বাংলা সাহিত্য শুধু নয় বিশ্বসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সময়োত্তীর্ণ লেখক যাঁর সাহিত্যকর্মের সূচনালগ্ন থেকে সমাপ্তিকাল পর্যন্ত লেখায় নারীর বিচিত্র জীবন পরিচয় ও তাঁদের বিবর্তিত রূপ অঙ্কিত হয়ে এসেছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, তাঁর অপমান, অনাদর, অবমাননা, সুখ-দু:খ, বঞ্চনা এবং সেইসঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া, প্রতিবাদ, আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান আহরণের বিচিত্র মিথস্ক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য ছোটগল্পে, উপন্যাসে। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাংলা সাহিত্য পেয়েছে অবিস্মরণীয় সব নারী চরিত্র। তাঁর সৃষ্ট নারী শুধু মমতাময়ী, কোমলমতি, স্নেহশীল কিংবা প্রেমিকা নয় বরং অনেক সময়েই সেইসব নারী চরিত্র নীতির প্রশ্নে আপোষহীন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমসাময়িক অনেক লেখকদের চাইতে ভিন্নভাবে নারী চরিত্রদের এঁকেছেন। যেখানে কবি সাহিত্যিকরা নারীকে তাঁদের কাব্য প্রেরণার অংশ হিসেবে দেখেছেন, নারীকে পুরুষের ছায়ামাত্র ভেবেছেন, সেখানে তিনি নারীকে তুলে এনেছেন তাঁর সাহিত্যকর্মের কেন্দ্রীয় চরিত্রে। উনিশ শতকে যেখানে নারীর অধিকার প্রায় অকল্পনীয় সেখানে রবীন্দ্রনাথ নারীকে উপস্থাপন করেছেন স্বাধীনচেতা, প্রগতিশীল, প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন করে। রবীন্দ্রনাথের নারীরা যুগের তুলনায় আশ্চর্যরকমের অগ্রসর। রবীন্দ্র গবেষকদের মতে, ব্যক্তিজীবনে ঠাকুরবাড়ির নারীদের মধ্যে এমন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দেখেছিলেন বলেই তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্রের মধ্যে কাদম্বরী, জ্ঞানদানন্দিনী, স্বর্ণকুমারী, সরলা ঘোষাল, ইন্দিরা দেবী, স্ত্রী মৃণালিণী দেবী, কন্যা মাধুরীলতা, রেণুকা, মীরাদেবীর ছায়া প্রতিফলিত হয়েছে।
রবীন্দ্রসাহিত্যের অগ্রগামী নারী চরিত্র
রবীন্দ্রনাথের নারী চরিত্র বড়ই বিচিত্র। প্রতিটি চরিত্র স্বতন্ত্রমন্ডিত, অনন্য। সে কারণেই তাঁর প্রতিটি নারী চরিত্র নিয়েই আসলে আলোচনা করা যায়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য ভান্ডার যা আরো একশত বছর পরেও বাঙালী জীবনে প্রাসঙ্গিক থাকবে। রবীন্দ্রসাহিত্যের উপন্যাস ও বড় গল্পে আমরা পেয়েছি, ‘ল্যাবরেটরি’র সোহিনী, ‘দুইবোনে’র শর্মিলা ও ঊর্মিলা, ‘চার অধ্যায়’এর এলা, 'যোগাযোগে'র কুমুদিনী, 'শেষের কবিতা'র লাবণ্য, 'দৃষ্টিদানে'র কুমু, 'গোরা'র সুচরিতা, 'নষ্টনীড়ে'র চারুলতা, 'ঘরে-বাইরে'র বিমলা, ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী। ছোট গল্পে পাই 'স্ত্রীর পত্রে'র মৃণাল, ‘দেনাপাওনা’র নিরুপমা, ‘হৈমন্তী’র হৈমন্তী, ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ী, 'শাস্তি'র চন্দরা, রবিবারের ‘বিভা’, 'সুভা'র সুভাষিণী সহ আরো বেশ কিছু চরিত্র। রবীন্দ্রনাটকে পাই ‘রক্তকরবী’র নন্দিনীকে।
সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী রূপ
রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি বিখ্যাত ছোটগল্প ‘দেনাপাওনা’, ‘হৈমন্তী’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘অপরিচিতা’ ও ‘পয়লা নম্বর’। এ গল্পগুলোর নায়িকারা ক্রমান্বয়ে নিরুপমা, হৈমন্তী, মৃণাল, কল্যাণী, অনিলা। এই প্রতিটি চরিত্র সমাজের তথাকথিত বিবাহরীতি, সংসার ধর্ম, পণপ্রথা, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার, নিপীড়নের মুখে এক একটি প্রতিবাদী রূপ। এ গল্পগুলোয় রবীন্দ্রনাথ মেয়েদের বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সমাজের যে অন্যায় রীতিনীতি তুলে ধরেছেন, একজন নারীর ও তার বাবা মাকে বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে যে অপমান, অপবাদ সহ্য করতে দেখিয়েছেন তা এখনও অনেক ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। আবার একই সাথে তাদের প্রতিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে। যেমন, ‘দেনা পাওনা’ গল্পে আমরা দেখি, পণের পুরো টাকা দিতে পারেননি নিরুপমার বাবা। তাই শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ির প্রবল নির্যাতনের শিকার সে। বাবা তার মেয়েকে সুখি করতে শেষ সম্বল বাড়ি বিক্রি করে দেন। কিন্তু নিরুপমা টাকা দিতে বাধা দেয়। “টাকা যদি দাও তবেই অপমান। তোমার মেয়ের কি কোনো মর্যাদা নেই। আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম। না বাবা, এ টাকা দিয়ে তুমি আমাকে অপমান কোরো না”— এই সংলাপে নিরুপমার ব্যক্তিত্ব ঝলসে উঠতে দেখি। শেষ পর্যন্ত অবহেলায় নির্যাতনে মৃত্যু হয় নিরুপমার। শেষ দেখাও হয় না বাবার সঙ্গে। নিরুপমার চেয়ে হৈমন্তী মানসিকভাবে দৃঢ় চরিত্রের। সে সবকিছু হেসে উড়িয়ে দিলেও অপমানের যন্ত্রণায় ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। একসময় মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। কিন্তু ‘স্ত্রীর পত্রে’র বাঙাল বাড়ির মেয়ে মৃণাল এই নিপীড়নের গন্ডি থেকে বের হতে পেরেছিলো তার বুদ্ধিমত্তা ও প্রতিবাদ করতে পারার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব দিয়ে। কল্যাণীর বাবা শম্ভুনাথ তার মেয়েকে বর পক্ষের কাছে অপমানিত হতে দেননি। কল্যাণীর বিয়েতে পাত্র পক্ষের দাবি অনুযায়ী যৌতুকের টাকা ও অলংকার দিতে রাজি হন। বিয়ের আসরে পাত্রের মামা মেয়ের গা থেকে সকল অলংকার খুলে তা মেপে নিতে চায়। দেখা যায়, প্রতিশ্রুত পরিমাণের চেয়ে তিনি বেশি গহনাই দিয়েছেন। পাত্রপক্ষ সন্তুষ্ট হলেও শম্ভুনাথ বলেন “আমার কন্যার গহনা আমি চুরি করিব এ কথা যারা মনে করে তাদের হাতে আমি কন্যা দিতে পারি না”। মেয়ের বিয়ে না দিয়ে তিনি পাত্রপক্ষকে বিয়ের আসর থেকে বিদায় করে দেন।
নারীমুক্তির মশাল
রবীন্দ্রনাথ ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী চরিত্রে জীবনাগ্রহ, সূক্ষ্ম আত্মসচেতনতা, মর্যাদাবোধ, প্রেমাকাঙ্ক্ষা, বাসনার তীব্রতার জটিল রূপরেখাটি যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি বিধবাদের দ্বন্দ্বময় মনোজগতের পরিচয় তুলে ধরেছেন। স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথ ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস রচনা করলেও এখানেও তিনি নারী স্বাধীনতা ও তার অধিকার বিষয়ক কিছু জিজ্ঞাসা তুলে ধরেন। উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র বিমলা নারী স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এক নারী। রবীন্দ্রনাথ বিমলা চরিত্র নির্মাণে আবহমান বাঙালি নারীর রূপ যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি আধুনিক নারীর প্রতিরূপও নির্মাণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কুমু, যাকে রবীন্দ্রনাথ একটু একটু করে সৃষ্টি করেছেন শুদ্ধতম অনুভূতির কোমলতম মাধুরী দিয়ে। কুমু চরিত্র কেবল সনাতন নারী নয়, তার মধ্যে যুগপৎ আত্মস্বাতন্ত্রবাদী নারী চেতনাও বিদ্যমান। দাদার সান্নিধ্যে গড়ে উঠেছিল তার শিক্ষা, রুচি ও মূল্যবোধ। বিয়ের পরে কুমুর জীবনে ঘটে ছন্দপতন। রাত্রি যত গভীর হয়, ততই স্বামী “মধুসূদনের ভিতরকার উপবাসী জীবটা অন্ধকারে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। তাই অনিবার্যভাবেই শিক্ষিতা, সুন্দরী, তেজস্বী ও অভিজাত রুচির কুমু প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। ‘চতুরঙ্গে’র দামিনীকে রবীন্দ্রনাথ দ্রোহ এবং সৌন্দর্যের রং দিয়ে এঁকেছেন। “বিধবা দামিনী যেন শ্রাবণের মেঘের ভিতরকার দামিনী। বাহিরে সে পুঞ্জ পুঞ্জ যৌবনে পূর্ণ। অন্তরে চঞ্চল আগুন ঝিকমিক করিয়া উঠতেছে।” দামিনীর চরিত্রের মধ্যে দিয়ে বিধবা নারীর প্রেম ও যৌনতার অস্তিত্বকে নারীত্বের অনিবার্য অংশ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ এবং সেই সত্যই তৎকালীন সমাজে প্রচার করতে চেয়েছেন। ‘শেষের কবিতা’য় অমিতকে ফিরিয়ে দিয়ে লাবণ্য তার কাছে হয়ে থাকল ‘ভালবাসার দিঘি’; ‘ঘরে আনবার নয়’; যাতে কেবল সাঁতার কাটা যায়। সেসময়ে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট লাবণ্য চরিত্রটি যে কোনো রোমান্টিক পুরুষের স্বপ্নে পরিণত হয়েছে- যার ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ উপন্যাস ‘চার অধ্যায়’এর এলা চরিত্রের মধ্যে প্রণয়ন করেছেন যুক্তিবাদী আধুনিক মন আর বিজ্ঞানবাদী চেতনা। এই এলা জানে নারী জাতি আর পুরুষ জাতির মধ্যে পার্থক্য শরীরবৃত্তীয়। যে কারণে নারী পুরুষের মধ্যে মানসিক দূরত্ব না রেখে যে যার যোগ্যতা অনুযায়ী নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করলে পেয়ে যাবে নিজের আসন। পাশাপাশি এলাকে তিনি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ আদর্শ নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বর্তমান বাংলাদেশে কথাসাহিত্যিকদের চোখে রবীন্দ্রনাথের নায়িকারা
এ প্রসঙ্গে কথা বলেছিলাম বাংলাদেশের এ প্রজন্মের কয়েকজন লেখক ও কথাসাহিত্যিকের সঙ্গে। তাঁরা ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন, রবীন্দ্রসাহিত্যে তাঁদের পছন্দের নারী চরিত্রের কথা, যে চরিত্রগুলোকে তাঁরা এ সময়েও সমান প্রাসঙ্গিক ভাবছেন।
কিযী তাহনিন
রবীন্দ্রনাথকে ভালো লাগার মূল কারণটাই হচ্ছে তিনি কালোত্তীর্ণ যে কারণে এই একশ বছরের যাত্রা এবং রবীন্দ্রনাথ একই ভাবে তাঁর সৃজনশীলতা দিয়ে আমাদের মাঝে বিরাজ করছেন। তার রবীন্দ্রনাথ যে সময় লিখেছেন সে সময় বঙ্গভঙ্গ হচ্ছিলো। তিনি তাঁর চরিত্রগুলো অবশ্যই সে সময়ের প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন। কিন্তু সেই চরিত্রগুলোকে আমরা যখন বিশ্লেষণ করি, চরিত্রের ভেতর-বাহির তিনি যেভাবে দেখেছেন, যেভাবে আবিষ্কার করেছেন সেটা যেনো এই সময়েরই, আমার আশেপাশের মানুষেরাই। আমার দুই-তিনটা চরিত্রের কথা মনে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে উপস্থাপন করেছেন নারীচরিত্রকে ‘হৈমন্তী’র মাধ্যমে। হৈমন্তী প্রচন্ড সংবেদনশীল এবং অসম্ভব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ, মনস্তাত্ত্বিক জায়গা কিংবা ব্যক্তিত্বের জায়গা থেকে। ছোটবেলায় সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখে, আমার কাছে হৈমন্তীর আগেও যে চরিত্রটাকে খুব ভালো লেগেছিল, মনে হয়েছিল যে অন্দরে বিরাজ করা এমন একজন মানুষের প্রগতির গল্প, তার নিয়ম ভাঙ্গার গল্প সেটা হচ্ছে ‘নষ্টনীড়’; যেটি ‘চারুলতা’ নামে সিনেমা হয়েছিলো। এত ধরনের বৈচিত্র্য সেখানে! এটাকে আমি কখনো মোটা দাগে দুটো মানুষের অসম সম্পর্ক বা দেবর ও বৌদির সম্পর্ক হিসেবে দেখিনি। এটা আমি যতবারই দেখি, মনস্তাত্ত্বিক জায়গা থেকে দেখি। চারুলতা নামক একজন নারীর ভেতর থেকে বাইরের জগতে বের হয়ে আসার ইচ্ছা এবং ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ, তার প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব যেটা রবীন্দ্রনাথের গল্পের বা উপন্যাসের মূল আকর্ষণ আমার কাছে মনে হয়, যেখানে নারীরা খুব দীপ্ত এবং ব্যক্তিত্বময় হয়ে ওঠে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে। এরপর যে সিনেমাটি দেখেছিলাম এবং পরবর্তীতে সেই গল্পটা আমি অনেকবার পড়েছি ও নতুন মাত্রায় আবিষ্কার করেছি – ‘ঘরে বাইরে’র বিমলা। আমার কাছে এখনকার ক্ষেত্রেও তাকে সাহসী মনে হয়। এমন একটি চরিত্র যার মধ্যে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ জাগ্রত হলো। সে নানা ধরনের সম্পর্কের দরজা খুলল। এই যে নানা ধরনের ক্রাইসিস, আমি বলব না যে এই চরিত্রটির খুব সফল পরিণতি দেখানো হয়েছে। কিন্তু আমরা আসলে সব সময় দেখি যে সাহিত্যে নারী চরিত্রকে সেইসময়ে এমনকি এখনো আসলে কোন সংঘাতে বা কোন ক্রাইসিসে ফেলা হয় না, যেটা হয় সেটা খুবই তথাকথিত। যেমন নারীর বিয়ে, তার যৌতুক, তার বিবাহিত জীবন নিয়ে সংঘাত। কিন্তু তার মনস্তাত্ত্বিক যে সংঘাত সেটা নিয়ে আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের মত এখনো পর্যন্ত কেউ ভাবেননি। বিমলা হচ্ছে এর একটি উদাহরণ। এছাড়া আমার একটা খুব প্রিয় চরিত্র, ‘অপরিচিতা’র কল্যাণী। এই সময়ে এসেও কেউ চিন্তা করতে পারেনা যে একজন নারী বিয়ে না করে একাকী, আনন্দে এবং আপন আলোয় আলোকিত করে জীবন যাপন করবে। সেখানেও তাকে যে সংঘাত পোহাতে হয় রবীন্দ্রনাথ ঐ সময়েই সেটা ভেবেছেন। তারপর ‘রক্তকরবী’র নন্দিনী, ‘মধ্যবর্তিনী’র যে দুটো নারী চরিত্র হরসুন্দরী ও শৈলবালা, সেখানেও মনস্তত্ত্বের যে সংঘাত দেখতে পাই সেটাও আমাকে ভাবায়। এজন্যই আমার কাছে মনে হয় যে তিনি শুধু এখনো যে আধুনিক তা নয়, একজন গল্পকার, কথাসাহিত্যিক হিসেবে আমার বিশ্বাস, আজ থেকে আরও পঞ্চাশ বছর পর কি আরও একশ বছর পরেও যখন মানুষ পড়বে প্রেক্ষিত যেটাই হোক না কেন তাঁর চরিত্রগুলো কিন্তু ভাবাবে এবং আলো ফেলবে পাঠকের মনে। কারণ তাঁর চরিত্রগুলোর অনেক বৈচিত্র! এত বৈচিত্রময় নারী চরিত্র আর কেউ লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
তারিক মনজুর
বহু বিচিত্র নারীর দেখা মিলবে রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যে। এর মধ্যে বেশ কিছু নারী চরিত্র সম্পর্কে বলা যেতে পারে, তারা সময়ের চেয়ে অগ্রসর। একশ বছর পেরিয়েও তারা আধুনিক। তাহলে স্বীকার করে নিতে হয়, রবীন্দ্রনাথ যে নারী চরিত্রগুলো তৈরি করেছেন, তারা ঠিক লেখকের কালের নয়। তবে আমার কাছে মনে হয়, এসব স্বাধীনচেতা নারী, লেখকের চূড়ান্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে শেষপর্যন্ত সমাজের প্রচলিত গণ্ডিকে অতিক্রম করতে পারেনি। যেমন, ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের বিধবা রমণী বিনোদিনী পারতো মহেন্দ্রকে নিয়ে ঘর করতে। কিন্তু বৈধব্যের সামাজিক সীমাবদ্ধতাকে সে মেনে নিয়েছে। আবার, কুমুদিনী ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের প্রায় পুরোটা জুড়ে বিদ্রোহের চরম প্রতিমূর্তি হয়ে উপস্থিত ছিল। কিন্তু গর্ভধারণের পর সে আপোস করেছে স্বামী মধুসূদনের সংসারে ফিরে যেতে। আবার, ‘পয়লা নম্বর’ ছোটোগল্পের অনিলা গোপন প্রেমে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারতো, জমিদার সিতাংশুমৌলীর সাথে চলেও যেতে পারতো। কিন্তু সে নিজেকে গোপন করে ফেলল স্বামী-সংসার থেকে। সুতরাং, সমাজে থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজবাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারেননি। তবে, তিনি গল্প-উপন্যাসে নারীর স্বাধীন মনোজগত তৈরি করে প্রকৃতপক্ষে সমাজের নারীদের মনের স্বাধীনতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
পিয়াস মজিদ
প্রথমে আমি বলতে চাই ‘হৈমন্তী’ চরিত্রটির কথা। একটা সময়ে আমাদের মনে হয়েছিল চরিত্রটি কেনো এতটা আপসকামী, কেনো শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা নির্বিচারে মেনে নিচ্ছে? শুধু সমর্পণ কেন থাকবে, প্রতিরোধ কেন থাকবে না? এখন জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারি যে রবীন্দ্রনাথ অনেক বড় শিল্পী। তিনি সমাজকে যেমন জানেন তেমনি বাঙালি নারীকে সমাজের বাস্তবিক প্রতিরূপ হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। বাঙালি সমাজের যেটা পরিণতি কিংবা নিয়তি সেটাই তিনি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন গল্পে। আমরা দেখি হৈমন্তীর স্বাচ্ছন্দের সঙ্গে তার বাবার সম্মান জড়িয়ে আছে। বাবা অসম্মানিত হোক সেটা হৈমন্তী চায় না। এখনো তো আমরা তাই দেখি। সময় অনেক পাল্টেছে, শতাব্দী চলে গেছে কিন্তু ব্যাপারটা একইরকম রয়ে গেছে। নারীরা এখনও দাম্পত্য জীবনে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন প্রকাশ্যে অথবা গোপনে। হয়তো যৌতুকের বিষয়গুলো আগের মত আর নেই, যৌতুক বিরোধী আইন হয়েছে, অনেক কিছুই হয়েছে কিন্তু এই বিষয়গুলো রয়ে গেছে। এই মেনে নেয়ার বিষয়ে পাঠক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের উপর আমার একটা অনেক বড় ক্ষোভ ছিল যে কেন তিনি হৈমন্তীকে এভাবে আঁকলেন। কেন সে এত অসম্মানিত হচ্ছে! কিন্তু যে সমাজে এটাই স্বাভাবিক তাকেও রবীন্দ্রনাথ অস্বীকার করতে চাননি। তিনি সমাজের চিত্রটা এঁকেছেন এবং সেই সঙ্গে বুঝেছেন সমাজ বদলের দায়িত্ব কিন্তু নারীরই। আমার মনে হয় যে এখনো হৈমন্তী চরিত্রটি খুবই প্রাসঙ্গিক। হৈমন্তীকে যারা গঞ্জনা দিয়েছে, মেয়ের বয়স নিয়ে খোঁটা দিয়েছে, ‘ডাল-রুটি খাওয়া মানুষ’ ইত্যাদি বলছে তারাও কিন্তু নারী এবং তারা পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখছে। তার মানে নারী হলেই যে সে নারীর সহযোগী হবে বা নারীর ভালো চাইবে তা কিন্তু নয়। ‘শাস্তি’ গল্পের চন্দরা একটি বিপ্লবী চরিত্র। যদিও দেখানো হয় শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকেই মেনে নিতে হয় চন্দরাকে। গল্পে চন্দরার স্বামীর একটা সংলাপ ছিল, “ঠাকুর, বউ গেলে বউ পাইব কিন্তু আমার ভাই ফাঁসি গেলে আর তো ভাই পাইব না।” এ গল্পে রাগের বশে বড় ভাই তার স্ত্রীকে মেরে ফেলে এবং সেই দায় চাপিয়ে দেয়া হয় ছোট ভাইয়ের বউয়ের উপরে। কিন্তু স্বামীর এ কথা শোনার পরে স্ত্রী চন্দরা স্তব্ধ হয়ে যায়। সে কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারতো। তাকে ফাঁসি দেয়ার আগে তার ইচ্ছের কথা জিজ্ঞেস করা হলে সে তার মাকে দেখতে চায়। এরপরে যখন তাকে বলা হয় যে তোমার স্বামী তোমার সাথে দেখা করতে চায়, তখন সে বলে “মরণ!” এ কারণেই চন্দরাকে আমি একটি বিপ্লবী চরিত্র মনে করি। হিন্দু শাস্ত্র মতে সাত পাকে ঘুরে অথবা আমাদের মুসলিম রীতিতে যেভাবে বিয়ে হয় তাতে পুরো জীবন সমর্পণ করে দেয়ার একটা বিষয় থাকে। কিন্তু যখন একজন নারী দেখে যে সেই বৈবাহিক সম্পর্কে তার মূল্য নাই, তার অস্তিত্বের মূল্য আসলে তার স্বামীর কাছে নেই, সে সেখানে একটা পুতুল মাত্র, তখন সে তার নিয়তিকে মেনে নেয়। তার কাছে মৃত্যুটাই এখানে শ্রেয়। সে কারণেই শেষে তার অমোঘ উচ্চারণ ছিল ‘মরণ’। এর সাথে ইবসেনের নোরা চরিত্রের মিল পাওয়া যায়, যখন সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় পুতুলের সংসার, ‘ডলস হাউস’ থেকে। একজন সাহিত্য সমালোচক বলেছিলেন নোরার যে দরজা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া পুতুলের সংসার থেকে যেখানে তার অস্তিত্বের মূল্য নেই, এই দরজার ধাক্কা দেওয়াটা ওয়াটারলুর কামানের ধ্বনির চাইতে তাৎপর্যপূর্ণ। অস্তিত্ববাদের ক্ষেত্রে চন্দরা চরিত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরপর বলতে পারি ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসের এলার কথা। এলা চরিত্রটিতে আমাকে আকর্ষণ করেছিল পুরুষ চরিত্রগুলোর সাথে তার কথোপকথন। এর সাথে বলতে পারি ‘ঘরে বাইরে’র বিমলার কথা। বিপ্লবী রাজনীতি এবং স্বদেশী আন্দোলনের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব কিছু চিন্তা ছিল। যেমন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পন্থা নিয়ে আমরা জানি যে রবীন্দ্রনাথের আপত্তি ছিল। সহিংসতা তিনি পছন্দ করতেন না এক্ষেত্রে গান্ধীজীর সাথে তার চিন্তার মিল ছিল। সবাই যখন স্বদেশী আন্দোলন করছে, বিলেতি পন্য বর্জন করছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে। তখন আমরা দেখি যে এলা বা বিমলার সমর্থন থাকে ওই বিপ্লবী চরিত্রগুলোর প্রতি। কিন্তু বিপ্লবের যে পন্থা সেটা নিয়ে তাদের আপত্তি থাকে। একই সাতে তাদের প্রেমিকদের প্রতি তাদের একটা হৃদয়গত সম্পর্ক থাকে কিন্তু ওই চিন্তাগত জায়গায় বা তাত্ত্বিক জায়গায় তারা সমর্থন দেয় না। এই উপন্যাসগুলো যখন বেরিয়েছে তখন ভারতবর্ষের সরোজিনী নাইডু, সরলা দেবী চৌধুরানী তাঁরা আসছেন। রবীন্দ্রনাথের পরিবারের যেসব নারীর ছিলেন তাঁরা তখন চিন্তা করেছেন, আন্দোলন করছেন এদের একটা বড় প্রভাব ছিল রবীন্দ্রনাথের উপর। বিমলা এবং এলার স্বদেশী আন্দোলন এবং বিপ্লবী আন্দোলনের পন্থা নিয়ে পুরুষ চরিত্রের সাথে একের পর এক তর্ক উপস্থাপন করা, নিজস্ব মতামত উপস্থাপন করা আমি মনে করি এটি ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশক। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে যদি দেখেন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে প্রত্যেকটা জায়গায় আশ্চর্যজনকভাবে কোন না কোন সময়ে নারীরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে। এবং তারা বিভিন্ন বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কথা সবসময় এটাই যে ভালবাসার মধ্যে দাম্ভিকতা থাকবে, ভালোবাসার নির্বিচারে সে মেনে নেবে না এবং এটাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। রবীন্দ্রনাথের ‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পে শৈলবালা তাদের শয্যার মাঝখানে শুয়ে থাকে এই জিনিসটা আমাকে খুবই বিস্মিত করে। বহু মনীষীরাই বলেছেন যে এটা ভাবাই যায় না যে রবীন্দ্রনাথ হরসুন্দরী নামক এই নারী চরিত্রের মনে কিভাবে ঢুকলেন! আমি মনে করি সংবেদনশীলতা না থাকলে কোন বড় লেখক হওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ নারী-পুরুষের প্রতি সমানভাবে সংবেদনশীলতা দেখিয়েছেন। তাঁর গল্পগুলোতে কোথাও অতিকল্পনার স্থান নেই। কিন্তু মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জায়গা, মানবতাবোধকে তিনি দেখিয়েছেন। মানুষ তো আর দানব নয়, তার মানবিক যে বৈশিষ্ট্যগুলো রয়েছে সেগুলোকে তিনি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘একরাত্রি’ গল্পের কথা যদি ধরি, যে নারী চরিত্রটি উপস্থিত নেই বা মৃত তাকেও তিনি চরিত্র করে তুলতে পারেন। ‘মধ্যবর্তিনী’র ক্ষেত্রে একটা বড় দৃষ্টান্ত, মানুষটা চিতার আগুনে ছাই হয়ে গেছে কিন্তু সে বিছানার মাঝখানে একটা কাঁটার মত রয়ে গেছে দুজন মানুষের মাঝখানে। এমনকি তাঁর কবিতার ভিতরেও অনেক নারী চরিত্র রয়েছে যারা অত্যন্ত জীবন্ত। যেমন তাঁর ‘বাঁশি’ কবিতায় একটি সাধারন মেয়েকে আঁকা হয়েছে, “পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর” শুধু এই একটি লাইন দিয়ে।
বর্ণালী সাহা
বহু মহৎ কথাসাহিত্যিককেও যেমন নিজের সময়ের সন্তান হিসাবে বিদিত হতে হয়, নিজের কালের এবং সমাজবাস্তবতার সীমাবদ্ধতার নিরালম্ব বলি হতে হয়, রবীন্দ্রনাথকেও তেমনটা হতে হয়েছিল বলে আমি মনে করি। নারীর তৎকালীন বাস্তবতার চিত্রায়ণে রবীন্দ্রনাথের যেমন জুড়ি মেলা মুশকিল, নারীর ভবি নির্ধারণে তাঁর দ্বিধা, সংকোচ, এমনকি এক প্রকারের ভীতিও আমি অনুভব করতে পারি। অথচ কে না জানে যে কথাসাহিত্যিকের কাজ শুধু শাদা চোখে দেখার বাস্তবতাকে দেখানো নয়, চরিত্রদের ভবি নির্ধারণ করে দেওয়াও? নারীর মনস্তত্ত্বকে সখার চোখ দিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন ঠিকই; কিন্তু নারীর পরিপূর্ণ জগৎকে ঈশ্বরের হাত দিয়ে ভাঙা বা গড়ার সাহস করেছেন কি? রবীন্দ্রনাথের কাদম্বিনীকে যে ‘মরিয়া’ প্রমাণ করতে হলো যে সে মরে নাই, এই ঘটনার সাথে, নিজেকে জীবিত প্রমাণ করার জন্য কাদম্বিনীকে বাধ্য হয়ে ‘মরিতেই হইল’ – এই ঘটনার পার্থক্য কোথায়? ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পটি একটি সার্থক গল্প – তার সাথে-সাথে জীবন ও মৃত্যুর অবধারিত বৃত্তে চক্কর কাটতে থাকা নারীর মানবিকীকরণেরও আখ্যান। কিন্তু এহেন জীবন ও মৃত্যুর চাপে বিলীন হয়ে যাওয়া অসহায় সত্তার বাইরে এই গল্পে ‘নারী’ কই? – এমন প্রশ্ন আমার আধুনিক মন করতে বাধ্য হয়। তুলনায় ভয় পাই, তবু স্বীকার করতেই হবে যে বিভূতিভূষণের দ্রবময়ী বরং এই বৃত্তের ভিতরে আটকা পড়েও গাল দিতে-দিতে চক্কর কাটতে থাকা এক অবিস্মরণীয় নারী। সে যুগপৎ বৃদ্ধা ও স্বৈরিণী। এই চরিত্র বিভূতি পেলেন কোথায়? তাঁর সমকালীন সমাজে? না কি কল্পনায়? আমি দ্রবময়ীর মধ্যে একজন আধুনিক চিন্তাচেতনায় অক্ষম, অথচ নিদারুণ স্বাধীন মানুষ দেখতে পাই। এই মানুষ চিরকালীন। রবীন্দ্রনাথের স্বৈরিণী রূপ নাই বললেই চলে (থাকলেও নিজের কলম দিয়েই তিনি তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-অপমানে জর্জরিত করা কিম্বা সামান্য ক্যারিকেচারে ছোট করে আনার লোভ সামলাতে পারেন নাই: ‘শেষের কবিতা’য় কেটি-সিসি-লিসি ত্রয়ী তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ)। স্বৈরিণীরূপের কথা আলাদা করে এই জন্য বললাম যে রবীন্দ্রজগতে নারীর ‘শাশ্বত’ রূপের মধ্যে যেন ওইটা ঠিক জায়গা পায় না, যতখানি জায়গা পায় কল্যাণীরূপ। যোগমায়ার বাড়ি থেকে অমিত রায়ের দেওয়া আংটি খুলে ফেলে কেতকীর কাঁদতে-কাঁদতে ছুটে যাওয়ার দৃশ্যেও রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনে করিয়ে দিতে ভোলেন না যে কেতকীর মুখখানি ‘এনামেল করা’। ‘দুই বোন’ উপন্যাসে পাই, মা যেন বর্ষা ঋতু, ‘জলদান করেন, নিবারণ করেন তাপ, ঊর্দ্ধলোক থেকে আপনাকে দেন বিগলিত করে, দূর করেন শুষ্কতা, ভরিয়ে দেন অভাব।’ অন্যদিকে প্রিয়া যেন বসন্ত ঋতু, ‘গভীর তার রহস্য, মধুর তার মায়াতন্ত্র, তার চাঞ্চল্য রক্তে তোলে তরঙ্গ, পৌঁছায় চিত্তের সেই মণিকোঠায়, যেখানে সোনার বীণায় একটি নিভৃত তার রয়েছে নীরবের ঝঙ্কারের অপেক্ষায়, যে ঝঙ্কারে বেজে ওঠে সর্বদেহমনে অনির্বচনীয় বাণী।’ ঐশ্বরিক সহ্যশক্তি এই দুই প্রকৃতির স্ত্রীলোকেরই অলঙ্কার – উচ্চক্রমে বললে, মৃণাল-মালতী-কুমু। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের দামিনীকে অবশ্য এরমধ্যে ধরছি না। দামিনী আমার অত্যন্ত প্রিয় চরিত্র; রবীন্দ্রনাথের ‘আধুনিকতম’ উপন্যাসের চরিত্র হিসাবে কেতকী এবং লাবণ্য সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে বড় অপচয়ও। আমার বিবেচনায় এই চরিত্র দুইটি তাঁর প্রাসঙ্গিকতম নারী চরিত্র হতে পারতো।