ভারতের কর্নাটক রাজ্যে চলতি বছরের দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষায় কলা (আর্টস) বিভাগে প্রথম হয়েছেন ১৭ বছরের কিশোরী তবাসসুম শাইক। ৬০০-র মধ্যে ৫৯৩ নম্বর পেয়েছেন তিনি। কিন্তু শুধু এই ফলাফল নয়, অন্য কারণেও তিনি বিশেষভাবে শিরোনাম তৈরি করছেন।
গত বছর, ২০২২-এ কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুতে হিজাব আন্দোলনে তবাসসুম ছিলেন প্রতিবাদী অর্থাৎ হিজাব পরে ক্লাস করতে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলনকারী মেয়েদের অন্যতম। একটা সময় প্রতিবাদে বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
এই ফলাফলের সুবাদে পুনরায় সংবাদমাধ্যমের নজরে আসা তবাসসুমকে নিয়ে আলোচনায় নয়া মাত্রা পেয়েছে কর্ণাটক রাজ্যের হিজাব আন্দোলনের প্রসঙ্গ।
পরীক্ষার সাফল্য প্রসঙ্গে তবাসসুম জানিয়েছেন, বাবা-মায়ের একটি কথাই তাঁর ভাবনা বদলে দিয়েছিল। বলেছেন, "প্রতিবাদে স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে বহুদিন বাড়িতে বসে ছিলাম। একটা সময় মানসিক চাপ নিতে পারছিলাম না। বাবা-মা তখন বলেছেন, পড়াশুনোর ব্যাপারে কোনও শর্ত আরোপ করা চলে না। পড়াশুনো বন্ধ করে দিলে ভবিষ্যতের প্রতি অন্যায় করা হবে।"
তবাসসুমের বাবা আবদুল খায়উম শাইক পেশায় ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার। মা পারভিন গৃহবধূ। চার বছরের বড় দাদা আবদুল কালাম মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।
তবাসসুম জানিয়েছেন, ‘"বাবা-মা-দাদার পরামর্শে একদিন স্কুলে ফিরলাম। অবশ্যই হিজাব ছাড়া। খুব খারাপ লাগছিল। আমি পাঁচ বছর বয়স থেকে হিজাব পরি। পোশাকটা আমার ভাল লাগে। একটা অধিকার জন্মে গিয়েছিল। হিজাব না পরে স্কুলে যেতে তাই খুব কষ্ট হয়েছে।’
সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তবাসসুম বলেছেন, ‘"সহপাঠীরা অনেকেই টোন টিটকিরি করত। সুযোগ পেলেই মুসলিম মেয়েদের হিজাব নিয়ে খোঁচা দিত ক্লাসে, ক্লাসের বাইরে।" তাঁর কথায়, "সব মুখ বুঝে সহ্য করেছি, বাবা-মায়ের সেই কথাটি মাথায় রেখে—হিজাব পরতে না দিলে মুসলিম মেয়েরা পড়াশুনো ছেড়ে দেবে বলেই হয়তো এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদের নামে পড়াশুনো ছাড়লে সিদ্ধান্তকারীদের উদ্দেশ্য সফল হবে।" তাই স্কুলে ফেরা এবং পরীক্ষার আগে সব ভুলে পড়ায় মন দিয়েছিলাম।
তবাসসুম জানিয়েছেন, স্কুল ছাড়ার সিদ্ধান্ত তারা ছয় বান্ধবী মিলে নিয়েছিলেন। নিজে সিদ্ধান্ত বদলের সময় তিনি চেষ্টা করেছিলেন বাকিদেরও ক্লাসে ফেরাতে। কিন্তু ওরা ঝুঁকি নেয়নি স্কুলে ঠাট্টা-তামাসার শিকার হতে হবে বলে। ওদের পরিবারও চায়নি মেয়ে হিজাব ছাড়া স্কুলে যাক।
গত বছরের গোড়ায় কর্নাটকের বিজেপি সরকার আচমকাই বারো ক্লাস পর্যন্ত হিজাব পরার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে রাজ্যজুড়ে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের নামে মুসলিম সংগঠন ও ছাত্রীরা। বহু জায়গায় তা সাম্প্রদায়িক অশান্তির চেহারা নেয় কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি পাল্টা পথে নামে।
তবে প্রতিবাদের মূল স্রোত হয়ে উঠেছিল মুসলিম ছাত্রীদের স্কুল বয়কট। হিজাব নিষিদ্ধ করে সরকার ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে অভিযোগ তুলে অনেক বাবা-মা’ও মেয়েকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দেন। অনেকে দূরশিক্ষা প্রকল্পে ভর্তি করে দেন মেয়েকে। পরীক্ষা বয়কট করে কয়েক হাজার মুসলিম মেয়ে। সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে হাইকোর্ট হয়ে মামলা এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। তবাসসুমের প্রশ্ন, "একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে কেন পোশাকের উপর সরকারি বিধিনিষেধ থাকবে। শিক্ষা আমার অধিকার, ধর্মাচরণও অধিকার।"
শীর্ষ আদালতের রায়ে হিজাব বিতর্ক কোন দিকে গড়াবে কেউ জানে না। কর্ণাটকে আসন্ন বিধানসভার ভোট। ভোটের ময়দানেও ফিরেছে হিজাব বিতর্ক। কর্নাটকের বিজেপি সরকার হিজাব নিষিদ্ধ করেছে ১২ ক্লাস পর্যন্ত। তবাসসুম এবার কলেজে যাবেন। সেখানে ইউনিফর্মের কড়াকড়ি নেই। তাঁর কথায় তবু সংশয়, "কলেজে কড়াকড়ি নেই বটে, তবে রাজনীতি যেদিকে গড়াচ্ছে কলেজেও আগামীদিনে হিজাব পরার সুযোগ থাকবে কি না সন্দেহ।" তবাসসুম ঠিক করেছন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিয়ে পড়তে বিদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন।