অটিজম: বাড়ছে ধারণা ও সচেতনতা

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের আঁকা ছবি দিয়ে তৈরি শুভেচ্ছা কার্ড। ছবি: (আফরিন শাহনাজ)

নাফিসাতুল মাকসুদা শিক্ষকতা করেন অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশুদের স্কুলে। ছেলে নাফিজ উন্মেষ-এর বয়স ১৬ বছর। নাফিজ একজন এএসডি শিশু। শিক্ষিকা মাকসুদা তাঁর সন্তানকে নিয়ে জার্নির গল্পটা শোনালেন ভয়েস অফ আমেরিকাকে। মাকসুদা এর আগে ঢাকার বাইরে জেলা শহরে একটি কলেজে শিক্ষকতা করতেন। ছেলের বয়স যখন দুই বছর দুই মাস তখন তার অটিজম শনাক্ত হয়। মাকসুদা জানালেন তিনি এর আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, ছেলের কিছু সমস্যা আছে। বললেন, “প্রথমে আমি খেয়াল করলাম নাম ধরে ডাক দিলে ও সাড়া দেয় না। অন্যান্য বাচ্চারা যেমন মাকে অনেকক্ষণ পরে দেখলেই মা’র কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমি কলেজ থেকে আসার পরে ও সেরকম কিছু করতো না। ক্ষুধা লাগলে কান্না করতো না, আমার কাছে আসতে চাইতো না বরং ঘুমিয়ে যেতো। সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে খেলতো না। ওর কাজিনরা বাসায় এলে তাদের সাথে খেলতো না। এক কোনায় নিজের মতো চুপচাপ বসে থাকতো। এ বিষয়গুলো তখন আমার চোখে পড়ে। দেড় বছর বয়স পর্যন্ত ওর স্পিচ নরমাল ছিলো। দুটো করে শব্দ, ছোট বাক্য বলতে পারতো। এর পর ওর শব্দভান্ডার কমতে থাকে। নতুন কোনো শব্দ শেখে না বরং কথা বলা কমে আসে। আমি ওকে বড় বড় চাইল্ড স্পেশালিস্টদের কাছে নিয়ে যাই। হিয়ারিং প্রবলেম বা অন্য কোনো প্রবলেম আছে কি না সেটা বোঝার জন্য টেস্ট করাই। পরিবারের সবাই আমাকে বলেছিলো, এসব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বেশি চিন্তা করো। কিন্তু আমার মন মানেনি। যখন বয়স দুই বছর দুই মাস, তখন আবার একজন চাইল্ড স্পেশালিস্ট দেখাই। তখন তিনি শনাক্ত করেন যে ওর অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (এএসডি) আছে।”

অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার কী? লক্ষণ ও কারণসমূহ

অটিজম মূলত শিশুর স্নায়ুর বিকাশজনিত সমস্যা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, শিশু বিশেষজ্ঞ ও নিউরোলজিস্ট ডা. কাজী আশরাফুল ইসলাম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “অটিজম বর্তমান সময়ে অত্যন্ত আলোচিত একটি শব্দ। অটিজম কোনো রোগ নয়। মস্তিষ্কের পূর্ণ বিকাশজনিত সমস্যা। একে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার বা সংক্ষেপে ASD বলা হয়। DSM-4 অনুযায়ী অটিজমের তিনটি বৈশিষ্ট্য। এগুলো হলো: ১. কথা বলতে দেরী হওয়া ২. যোগাযোগ বা সংযোগ স্থাপনে বাধা ৩. একই কাজের পুনরাবৃত্তি করা।

DSM-5 এ এএসডিকে দুটি বৈশিষ্ট্যে নিয়ে আসা হয়েছে। ১. কমিউনিকেশন ও সামাজিকতায় বাধা ২. একই কাজের পুনরাবৃত্তি করা। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যদি কোনো শিশুর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় তাহলে তাকে আমরা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু বলি।”

শিশুর মধ্যে কোন বয়স থেকে অটিজমের কী ধরণের লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় সে প্রশ্নের উত্তরে ডা. ইসলাম বলেন, “অটিজমের বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণগুলো মোটামুটি শিশুর তিন বছর বয়সের মধ্যে প্রকাশ পায়। তবে যদি বিশেষভাবে খেয়াল করা হয় তবে তিন বছর বয়সের আগেও তা বোঝা যায়। সাধারণত অধিকাংশ শিশুই দেরীতে কথা বলে। দেরীতে কথা বলার ক্ষেত্রে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। তবে সেটি অন্য কোনো কারণ নাকি অটিজমের কারণেই দেরীতে বলছে সেটা বুঝতে গেলে অটিজমের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো খেয়াল করতে হয়। যে তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা বললাম সে তিনটির যে কোনো একটি থাকলেই আমরা শিশুর অটিজম আছে বলব না। বরং তিনটি লক্ষণই শিশুর মধ্যে থাকতে হবে। মোট কথা কমিউনিকেশনে সমস্যা থাকবে। যেমন, কথা বলা কমিউনিকেশনের একটি অংশ। সাধারণত অটিজম ছাড়া অন্য কোনো কারণ যদি কথা বলতে দেরী হয়, সেসব শিশু Nonverbal কমিউনিকেশনে যেমন ইশারা-ইঙ্গিত, কথা না বলে অন্য যে কোনোভাবে মনের ভাব প্রকাশে সক্ষম হয়। কিন্তু যাদের Verbal ও Nonverbal দুটো ক্ষেত্রেই কমিউনিকেশনের সমস্যা থাকে তাদের ক্ষেত্রে আমরা অটিজম বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে বলেই সন্দেহ করি। এছাড়াও তার সামাজিকতায় সমস্যা থাকে। অর্থাৎ শিশু তার বয়স অনুপাতে সমবয়সীদের সাথে মেলামেশা করতে পারে না। এরপর লক্ষণগুলোর মধ্যে যেটি খেয়াল করতে হয় তাকে DSM-5 অনুযায়ি Restricted and Repetitive Stereotype Behavior and interest সংক্ষেপে RRB বলে। অর্থাৎ তার আচরণ হবে Restricted বা কোনো একটি গন্ডিকে ঘিরে। Repetitive অর্থাৎ একই কাজ বারবার করবে। Stereotype অর্থাৎ একই ধরণের কাজ সবসময় করবে। এই শিশুরা যে ধরণের কাজ, খেলাধুলা, খাওয়া-দাওয়া, ঘোরাফেরার প্রতি আগ্রহ দেখায় সেটারও একটা একঘেয়ে টাইপ থাকে অর্থাৎ একই খেলা, একই খাবার, একই পছন্দের মধ্যেই সে ঘোরাফেরা করে। এটাই হলো interest. তো এই লক্ষণগুলো কোনো শিশুর মধ্যে দেখা গেলে আমরা তার ASD আছে ধরে নেই।”

একটি শিশু কেনো ASD নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে তার পেছনে নির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনও পর্যন্ত বের করা সম্ভব হয়নি। ডা. ইসলাম বললেন, “যে সমস্যাগুলো কারণ জানা যায় না সেগুলোকে আমরা মাল্টিফ্যাক্টেরিয়াল বলি। যেখানে জেনেটিক কিছু ইনফ্লুয়েন্স থাকে, পরিবেশগত ইনফ্লুয়েন্স থাকে, তবে তার সঠিক ধারণা না পাওয়া গেলে আমরা সেগুলোকে মাল্টিফ্যাক্টেরিয়াল বলি। তেমনি অটিজমের পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। যেমন অটিজমের শিশুদের জেনেটিক স্টাডি করা হলে তাদের ক্রোমোজম বা ডিএনএ তে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তবে এ ধরণের পরিবর্তন অটিজমের বৈশিষ্ট্য ছাড়া শিশুদের ক্ষেত্রেও দেখা যেতে পারে। তাই এ পরিবর্তনকেও একমাত্র কারণ হিসেবে ধরা যায় না। কারণ অটিজমের সব শিশুর মধ্যে একই ধরণের জেনেটিক পরিবর্তন দেখা যায় না। এছাড়া বাবা মায়ের বেশি বয়স, ডিভাইসের ইনফ্লুয়েন্স, শিশুর কমিউনিকেশন ও স্পিচ ডেভেলপমেন্টের সময়ে ঠিকমতো পরিচর্যা না করা এগুলোও কিছু সহায়ক কারণ হতে পারে।”

ডা. ইসলাম জানালেন, আগে এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের খুব বেশি ধারণা ছিলো না। এখন অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। দুই-আড়াই বছরের শিশুদের কথা বলতে দেরী হলেই, অটিজম আছে কিনা সেটা না বুঝলেও পরীক্ষা করাতে, ডাক্তারের পরামর্শ নিতে চলে আসেন। চিকিৎসকরা কিছু সাইক্রিয়েটিক টুলস দিয়ে শিশুকে ডায়গনোসিস করেন। ডা. ইসলামের মতে, অটিজম নিয়ে এখন সমাজ ও পরিবারে মিথ বা ভ্রান্ত ধারণাগুলো কমেছে। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। এখন পরিবারের সচেতনতার কারণে দ্রুত শনাক্ত হচ্ছে। বাবা-মায়েরা সন্তানদের বিশেষ স্কুলিংয়ের ব্যবস্থা করছেন, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ থেরাপি দিচ্ছেন। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরিচর্যা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তাই এ ধরনের শিশুদের উন্নয়ন ঘটছে।

এএসডি শিশুর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু বা এএসডি শিশুর ক্ষেত্রে দ্রুত শণাক্তকরণ, সঠিক পরিচর্যা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। তাই সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে গড়ে উঠেছে অনেক অটিজম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ক্যাম্পাসে ২০১০ সালে একটি অটিজম রিসোর্স সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সেন্টার থেকে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের বিনামূল্যে নিয়মিত বিভিন্ন ধরণের থেরাপি সেবা, গ্রুপ থেরাপি, দৈনন্দিন কার্যবিধি প্রশিক্ষণসহ এ ধরণের শিশুদের বাবা-মায়েদের কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করা হয়। ২০১০ সালে চালু হওয়ার পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৮,০০০ জন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিকে বিনামূল্যে ম্যানুয়াল ও Instrumental থেরাপি সার্ভিস প্রদান করা হয়েছে।

অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনে শিশুদের তৈরি করা পন্য। (ছবি: আফরিন শাহনাজ)

এছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বেসরকারী পর্যায়ে গড়ে উঠেছে অনেক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেরকম একটি বেসরকারী , স্বেচ্ছাসেবী, বিশেষায়িত শিক্ষা ও সেবা প্রতিষ্ঠান অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন। কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির উপাধ্যক্ষ মরিয়ম মনোয়ারের সঙ্গে। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, ২০০৪ সাল থেকে অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু। এর প্রতিষ্ঠাতা ডা. রওনক হাফিজ। প্রতিষ্ঠানটিতে শিশুদের পাঠদান, বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ প্রদান, স্পিচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি এবং বারো বছরের ওপরের শিশুদের ভোকেশনাল ট্রেনিং দেয়া হয়। মরিয়ম মনোয়ার বলেন, “একটা মানুষের জীবনে চলার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবই এখানে এই শিশুদের শেখানো হয়। যত অল্প বয়সে এসডি শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যায় তত তাড়াতাড়ি তারা আয়ত্ত করতে পারে। শিক্ষার মধ্যে রয়েছে সামাজিকতা, যোগাযোগ, আত্মনির্ভরশীলতা, খেলাধুলা, লেখাপড়া। এগুলোর উপর ভিত্তি করে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চলে। অটিজমের শিশুরা হাইলি ভিজুয়্যাল হয়। ওদের মধ্যে অনেকেই কথা বলতে পারে না। কিন্তু তারা ছবির মাধ্যমে শেখে এবং সেভাবেই কমিউনিকেট করার চেষ্টা করে। এজন্য আমাদের ক্লাসরুমগুলোতে ওদের পড়াশুনার শিডিউল দেয়া হয় ছবি সহ।”

উপাধ্যক্ষ আরো জানালেন, বর্তমানে স্কুলে ১৩০ জন শিক্ষার্থী আছে। কোভিডকালীন সময়ের আগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো প্রায় ১৭০ জন। এখন ফাউন্ডেশনে শিক্ষকের সংখ্যা ৬৫ জন। তিনি বলেন, “ক্লাসরুমে প্রতি দুইজন শিশুর জন্য একজন শিক্ষক থাকেন। কারণ প্রত্যেকটি শিশুর জন্য IEP (Individual Education planning) তৈরি করা হয়। যে শিশুদের আমরা দেখি, পড়াশুনা করতে পারছে, তার পাঠদান এগুচ্ছে সে সব শিশুদের আমরা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) অনুযায়ি পাঠদান শুরু করি। প্লে গ্রুপ থেকে কলেজ পর্যন্ত শিক্ষার্থী আছে।”

এই প্রতিষ্ঠানের ভোকেশনাল ইনচার্জ আইনুন নাহার চৌধুরী জানান, তিনি ২০০৬ সাল থেকে অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের সাথে যুক্ত আছেন। প্রতিষ্ঠানের বারো বছরের ওপরের শিশুদের বিভিন্ন ধরণের বৃত্তিমূলক কার্যক্রম শেখানো হয়, যাতে তারা শেখান থেকে উপার্জন করতে পারে। যেমন, কাপড়ে ডাইং, ব্লক প্রিন্ট, সেলাই, হ্যান্ড পেইন্ট। বিভিন্ন ক্রাফেটের কাজ। মাটির শো পিস তৈরির কাজ, গয়না বানানো। এছাড়া শিশুদের কিছু সাধারণ রান্না শেখানো হয় যাতে তারা নিজের খাবার নিজে তৈরি করে খেতে শেখে। যেমন জুস তৈরি, রুটি বানানো, নুডুলস বানানো। শিশুদের আকাঁ ছবি ও তৈরি পন্যগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রদর্শনী ও মেলার আয়োজন করা হয়। সেই মেলা থেকে প্রাপ্ত অর্থ শিশুদের প্রয়োজনে ব্যয় করা হয়ে থাকে।

কথা হয় অকুপেশনাল থেরাপিস্ট রাবেয়া বসরীর সঙ্গে। তাঁর কাছে এই থেরাপি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “এএসডি বাচ্চাদের সেন্সরি প্রবলেম থাকে। কগনেটিভ প্রসেসিংয়ে সমস্যা থাকে। আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়। এর মাধ্যমে আমরা স্বাদ, গন্ধ ,দেখা, শোনা, স্পর্শ করি। এর সাথে আরো আছে vestibular, Proprioception। আমাদের জয়েন্ট, লিগামেন্ট এগুলোরও কিছু অনভুতি আছে। এই অনুভূতি এ বাচ্চাদের কারো কম থাকে কারো বেশি। এএসডি শিশুদের এই সাতটি সেন্সরির অসামঞ্জস্যতা থাকে। একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট সেটা অ্যাসেসমেন্ট করে কিছু এক্সেরসাইজ, কিছু অ্যাকটিভিটিস নিয়ম করে তাদের করান যাতে তাদের এই অসামঞ্জস্যতাগুলো দূর হয়। যেমন ধরুন একটা শিশু সারাদিন থুথু ফেলছে। কারণ হচ্ছে ওর টেস্ট নেই, স্মেল নেই। আমি যদি সেটা বুঝতে পারি, এবং তাকে কিছু ওরাল এক্সেরসাইজ করাই তাহলে তার থুথু ফেলা বন্ধ হবে। ”

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের আঁকা ছবি দিয়ে তৈরি শুভেচ্ছা কার্ড। (ছবি: আফরিন শাহনাজ)

নাফিজ উন্মেষের মা ও শিক্ষিকা নাফিসা এএসডি শিশুর যত্ন ও শিক্ষা সম্পর্কে বলেন, “আমি কখনও ধারণাও করতে পারিনি যে আমার ছেলের মধ্যে আস্তে আস্তে এত ডিজঅ্যাবিলিটি ধরা পড়বে, সেন্সরি প্রবলেম বাড়বে। ও নিজের কাজগুলো নিজে করতে অক্ষম হবে। ওর কথাগুলো একেবারেই হারিয়ে যাবে। ঐ সময়টাতে আমি নিজেও মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিলাম। হয়তো অটিজম বেবিদের সব বাবা-মায়েরই এ ধরণের মানসিক অবস্থার ভেতর দিযে যেতে হয়। তখন আমার আপনজনদের পরামর্শে আমি বিশেষ শিশুদের স্কুলে চাকরি নেই। এবং একই স্কুলে আমি আমি আমার ছেলেকেও ভর্তি করাই। যার ফলে , আমরা মা-ছেলে একই সাথে স্কুলে যাওয়া আসা করতে পারছি। আমার সময়টাও ভালো কাটছে, এবং এই বিশেষ শিশুদের শিক্ষাদানের ফলে আমার নিজের সন্তানের কিভাবে যত্ন নিতে হবে সেটা আরো ভালোভাবে বুঝতে পারছি। আমার ছেলে নাফিজ এখন কথা বলে না কিন্তু তার সোশ্যাল কমিউনিকেশন খুব ভালো। নিজের খাবার নিজে খেতে পারে। অবসরে গান শুনতে পছন্দ করে। আমার একটা ছোট বাগান আছে, সেখানে ও সময় কাটাতে পছন্দ করে, গাছের যত্ন করে। যেহেতু শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্যে আছে তাই ওর বিকাশের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জিং বিষয়গুলো যেমন আসছে, তেমনি সেগুলো কাটিয়ে ওঠাও সম্ভব হচ্ছে। তিন-চার বছর আগেও আমি নাফিজকে নিয়ে খুব হতাশ ছিলাম, এখন এ বিষয়টা আমি মেনে নিয়েছি। ছেলের নতুন কোনো ডেভেলপমেন্ট আমাকে আশা জাগায়। নাফিজের বাবাও আমাকে ছেলের সব ব্যাপারেই ভীষণ হেল্প করে।”

পরিসংখ্যান কী বলে?

যুক্তরাষ্ট্রের CDC( Centers for Diseases Control and Prevention) বলছে অটিজম হলো বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ‘বিকাশজনিত অক্ষমতা’। চিলড্রেন'স হেলথ অ্যাক্ট ২০০০ সিডিসিকে ADDM (Autism and Development Disabilities Monitoring) নেটওয়ার্ক তৈরি করার অনুমোদন দেয়। ADDM নেটওয়ার্ক ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ASD ডেটা সংগ্রহ এবং রিপোর্ট করছে।

CDC-এর ২০২০ সালের প্রকাশিত গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ি যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৪ বছর বয়সী ও ৮ বছর বয়সী ৫৪ জন শিশুর মধ্যে ১ জনকে ASD চিহ্নিত করা হয় (২০১৬ সালের সংগৃহীত ডাটা)। ২০২১ সালে এসে এটি দাঁড়িয়েছে প্রতি ৪৪ জনে ১ জন শিশু (২০১৮ সালের সংগৃহীত ডাটা)। ২০২৩ সালের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ি এই সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে প্রতি ৩৬ জন শিশুর মধ্যে ১ জন শিশু (২০২০ সালের সংগৃহীত ডাটা)। অর্থাৎ প্রতি বছর আগের বছরের তুলনায় বাড়ছে। CDC-এর জরিপ বলছে কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে কম বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রাথমিক ASD শনাক্তকরণ ব্যহত হয়। শনাক্তকরণ এবং পরিষেবা শুরুর এই বিলম্বের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়বে বলে CDC মনে করে। WHO ধারণা করে সারা বিশ্বে ১০০ জন শিশুর মধ্যে ১ জন অটিজম আক্রান্ত। তবে অনেক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে অটিজমের সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায় না। সে কারণেই এ ক্ষেত্রে এখনও পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে সরকারি জরিপ চলমান। তবে কিছু বেসরকারি গবেষণা থেকে বাংলাদেশে ASD আক্রান্তের সংখ্যা ধারণা করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের national institute of Health এর গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে গ্রামের তুলনায় শহরে ASD আক্রান্তের হার বেশি। গ্রামে প্রতি হাজারে যেখানে ১.৮ জন শিশু অটিজম আক্রান্ত, সেখানে শহরে এ হার প্রতি হাজারে ২.৫ জন । দেশে ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়েসি শিশুদের অটিজম আক্রান্তের হার ১ দশমিক ৭ শতাংশ। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ২০২৩-এর জরিপ ও তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি দশ হাজারে ৮৫.৩০ অর্থাৎ প্রতি হাজারে আট জনের বেশি বা ১১৮ জনে একজন অটিজমে আক্রান্ত এবং প্রতি বছর ১০ থেকে ১৭ শতাংশ হারে অটিজমের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক।

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জাতিসংঘের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সাতটি দিবসের মধ্যে অন্যতম ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’। প্রতি বছর ২ এপ্রিল দিবসটি পালন করা হয়। জাতিসংঘ এ দিনে বিশ্বজুড়ে সদস্য দেশগুলিকে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি) সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণে উৎসাহিত করে। জাতিসংঘের কাতারের প্রতিনিধিবৃন্দ এটি প্রস্তাব করেছিলেন এবং সকল সদস্য রাষ্ট্র প্রস্তাবটি সমর্থন করে। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিনা ভোটে পাশ হয় এবং সে বছরের ১৮ ডিসেম্বর গৃহীত হয়। এ দিবসটি ‘জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ’ কর্তৃক ৬২/১৯৯ ধারা অনুযায়ি মনোনয়ন লাভ করে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে, “Transformation: Toward a Neuro-Inclusive World for All”.

বাংলাদেশ সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিপাদ্যটির বাংলা করেছে, “রূপান্তরের অভিযাত্রায় সবার জন্য নিউরোবান্ধব অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ব গঠন।” বাংলাদেশে প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এর আয়োজন করে থাকে। এ বছর অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সফল ব্যক্তি, পিতা-মাতা, কেয়ারগিভার, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে কাজ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট ১৩ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দিচ্ছে মন্ত্রণালয়টি।