২০১২ সালে ‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের' অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের যে প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক সরে দাঁড়িয়েছিল, প্রায় এক যুগ পর সেই পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করে তারই একটি ছবি ঐ সংস্থার প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসের হাতে তুলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সদরদপ্তরে ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কের ৫০ বছর’ উদযাপন অনুষ্ঠানের শেষে তিনি ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবিটি তুলে দেন।
এসময় তিনি বলেন, “আমি ছবিটি উপহার দিলাম কারন আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল তা মিথ্যা ছিল। আমি এটাকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। এবং কানাডার আদালতেও এটা প্রমান হয়েছে যে কোনো ধরণের দুর্নীতি হয়নি।“
২০১২ সালে পদ্মা সেতুর ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্ব ব্যাংক। অভিযোগ ছিল সেতুর কাজ পেতে বাংলাদেশি ও কানাডিয়ান ফার্মের কর্মকর্তা ও কিছু ব্যক্তি ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্র করেছে এমন প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে।
কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনের শীর্ষস্থানীয় তিন জন কর্মকর্তার ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের কথা সামনে আসে, ফলে বিষয়টি কানাডীয়ান আদালতে গড়ায়। কিন্তু আদালত কোনো ধরনের দুর্নীতির প্রমাণ পায় নি।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী তার পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেন, যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো। গত বছর জুনে রাজধানী ঢাকার সাথে দক্ষিণ অঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপনকারী এই সেতু উদ্বোধন করেন তিনি।
১মে বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ‘রিফ্লেকশন অন ফিফটি ইয়ার্স অব ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-বাংলাদেশ পার্টনারশিপ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট এইচ ই ডেভিড ম্যালপাসের আমন্ত্রণে অংশ নেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দিনের শুরুতেই ছিল A Journey Together শীর্ষক ছবির প্রদর্শনী। যেখানে একটি মাল্টিমিডিয়া প্রজেকশনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে অংশীদারিত্বের ৫ দশকের বিভিন্ন দিক।
অনুষ্ঠানে The World Bank Bangladesh Club এর পক্ষ থেকে তরুণ শিল্পীদের দেশীয় নৃত্য পরিবেশনায় আলোকিত হয় বিশ্বব্যাংক ভবনের এইট্রিয়াম ।
বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক অংশীদারিত্বের ৫০ বছরের প্রতিফলন নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে বক্তব্য রাখেন বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ম্যালপাস বলেন বলেন, "বাংলাদেশের গল্প উচ্চাকাঙ্খা ও রেজিলিয়েনসের গল্প। ধারাবাহিকভাবে দেশটি পরিবর্তিত হয়েছে এবং চ্যালেঞ্জগুলি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে।" বাংলাদেশকে সংঘাত ও ভঙ্গুরতা থেকে বের করে আনতে প্রধানমন্ত্রীর বিশাল অবদানের কথা বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, "আমরা এখান থেকে ভিক্ষা নেই না। আমরা ঋণ নেই। এবং তা সুদ সমেত ফেরত দেই । বিশ্বব্যাংকের অংশীদার হিসেবে এটা আমাদের অধিকার।"
তিনি বাংলাদেশের অগ্রগতি ও সামনের দিনের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে বলেন, "বাংলাদেশ নির্বিঘ্নে এগিয়ে যাবে। এখানে আমার উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে আমরা বিশ্বব্যাংকের প্রতি আমাদের আস্থা বজায় রাখছি।"
"আগামী দুই দশকে আমাদের সাফল্য নির্ভর করবে আমাদের সম্মিলিত সক্ষমতা এবং উদীয়মান চ্যালেঞ্জগুলোকে ন্যায্য ও টেকসই উপায়ে অতিক্রম করার প্রচেষ্টার উপর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সোনার বাংলায় পিছিয়ে থাকা আমাদের কোটি কোটি মানুষকে সুখী জীবনযাপন করতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।," বলেন তিনি।
সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ও ভুটানের বিশ্বব্যাংক কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক।তিনি বলেন “আজ আমরা বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংক গ্রুপকে নিয়ে গর্ব করি”। তিনি উনার স্বাগত বক্তব্যে বর্তমান এবং প্রাক্তন কান্ট্রি ডিরেক্টরদের তাদের ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানান।
আরও বক্তব্য রাখেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কৌশিক বসু। তিনি বলেন, "এটি অর্ধ শতাব্দীর একটি দুর্দান্ত পার্টনারশিপ। সব সম্পর্কের মতো এই সম্পর্কেও উত্থানপতন ছিল। তিনি বলেন উনার ২০১৫ সালের বাংলাদেশ সফরে দৃষ্টিকোণের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও সেটি একটি অসাধারণ সফরে পরিণত হয়েছিল। তিনি বলেন, অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য বাংলাদেশের সফলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।"
বিশ্বব্যাংক দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার উনার বক্তব্যে বলেন, "বাংলাদেশের গল্প আশা, দৃঢ়তা ও শক্তির গল্প। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। কিন্তু দেশটির জনগন পরিস্থিতি দ্বারা সংজ্ঞায়িত হতে অস্বীকার করে এবং প্রমাণ করেছে যে দারিদ্র্য নিয়তি নয়।"
বিশ্বব্যাংককে প্রধানমন্ত্রীর পাঁচটি পরামর্শ
সামনের দিনের উন্নয়ন অপরিহার্যতা বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী পাঁচটি সুনির্দিষ্ট পরামর্শও দিয়েছেন ।
প্রথমত, চলমান বিশ্বব্যাপী একাধিক সংকট যথা মহামারী, সশস্ত্র সংঘাত এবং জলবায়ু জরুরি অবস্থা বেশিরভাগ উন্নয়নশীল অর্থনীতিকে মারাত্মক চাপের মধ্যে ফেলেছে। তারপরও কিছু উন্নয়ন অংশীদার তাদের মূল যায়গা থেকে সরে এসে ঋণের খরচ এবং সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে । আমি বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে কার্যকর বিকল্প খুঁজে বের করার আহ্বান জানাচ্ছি যাতে আমাদের মত অর্থনীতি উদীয়মান চ্যালেঞ্জগুলো আরও ভালভাবে মোকাবিলা করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে জাতিসংঘের এলডিসি মর্যাদা থেকে টেকসই উত্তরনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি বিশ্বব্যাংককে আমাদের মানবসম্পদ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়ন কর্মসূচিগুলোকে একটি মসৃণ উত্তরণের জন্য সহায়তা করার জন্য অনুরোধ করছি। গুরুত্বপূর্ণ ‘আইডিএ‘ উইন্ডোটি চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জাতীয় আকাঙ্খার সাথে জাতিসংঘের এসডিজিগুলোকে সমন্বয় করেছে। বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদাররা এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য সহজে উদ্ভাবনী অর্থায়ন সরবরাহ করবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
চতুর্থত, বাংলাদেশ আশা করে যে জলবায়ু সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে বিশ্বব্যাংকের সম্পৃক্ততা প্যারিস চুক্তির অধীনে অর্থায়নের যে ঘাটতি তা পূরণে সাহায্য করবে। জলবায়ু প্রশমন এবং অভিযোজনের মধ্যে অর্থায়নের সমান বণ্টনের গুরুত্বের ওপর জোর দেন তিনি।
পঞ্চম, ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ অবকাঠামো ও লজিস্টিকসে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখবে। আমি আশা করব বিশ্বব্যাংক আগামী বছরগুলোতে আমাদের ভৌত ও সামাজিক উভয় মেগা-প্রকল্পে নিয়োজিত থাকবে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় যোগদান করেন এবং বলেন "বাইরের চাপে" সংস্থাটি পদ্মা সেতু অর্থায়ন থেকে সরে যায়।
বিশ্বব্যাংকে পৌঁছে একটি ছবি প্রদর্শনীও উদ্বোধন করেন তিনি, যেখানে বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের অগ্রযাত্রা তুলে ধরা হয়।
বিশ্বব্যাংকের সামনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি মুখোমুখি
প্রধানমন্ত্রী যখন বিশ্বব্যাংকের ভিতরে নানা কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছিলেন, তখন বাইরে বাংলাদেশের বিরোধীদল বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা কর্মীরা বিক্ষোভ করছিল। তারা সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে।
এসময় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা 'জয় বাংলা' সমাবেশ করে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
(এই প্রতিবেদন তৈরিতে সাহায্য করেছেন নূরুল ইসলাম হাসিব এবং সাবরিনা চৌধুরী।)