জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সরকারি সফরে মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) বিকালে টোকিওতে পৌঁছালে, তাকে লাল গালিচায় অভ্যর্থনা জানানো হয়। স্থানীয় সময় বিকেল ৪ টা ৪৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টা ৪৫ মিনিট) হানেদা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান শেখ হাসিনা।
তাকে স্বাগত জানান জাপানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ইয়ামাদা কেনজি। বিমানবন্দরে তাকে গার্ড অফ অনার দেয়া হয়। বিমানবন্দর থেকে শেখ হাসিনাকে আকাসাকা প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজপ্রাসাদে যাওয়ার পথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে সড়কের দুই পাশে বাংলাদেশ ও জাপানের পতাকা দিয়ে সজ্জিত করা হয়।
এর আগে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ভিভিআইপি চার্টার্ড ফ্লাইট সকাল ৭ টা ৫৬ মিনিটে (বাংলাদেশ সময়) টোকিও’র উদ্দেশে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করে।
শেখ হাসিনা জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে দুই সপ্তাহের সরকারি সফরের প্রথম ধাপে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত টোকিওতে অবস্থান করবেন। পরে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর শেষে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৯ মে দেশে ফিরবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ, মধুর সম্পর্ক,' বললেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন
ভয়েস অফ আমেরিকার সাথে আলাপকালে সোমবার, ২৪ এপ্রিল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এক কথায় বাংলাদেশ, জাপান সম্পর্ককে "অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ মধুর সম্পর্ক" হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
“এমনিতেই আমাদের বড় উন্নয়নের অংশীদার; একক দেশ হিসেবে জাপানের কাছে বাংলাদেশের অবস্থান এক নম্বরে। তারা সবসময় আমাদের প্রতি সহনশীল। তারা যে সাহায্য করে তার জন্য কোনো শর্ত থাকে না। প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের আরো উত্তরণ হবে। উভয় দেশের মঙ্গলের জন্য অনেক অনেক কাজ হবে। জাপান বাংলাদেশে দুটি ইকোনমিক জোন তৈরী করেছে। তারা বিশ্বাস করে সেখানে বিনিয়োগের খুব ভালো সুযোগ রয়েছে। আমরা সেগুলা কাজে লাগানোর চেষ্টা করব।“
প্রধানমন্ত্রীর সফরের তাৎপর্য
লাইলুফার ইয়াসমিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক, ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "আমি মনে করি এই সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কারন জাপান শুধুমাত্র দ্বি-পাক্ষিকভাবে সম্পর্ক দেখছে না, বহু-পাক্ষিকভাবে এমন ভাবে দেখছে যার ভু-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে । সে কারণে আমি মনে করছি এর সফর ‘খুবই তাৎপর্যপূর্ণ’।"
তিনি ব্যাখ্যা করেন এই বলে, "বাংলাদেশ জাপান সম্পর্ক সবসময় খুব উষ্ণ ছিল এবং সেটা সব পর্যায়ে, পাবলিক ডিপ্লোমাসি কিংবা ট্রাক ১.৫ ডিপ্লোমেসি (সরকারি, বেসরকারি যৌথ) লেভেলে। এই সফরের মধ্য দিয়ে আমি মনে করি বাংলাদেশের জাপানের প্রতি যে অঙ্গীকার এবং জাপানের বাংলাদেশের প্রতি যে অঙ্গীকার সেটার পুনর্ব্যক্ত হবে।"
কিন্তু এবারের সফরকে আগের যেকোনো সফরের চেয়ে পাঁচটি কারণে "অনেক তাৎপর্যপূর্ণ" বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাপান স্টাডি সেন্টারের অধ্যাপক ডঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন।
ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন...
"প্রথমত, জাপানের সাম্প্রতিক ঘোষিত অবাধ এবং উম্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকে গ্লোবাল সাউথকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশকে একটা গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে জাপান মনে করছে। জাপানের ‘ডোনার রেসিপিয়েন্ট’ সম্পর্কের বাইরে বাংলাদেশের সাথে এটা একটা নতুন কম্পোনেন্ট ।
দ্বিতীয়ত, জাপান ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ (BIG-B) ধারণার আলোকে কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম ঘিরে বিশাল এক সমন্বিত কার্যক্রম বাস্তবায়নাধীন । দক্ষিণপূর্ব আশিয়ানভুক্ত দেশ, এবং অন্যান্য দেশে পণ্য তৈরির খরচ বেড়ে যাবার কারণে, এবং বাংলাদেশের যেহেতু অর্থনৈতিক ট্রান্সফর্মেশন হয়েছে এ কারণে এটা একটি আকর্ষণীয় জোনে রূপান্তরিত হয়েছে । জাপানিজ কোম্পানিরা মনে করে এখানে বিনিয়োগ করলে কম খরচে পণ্য তৈরি করে নির্মাণাধীন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর দিয়ে রপ্তানি করা যাবে ।
তৃতীয়, জাপান বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ককে ‘কৌশলগত’ সম্পর্কে উন্নতি করতে চায়, যেখানে নিরাপত্তা এবং সামরিক সহযোগিতা বিষয়গুলি যোগ হবে।
চতুর্থ, আমাদের এলডিসি গ্রাজুয়েশন হয়েছে। এরপরে আমরা জাপানে জিএসপি সুবিধা পাব না এবং এই নতুন প্রেক্ষাপটে ‘ইকোনোমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। ইকোনোমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট-এর আলোচনা চলমান আছে ।
পঞ্চম, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের সাথে উত্তর-পূর্ব ভারতের সংযোগ চিন্তা করছে জাপান । যা আঞ্চলিক যোগাযোগে নতুন মাত্রা দিবে। সম্প্রতি জাপানের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরকালে এ বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। আমি মনে করি দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় এটি স্থান পাবে।"
দু'দেশের মধ্যকার বাণিজ্য
বাংলাদেশ, জাপানের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের তৈরী পোশাক, চামড়া জাতীয় প্রোডাক্ট এবং চা রপ্তানি করে থাকে বাংলাদেশ। জাপান থেকে আমদানির মধ্যে গাড়ি, এবং মেশিনারিজ অন্যতম।
জাপান বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তারেক রাফি ভূঁইয়া (জুন) প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে "খুবই ইতিবাচকভাবে" দেখছেন।
ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, "বর্তমানে প্রায় ৩২০টি জাপানীজ কোম্পানি বাংলাদেশে আছে। এই সফরের ফলে দুদেশের সম্পর্ক আরো গাঢ় হবে। জাপানের জন্য বাংলাদেশের বাজার আরো বড় হবে। আড়াইহাজারে গত ডিসেম্বরে ইকোনমিক জোন চালু হয়েছে। আমরা চাই আরো বেশি বেশি জাপানিজ বিনিয়োগ হোক। দু’দেশের সম্পর্ক বর্তমানে ইতিবাচক আছে।" এই সফরের ফলে আরো ইতিবাচক হবে বলে তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে মন্তব্য করেন।
[এই প্রতিবেদন তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন নূরুল ইসলাম হাসিব।]