রানা প্লাজা ধসের এক দশকেও বিচারে নেই অগ্রগতি

ধসে পড়া রানা প্লাজার একাংশ। (ফাইল ছবি)

বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি রানা প্লাজা ধসের মামলায় গত ১০ বছরে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন ‘মাত্র’ ৪৫ জন। অথচ সাক্ষী করা হয়েছিল ৫৯৪ জনকে। ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক নিহতের এই ঘটনায় মোট ১৪টি মামলা হলেও এত বছরে একটি বাদে বাকিগুলোর তেমন কোনো অগ্রগতিই হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছে, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে মামলার বিচার কাজে এত দেরি হচ্ছে। তবে শ্রমিক নেতা এবং মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ, ‘‘সরকারের অবহেলা, অমনোযোগ এবং দেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতি রানা প্লাজার বিচার প্রক্রিয়াকে আক্রান্ত করেছে।’’

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে জনবহুল ঢাকা শহরের অদূরে সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রানা প্লাজায় ভয়াবহ ধস নামে। বিশ্ব-ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ এই শিল্পদুর্ঘটনায় ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক নিহতের পাশাপাশি আহত হন ২ হাজার ৪৩৮ জন। সেদিন ভবন ধসের পর রানা প্লাজার সামনে গিয়ে ভেতরে আটকে পড়াদের আর্তনাদ দেখেছিলেন এই প্রতিবেদক। অনেকে কয়েক ঘণ্টা ধরে হাত-পা নেড়ে ইশারা করলেও তাদের জীবিত উদ্ধার করতে ব্যর্থ হন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এভাবে সবার চোখের সামনেই একের পর এক নিস্তেজ হতে থাকেন শ্রমজীবী এই মানুষগুলো।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের পক্ষে ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল বিজনেস (আইএসবি) পরিচালিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ এখনো কর্মহীন। তাদের মধ্যে ৮৯ শতাংশের গত ৫-৮ বছর ধরে কোনো কাজ নেই।

মামলা হলেও বিচারে ধীরগতি

ভবনটি ধসের পর যতগুলো মামলা হয়েছে তারমধ্যে তিনটি মামলাকে ‘প্রধান’ বলছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী এবং শ্রমিকনেতারা: অবহেলা-জনিত মৃত্যুর অভিযোগে পুলিশের মামলা, রাজউকের করা ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন এবং নিহত একজন পোশাক শ্রমিকের স্ত্রীর দায়ের করা খুনের মামলা। ঘটনার পরেই সাভার থানা পুলিশ একটি মামলা করে। এক পর্যায়ে একজন শ্রমিকের স্ত্রীও খুনের মামলা করলে তদন্তের পর দুটি মামলা একটিতে রূপ নেয়। অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে আরেকটি মামলা করেছিল। শুধুমাত্র সেই মামলায় সাজা হয়েছে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ও তার মা মর্জিনা বেগমের। বাকী এগারটি মামলা করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।

কয়েক দিন আগে পুলিশের করা মামলায় হাইকোর্টে সোহেল রানার জামিন হয়। পরে অবশ্য সেটি স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। আগামী ৮ মে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এর শুনানি হবে।

হত্যা মামলায় ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এদের ৩৮ জনের বিরুদ্ধেই খুনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। এরপর একের পর এক আসামি উচ্চ আদালতে গেলে বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত থাকে ২০২২ সাল পর্যন্ত।

মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) বিমল সমাদ্দার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘আমার জানা মতে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বিবেচনায় টুইন টাওয়ারের পরে এই মামলা সবচেয়ে বড়। ২০১৬ সালে চার্জশিট গঠন করা হয়েছিল। এরপর দশ থেকে বারো জন আসামি মহামান্য হাইকোর্ট থেকে তাদের বিচারের ব্যাপারে স্টে-অর্ডার নিয়ে আসে। দশ-বারো জন থেকে নামতে নামতে এখনো তিন-চারজনের স্টে-অর্ডার আছে। এই আট বছরে কিছু আসামির বিচারে শুধুমাত্র মহামান্য হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ ছিল বলে অগ্রগতি হয়নি। এই সময়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা প্রতিনিয়ত আদালতে হাজির হয়েছেন। বর্তমান জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভুঁইয়া এসে দেখলেন যে এটা তো অনেক দিন হয়ে গেছে। সাক্ষী নেওয়া দরকার। তখন তিনি উচ্চ আদালতের প্রতি সম্মান রেখে যাদের স্টে অর্ডার আছে, তাদের বিচার কাজ স্থগিত রেখে বাকিদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করেন। ’’

বিচার শেষ হতে কতদিন লাগতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে পিপি বিমল সমাদ্দার বলেন, "দেখুন, হত্যা মামলাটি ঢাকার সেশন জজ কোর্টে চলছে। এই আদালতে রানা প্লাজা বাদেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং চাঞ্চল্যকর মামলা আছে। আমরা প্রতি মাসে ডেট দিয়ে সাক্ষীদের আদালতে আনি। এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সাক্ষীরা খুব 'নিডি'। ভবনটি ধসের পর অনেকেই গ্রামে চলে গেছেন। সেখান থেকে আমাদের পকেটের টাকা খরচ করে পুলিশের সহায়তায় তাদের ঢাকায় আনা হয়। সাক্ষী আনা-নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো বরাদ্দ নেই। অনেক সময় এমন সাক্ষী আসেন, যাদের সহায়তার জন্য আমাদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলে মহামান্য বিচারকের কাছে অনুরোধ জানাতে হয়। তখন তিনি অনুদান দেন। সব সাক্ষীকে আদালতে আনা শেষ হলে, তখন বিচার কাজ দ্রুত শেষ করা যাবে। এই মুহূর্তে নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। বিচারের ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ যথেষ্ট তৎপর। বিজ্ঞ আদালতও তৎপর।’’

রানা প্লাজার মামলাগুলোর ওপর দশ বছর ধরে নজর রাখছেন সিনিয়র সাংবাদিক মাসউদুর রহমান। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের এই সময়ে তিন জন বিচারক বদলি হয়েছেন। এখনকার জেলা ও দায়রা জজ একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যে আসামির যে পার্টটুকু স্টে সেটি বাদ দিয়ে বাকিদের সাক্ষী নেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। সাক্ষীরা কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে বিষয়টা এমনও না। এই কোর্টে অনেক বড় বড় মামলার বিচার হয়। তাই অনেক সময় সাক্ষীরা আসলেও ঠিক সময়ে সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব হয় না।’’

‘‘সাক্ষীরা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসে। কেউ আহত, কেউ পঙ্গু, কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ। রানা প্লাজা ধসের পর অনেকেই গ্রামে চলে গেছেন। তাদের ঢাকায় আনতে হলে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের যোগাযোগ করতে হয়। এতে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। লাস্ট ডেটে ১৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার কথা ছিল, নেওয়া হয়েছে মাত্র আট জনের। এই মানুষগুলো যখন আসেন, সাক্ষ্য না দিতে পারলে হতাশ হয়ে ফিরে যান।’’

বিচারের এই ধীরগতিকে ‘অত্যন্ত মর্মান্তিক’ উল্লেখ করে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, "দশ বছর পরে এসেও আমাদের বিচারের দাবি করতে হচ্ছে। এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক। এই সময়ে আমরা যখন বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হওয়ার খবর পাবো বলে আশায় ছিলাম, তখন দেখলাম ভবনমালিক সোহেল রানার একবার জামিন হলো। পরে আবার স্থগিত করা হলো। এই ঘটনায় সোহেল রানা ছাড়া আরও অনেকে অভিযুক্ত ছিলেন, তারা জামিনে আছেন। এছাড়া যেসব সরকারি কর্মকর্তা ভবনটির নকশা করেছিলেন কিংবা যে জনপ্রতিনিধি অনুমোদন দিয়েছিলেন, তাদের কাউকেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে দেখি না। পুরো বিষয়টা উদ্বেগজনক। এতদিন মাত্র ৪৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। আমাদের চারপাশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি দেখছি, সেটি রানা প্লাজাকেও আক্রান্ত করেছে। আমরা মনে করি সরকারের এক ধরনের অবহেলা এবং অমনোযোগই এর জন্য দায়ী। বিচার কাজে এত দেরি হওয়ায় এটাই আবার প্রতীয়মান হয় যে মালিক এবং সরকার শ্রমিকদের মানুষ বলে গণ্য করে না।’’

রানা প্লাজা ধসের পর কারখানার কর্মপরিবেশে কিছুটা উন্নতি হয়েছে জানিয়ে তাসলিমা আখতার বলেন, ‘‘গত দশ বছরে বিভিন্ন কারখানায় কিছু আগুনের খবর পেলেও ভবন ধসের মতো ঘটনা দেখিনি। তাতে বোঝাই যায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু ভবনের উন্নতি মানেই শ্রমিকের উন্নতি নয়। দ্রব্যমূল্যের এখন যে অবস্থা, তাতে আট হাজার টাকা বেতনে একজন শ্রমিকের চলা কঠিন।’’

রানা প্লাজা ধসের দিনকে পৃথিবীব্যাপী পালনের দাবি জানিয়ে এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, ‘‘আমাদের কিছু দাবি আছে। শ্রমিকদের জীবন মানের উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে ২৪ এপ্রিলকে সারা পৃথিবীতে যেন রানা প্লাজা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এছাড়া এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার শাস্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করতে হবে।’’