ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিন মামলায় সাত মাস কারাগারে থেকে ২০২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর জামিনে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশি ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল এখন ‘বেকার’। মামলা তিনটির বিচার কার্যক্রমে হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দিলেও ‘২৪ ঘণ্টা পুলিশি নজরদারির’ অভিযোগ তুলে কাজল ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন, কোথাও চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন না তিনি।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিন মামলার (স্থগিত) পাশাপাশি কাজলের বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের আরেকটি মামলা চলমান। এই মামলায় ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখ সর্বশেষ হাজিরা দিয়েছেন তিনি। মামলাগুলোর শুনানির জন্য নতুন তারিখ পাওয়ার চেষ্টা করছে রাষ্ট্রপক্ষ।
কাজল যেভাবে গ্রেপ্তার হন
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের প্রশাসন ক্যাসিনো-টেন্ডারবাজি-আধিপত্য বিস্তারসহ নানা অপরাধের বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করে। ওই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হন। প্রায় বছর খানেক এই অভিযান অব্যাহত ছিল। সেই দিনগুলোতে কাজল ফেসবুকে এসব বিষয়ে লেখালেখি করেন।
এক সময় বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক সমকাল’ ও ‘বণিক বার্তায়’ ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ করা কাজলের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথম মামলা হয় ২০২০ সালের ৯ মার্চ। মামলাটি করেন মাগুরা-১ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর। শেরেবাংলা নগর থানার এই মামলায় কাজলসহ ৩২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। একই ঘটনায় ১০ মার্চ ঢাকার হাজারীবাগ থানায় মামলা করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ওসমান আরা বেলী। ১১ মার্চ যুব মহিলা লীগের আরেক সদস্য সুমাইয়া চৌধুরী বন্যা কামরাঙ্গীরচর থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন। পরে তিন মামলাতেই শুধুমাত্র কাজলের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। প্রথম মামলা হওয়ার পরদিন অর্থাৎ ১০ মার্চ বকশীবাজারের বাসা থেকে বেরিয়ে ‘নিখোঁজ’ হন কাজল।
পরে পরিবারের পক্ষ থেকে একটি অপহরণ মামলা করা হয়। এজাহারে অভিযোগ করা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখির কারণে অজ্ঞাতনামা কেউ তাকে ‘অপহরণ’ করেছে।
প্রায় দুই মাস পর ভারত-বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্ত থেকে কাজলকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তার বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ আনা হয়।
যশোর থেকে কাজলকে ঢাকায় এনে ২০২০ সালের জুন মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
আদালতে নেওয়ার সময় কাজলের পিছমোড়া করে হাতকড়া পরানো একটি ছবি গণমাধ্যমে আসার পর দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, একনাগাড়ে ৫৩ দিন চোখ বাঁধা অবস্থায় রাখা হয় কাজলকে।
মামলার অবস্থা
সর্বশেষ যশোর আদালতে হাজিরা দিয়েছেন জানিয়ে কাজল ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘সর্বশেষ ট্রেসপাসের মামলায় (অবৈধ অনুপ্রবেশ) ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখ যশোর কোর্টে হাজিরা দিয়েছি। মামলাটি এখন হাইকোর্টে আছে। শুনানির তারিখ পাইনি।’’
‘‘আমার বিরুদ্ধে মোট মামলা ছিল পাঁচটি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (স্থগিত) তিনটি, ট্রেসপাসের একটি বাদে আরেকটি বিশেষ ক্ষমতা আইনে। এরমধ্যে প্রথম চারটি চলমান।’’
‘মামলায় অসঙ্গতি’, ‘যারা মামলা করেছে আইনগতভাবে তাদের করার এখতিয়ার নেই’ এবং ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মামলা করতে যে নিয়মকানুন অনুসরণ করা উচিত ছিল সেটি করা হয়নি’-এমন তিনটি পৃথক ফৌজদারি আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি এ এস এম আবদুল মবিন ও বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০২২ সালের ১ জুন মামলা তিনটির বিচার কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেন। তিন মামলায় নিম্ন আদালতের অভিযোগ গঠনের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কাজল এসব আপিল করেছিলেন। আদালতে কাজলের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী।
স্থগিত থাকা তিন মামলার বিষয়ে ভয়েস অফ আমেরিকার প্রশ্নের জবাবে বেশি কিছু বলতে চাননি কাজলের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ‘‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিন মামলা আপিলে স্টে অবস্থায় রয়েছে। এখনো শুনানি হতে দেরি আছে। এই মুহূর্তে আর কিছু বলার নেই। ’’
মামলাগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিন মামলা স্থগিত হওয়ার পর পুনরায় হিয়ারিংয়ের জন্য হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছে। হাইকোর্ট এখনো রিসিভ না করায় শুনানি হচ্ছে না। রবিবার (৩০ এপ্রিল) কোর্ট খুলেছে। এরপর যেকোনো একটি কোর্টে আসবে। খুব সম্ভবত বিচারপতি এ এস এম আবদুল মবিন, যিনি স্টে অর্ডার দিয়েছিলেন তার কোর্টে আসবে। তখন নতুন করে মামলা তিনটির পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করা হবে।’’
যেমন আছেন ‘বেকার’ কাজল
‘‘কেমন আছেন’’-ভয়েস অফ আমেরিকার এমন প্রশ্নের জবাবে কাজল বলেন, ‘‘সবসময় সমস্যার মধ্যে আছি। ২৪ ঘণ্টাই আমার ওপর প্রশাসনের নজরদারি চলে। আমি তো পেশাদার সাংবাদিক। কোনো কাজকর্ম নেই। কাজ করার মতো কোনো সুযোগও নেই। আবার আমার সাহসেও কুলায় না। ’’
‘বিতর্কিত’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিলুপ্তি চেয়ে কাজল বলেন, ‘‘প্রথমে ডিজিটাল আইন বিলুপ্ত করতে হবে। আমি মনে করি দেশবাসী এবং সাধারণ মানুষের জন্য এটা একটা ভয়ংকর আইন। এই আইন মানুষকে বন্দি করে ফেলেছে। কেউ মত প্রকাশ করতে পারে না, কথা বলতে পারে না। এটা কোনো আইন হতে পারে না।’’