চিত্রা নদীর কোল ঘেঁষে এস এম সুলতানের আপন ভুবন

এ বাসভবনেই থাকতেন সুলতান।

নড়াইল জেলার উপর দিয়ে প্রবাহমান ঐতিহ্যবাহী চিত্রা নদী। এই চিত্রা নদীর কোল ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে ‘এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা’।

নড়াইল সদরের রূপগঞ্জে অবস্থিত জমিদার বাড়ির একটি পরিত্যক্ত ভবনে নিভৃতচারী বরেন্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান শিশুদের ছবি আঁকা শেখাতেন (বর্তমানে শিশুস্বর্গ)। ১৯৮২ সালে তৎকালীন সরকার তার পাশেই সুলতানের বসবাসের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করে দেন। পরবর্তী সময়ে সেখানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের অধীনে গড়ে তোলা হয় ‘এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা’। বাড়িটি ‘সুলতান কমপ্লেক্স’ নামে পরিচিত। গেট দিয়ে ঢুকেই দু’পাশে নানা রকম ফুলের বাগান চোখে পড়বে। একটু এগিয়ে গেলেই বামে সুলতানের সমাধিসৌধ আর ডানে আদি বাসভবন, যেখানে সুলতান থাকতেন তার খানিকটা অংশ। এ বাসভবনের পেছনে দোতলা ভবনটিই মূল স্মৃতি সংগ্রহশালা। এখানে সুলতানের চিত্রকর্ম ও ব্যবহার্য জিনিসগুলো সংরক্ষণ করে রাখা। শিশুদের ছবি আঁকা শেখানোর জন্য ‘শিশু স্বর্গ’ নামে বজরা তৈরি করেছিলেন সুলতান। শিল্পীর তৈরি সেই বজরাটি সংগ্রহশালার পাশে চিত্রানদীর পাড়ে সংরক্ষিত আছে ।

মূল গেটের বাইরে জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত ভবনে তৈরি করা হয়েছে শিশুদের জন্য ছবি আঁকা শেখার স্কুল, ‘শিশুস্বর্গ’। এখানে প্রায় দেড়শ শিক্ষার্থী ছবি আঁকা শিখছে। দুইজন সিনিয়র প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিশুরা ছবি আঁকা শেখে। শিশুস্বর্গের দেয়াল জুড়ে শিশুদের আঁকা ছবি। শিশুস্বর্গে ঢুকতেই বারান্দার ডান পাশের দেয়ালে লাল রংয়ের অক্ষরে শিল্পী এস এম সুলতানের উদ্ধৃতি লেখা, “যে শিশু সুন্দর ছবি আঁকে তার গ্রামের ছবি আঁকে, সে সুন্দর ফুলের ছবি আঁকে, তার জীবজন্তুর ছবি আঁকে, গাছপালার ছবি আঁকে, সে কোনদিন অপরাধ করতে পারে না, সে কাউকে কোনদিন ব্যথা দিতে পারে না।”

শিল্পী এস এম সুলতানের সমাধিসৌধ।

ভেতরে ঢুকতেই বেশ বড় একটি অডিটোরিয়াম। অডিটোরিয়ামের চারপাশের দেয়ালে শিশুদের আঁকা ছবি টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে। শিশুরা তাদের ইচ্ছেমতো এঁকেছে গাছ, নদী, ফুল, গ্রামের ছবি। সুলতানের জন্মদিনে রঙ্গীন কাগজ দিয়ে সাজানো ও কেক কাটার ছবি এঁকেছিল একটি শিশু। ক্যাপশনে লিখেছিল, “সুলতানের জন্মদিনে আমাদের আনন্দ।”

সংগ্রহশালার কিউরেটর তন্দ্রা মুখার্জী ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানালেন, এখানে শিল্পী এস এম সুলতানের আঁকা তেইশটি মূল চিত্রকর্ম রয়েছে। এছাড়া আরো অনেক মূল ছবির রেপ্লিকা রয়েছে। মূলত সেগুলো সুলতানের আঁকা ছবির ফটোগ্রাফ। মূল ক্যানভাসের প্রিন্ট করে ফ্রেমিং করা হয়েছে। এছাড়া সুলতানের শোবার ঘরে তার ব্যবহৃত খাট, আলনা, ড্রেসিং টেবিল, আলনা, কাপড়, জুতা ইত্যাদি আছে। তাঁর ব্যবহৃত বাঁশি, হারমোনিয়াম, অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র কিছু কিছু আছে। গত আটাশ বছর ধরে এ জিনিসগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। স্থান সংকুলান সমস্যা নিয়ে তন্দ্রা মুখার্জী বললেন, “সুলতান যে ফর্মে ছবি আঁকতেন, যে বড় বড় ক্যানভাস ব্যবহার করতেন সেরকম চিত্রকর্মতো দেখা যায় না। সুলতানের আঁকা বড় বড় পেইন্টিংগুলোর জন্য এই গ্যালারি আসলে কিছুই না। এই পেন্টিংগুলো প্রদর্শনীর জন্য আরো বড় গ্যালারি প্রয়োজন। চিত্রকর্ম দেখার তো একটা বিষয় থাকে। একটা মিনিমাম দূরত্ব থেকে তা দেখতে হয়। সারা বছর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আমরা চিত্রকর্মগুলো আমরা মেইন্টেনেন্স করি। তবে সারা বিশ্বে এখন চিত্রকর্ম রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে অনেক রিসার্চ হচ্ছে, অনেক ট্রিটমেন্ট এসে গেছে। সেগুলো কিছু কিছু করাও হয়েছে। আমার মনে হয় আরো উন্নত প্রযুক্তি যদি শিল্পী এস এম সুলতানের আঁকা পেইন্টিংগুলো সংরক্ষণের কাজে লাগানো যায় তাহলে হয়তো আরো একশ বছর এগুলো সংরক্ষণ করা যাবে। আরো অনেক প্রজন্ম তা দেখতে পারবে।”

শিল্পীর আঁকা মূল চিত্রকর্মগুলি সংগ্রহশালার গ্যালারিতে সংরক্ষিত আছে।

শিল্পী এস এম সুলতানের গোটা জীবন ছিলো এক বিস্ময়। সারা পৃথিবী ভ্রমণ করে এসে শিল্প সাধনা ও নিভৃত জীবন যাপনের জন্য সুলতান বেছে নেন নড়াইলে তাঁর নিজ গ্রাম। এখানে তিনি ছবি আঁকতেন। পশু পাখিদের সাথে সময় কাটাতেন। শিশুদের ছবি আঁকা শেখাতেন। নদীতে ভেসে ভেসে শিশুদের ছবি আঁকা শেখানোর জন্য এস এম সুলতান চিত্রা নদীর পাড়ে তৈরি করেছিলেন একটি বড় বজরা নৌকা। এই নৌকার জন্য একটি ‘সুলতান ঘাট’ নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কথা, তবে তা থমকে আছে দীর্ঘদিন। তন্দ্রা বললেন, “বজরাটার রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। বজরার ঘাট করবার কাজটাও স্থগিত হয়ে আছে। নৌকার রেপ্লিকাতো চাইলে করা যায় কিন্তু শিল্পীর নিজের হাতে তৈরি এই নৌকাটি সংরক্ষণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা যদি এগিয়ে আসেন, ভালো হয়।”

নড়াইল জেলা প্রশাসন ও শিল্পী এস এম সুলতান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রতি বছর আয়োজন করা হয় সুলতান মেলার। এবার ০৭- ২০ জানুয়ারি ২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ‘সুলতান মেলা ২০২২’। সাধারণত প্রতিবছর শিল্পীর জন্মদিনকে উপলক্ষ্য করে মেলার আয়োজন করা হয়। তন্দ্রা জানালেন, সে সময়টা বৃষ্টির মৌসুম থাকে বলে এবার শীতের সময়ে প্রশাসন মেলার আয়োজন করা হয়েছে যাতে সবাই উপভোগ করতে পারে। ১৪ দিনব্যাপি এ মেলায় ছিল শিল্পী সুলতানের জীবন ও চিত্রকর্ম নিয়ে আলোচনা। চিত্র প্রদর্শনী, বিভিন্ন গ্রামীন ক্রীড়া উৎসব। যেমন নৌকা বাইচ, লাঠি খেলা। সুলতান পদক প্রদান ইত্যাদি।

সুলতান শিশুদের জন্য তৈরি করেছিলেন বজরাটি।

সংগ্রহশালার সাপ্তাহিক ছুটি রবিবার। এছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলো সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এই প্রতিবেদকে গ্যালারিগুলো ঘুরিয়ে দেখান এখানকার তত্ত্বাবধায়ক গোলাপ কাজী। তিনি বলেন, “এখানে প্রায় উনিশ বছর চাকরি করছি। শীত মৌসুমসহ সারাবছরই এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটক সুলতানের শিল্পকর্মের টানে ছুটে আসেন।” বর্তমানে শিল্পকলা একাডেমির অধীনে সুলতানের বাড়িটি সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কিউরেটরের কাছ থেকে জানা যায়, সংগ্রহশালার দায়িত্বরত কর্মীরা সরকারি বেতন ভাতার অন্তর্ভুক্ত নন, বরং যৎসামান্য সম্মানীর বিনিময়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।