেন।’’
দ্বিতীয় দফায় লেখা আরেকটি কলামে বইটির পৃষ্ঠা জুড়ে দিয়ে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক আরও লিখেছেন, ‘‘অধ্যাপক ইমতিয়াজ বোঝাতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি। অধ্যাপক ইমতিয়াজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি চরম অবমাননা করে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছেন, "একটি মৌলিক প্রশ্ন হলো, আসলেই কি ত্রিশ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছিল, নাকি মৃতের সংখ্যা কম ছিল? ত্রিশ লক্ষ সংখ্যাটির প্রবক্তা ছিলেন বাংলাদেশী এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।’”
শামসুদ্দিন মানিকের এই কলাম প্রকাশের পর বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন থেকে অধ্যাপক ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি ওঠে। সংগঠনগুলো বিবৃতি দেওয়ার পাশাপাশি মানববন্ধন-সমাবেশের মতো কর্মসূচিও পালন করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অভিযোগের বিষয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে ২ এপ্রিল রাতে বিবৃতি দেন ইমতিয়াজ আহমেদ। অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, ‘‘প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের অভিযোগ ওঠায় আমি আশ্চর্য হয়েছি। যে বইটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত জেনোসাইডের বিচার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনোসাইড স্টাডিজ সেন্টার প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়ে রচিত, তাতে ১৯৭১ সালের জেনোসাইডকেই অস্বীকার কিংবা এর গুরুত্ব কমিয়ে দেখানো কীভাবে সম্ভব?’’
তার দাবি, ‘‘কোথাও বইয়ের কোনো কোনো অংশ বুঝতে ভুল হয়েছে কিংবা ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে৷’’
এই বিবৃতির পরদিন অর্থাৎ ৩ এপ্রিল ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ৬ এপ্রিল তিনি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাইলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আসার আগেই তাকে অব্যাহতি দেন উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান। সেদিন মো. আখতারুজ্জামান নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘ইমতিয়াজ আহমেদ নিজেই অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেছেন। তাই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আগেই তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’’
প্রতিবেদন আসার পর ৩০ এপ্রিল সিন্ডিকেট ‘শাস্তি’ হিসেবে সিদ্ধান্ত নেয় অধ্যাপক ইমতিয়াজ ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ধরনের একাডেমিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) মুহাম্মদ সামাদ ও সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) এ এস এম মাকসুদ কামাল, শিক্ষাসচিব সোলেমান খান প্রমুখ এতে উপস্থিত ছিলেন।
এমন শাস্তি পাওয়ার পর ইমতিয়াজ আহমেদ কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন কিংবা আদৌ পদক্ষেপ নেবেন কি না, সেটি জানতে যোগাযোগ করা হলে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। বিবৃতিতে আমার অবস্থান ইতিমধ্যে ব্যাখ্যা করেছি।’’
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের বিষয়টি সর্বশেষ কোন অবস্থায় আছে, সেটি জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) মুহাম্মদ সামাদ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার আরও সুযোগ ছিল। কিন্তু সিন্ডিকেট ওদিকে আর যায়নি। উনি ইতিমধ্যে অবসরে চলে গেছেন। নিন্দা জানানো হয়েছে, ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। ছয় তারিখ আবেদন দিয়ে সাত তারিখ থেকে তিনি অবসরে চলে গেছেন। ওনার এমনিতেই অবসরের সময় এসে গিয়েছিল। এর ভেতর তার বইয়ের মিথ্যা তথ্যের বিষয়টি সামনে আসে।’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অধ্যাপক ইমতিয়াজের জন্ম ১৯৫৮ সালের ৭ এপ্রিল। সেই হিসেবে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিন, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তার বয়স হওয়ার কথা ১২ বছর ১১ মাস।
বয়সের বিষয়টি উল্লেখ করে মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘জনাব ইমতিয়াজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। উনি বইয়ে মিথ্যা কথা লিখে নিন্দিত হয়েছেন। লিখেছেন যে উনি নিজে ৭ মার্চের সমাবেশস্থলে ছিলেন। দুনিয়ার কোনো ডকুমেন্টে বলা হয়নি বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেছেন। লাখ লাখ লোক ছিলেন সেখানে। এত সাংবাদিক, এত বুদ্ধিজীবী, এত ইউনিভার্সিটির শিক্ষক কেউ সেটা শুনলো না। আর তিনি তখন ১২, ১৩ বছরের বালক এটা শুনে পরে বইয়ে লিখে ফেললেন! এটা তো বিশ্বাসযোগ্য নয়।’’
‘‘স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স সেলেরও ডিরেক্টর ছিলেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ। সেখান থেকেও অপসারণ করা হয়েছে। তারপর বিষয়টি সিন্ডিকেটে নিয়ে নিন্দা, ক্ষোভ জানানোর পাশাপাশি ইতিহাস বিকৃতির কারণে তাকে অপরাধী বলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএল-এর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।’’