রমজান মাস। পুরো বছরে এই একটি মাসের জন্য বেশ আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। এই মাসে দৈনন্দিন রুটিনেও আসে পরিবর্তন। রোজার মাসে বাংলাদেশের সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অফিস সময়সূচিতে পরিবর্তিত হয়। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী বেশিরভাগ অফিসের সময়সূচী এবার সকাল ৯ ঘটিকা থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে আকাঙ্খিত এ মাসে ব্যস্ততার কোনো শেষ নেই। তাছাড়া রমজান মাসে সারাদিন রোজা রাখার ফলে কর্মক্ষমতা অন্যান্য মাসের তুলনায় কিছুটা কমে যায়। কিছুটা সংক্ষিপ্ত অফিস সময়ের মধ্যে অফিসের সকল কাজ শেষ করা, ঢাকা শহরের রাস্তার জ্যাম ঠেলে ইফতারের আগে বাসায় ফেরা, ইফতার, রাতের খাবার, সেহেরীর প্রস্তুতি এ সব কিছুর সাথে নামাজের সময়, ঘুম, ব্যয়াম এবং সর্বোপরি সময়ের কাজ সময়ে করতে হিমশিম খেতে হয়।
বেশির ভাগ কাজের অগ্রিম পরিকল্পনা করুন
রোজার মাসে পরিবারের নারীদের কাজ সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায়। কর্মজীবী কি গৃহিণী, ইফতার থেকে নিয়ে সেহেরি পর্যন্ত কী আয়োজন হবে, পরিবারের কে কী খাবেন তার বেশিরভাগ দায়িত্বই থাকে নারীর ওপর। তাই রোজার মাসে অফিস, রান্না, বাজার এমনকি ঈদের কেনাকাটাসহ সব কাজ আগেই অগ্রিম পরিকল্পনা করে নিলে এবং সেই অনুযায়ী কাজগুলো ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নিলে সব কাজ সময়মতো করা সম্ভব।
কথা বলেছিলাম কয়েকজন নারীর সঙ্গে। তারা ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন কিভাবে এ মাসে বিভিন্ন কাজের পরিকল্পনা করছেন।
রোখসানা রহমান একটি বেসরকারি সংস্থার মানবসম্পদ বিভাগে কর্মরত। বললেন, “রমজানে ছুটি সাড়ে ৩টায় হলেও বাসায় আসতে আসতে সাড়ে ৪টা তো বাজেই। এক ঘন্টা লেগেই যায়। জ্যামে পড়লে এর চেয়ে বেশি সময়ও লাগে। এবার তো ঢাকায় ইফতারের টাইম সন্ধ্যা ৬.১৫ থেকে ৬.৩০ এর মধ্যেই হবে। তাই বাসায় ফেরার পর খুব বেশি টাইম পাওয়া যাবে না।” তাহলে ইফতারের প্রস্তুতি কিভাবে নেবেন জানতে চাইলে রোখসানা বলেন, “আমি যেটা করি, রোজার সমস্ত বাজার আগেই করে গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করি। মাছ, মাংস কেটে ধুয়ে একবারে যতটুকু রান্না করবো সেই পরিমান ভাগ করে ডিপ ফ্রিজে সংরক্ষণ করি। সারা মাসের মশলা যেটা বাটতে হবে সেটা বেটে, যেটা গুঁড়ো করতে হবে সেটা গুঁড়ো করে রেখে দেই, যাতে রান্না করতে দেরি না হয়ে যায়। ইফতারের জন্য কিছু প্রস্তুতি আগেই নিয়ে রাখি। ছোলা সেদ্ধ, পেঁয়াজুর ডাল বাটা ইত্যাদি কয়েকদিনেরটা একসাথে করে ফ্রিজে ছোট ছোট ভাগ করে রাখি। কিছু কাজ আগের দিন রাতের খাবার তৈরির সময় করে রাখি। তারপরও কখনো কখনো অফিস থেকে বের হতে দেরি হলে কিংবা রাস্তার জ্যামে পড়ে বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে গেলে কিছু ইফতার কিনে নিয়ে যাই। বাসার সহকারী মেয়েটাকে বলে দেই, কী কী কাজ ও করতে শুরু করবে।”
নাসরীন সুলতানা কাজ করছেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনে। বাসা আর অফিসের দূরত্ব বেশি না হওয়ায় রাস্তায় জ্যামে পড়ার ঝামেলা নেই তার। রমজান মাসে বাসার বেশিরভাগ কাজের জন্য সহকারীর উপর নির্ভর করবেন বলে জানালেন। বললেন, “সকালে বাসায় যে কাজের সহকারী আসেন, রোজার মাসে তাঁর কাজ বাড়িয়ে দেই। কাটাকুটি, রান্নার বেশিরভাগ সকালে সহকারী করে দেবেন। আর ইফতারের ভাজাভুজির ক্ষেত্রে বেশিরভাগই ফ্রোজেন রেডি ফুডের উপর নির্ভর করতে হবে। একটু আয়োজন করে নানা পদের ইফতার করতে চাইলে সেটার ব্যবস্থা সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেই করতে হবে। আবার সাপ্তাহিক দিনগুলোতে ঈদের কেনাকাটাও শুরু করতে হবে একটু একটু করে। রমজান মাসের শেষের দিকে মার্কেটগুলোতে ভীড়ের জন্য পা ফেলা দায় হয়ে যায়। ”
আইরিন পারভীন চাকরি করেন সরকারী একটি ব্যাংকের হেড অফিসে। রোজায় ব্যাংকের সময়সূচী এবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। অফিস শেষে মতিঝিল থেকে মিরপুরে বাসায় আসতে তার প্রায় দুই ঘন্টা লেগে যায়। তাই ছুটির দিনগুলো ছাড়া ইফতারের জন্য কেনা খাবারের ওপরেই নির্ভর করতে হয়। তিনি বলেন, “ইফতারটা ওয়ার্কিং ডে তে কোনোভাবে সামাল দেই। সকালে চিড়া ভিজিয়ে রেখে যাই। একসাথে দুই-তিন দিনের জন্য ছোলা একদিন রাতে রান্না করে রাখি। ইফতারের পরপরই রাতের ও সেহেরির রান্না একসাথে করে ফেলি। তাতে সময় বাঁচে। আর রোজার বাজার করে রাখি আগেই যাতে এ মাসে বাজার করার বাড়তি প্রেশার না পড়ে।”
পরিকল্পনামাফিক অফিসের কাজ
রোজার মাসে অফিসের কাজটা সময়মতো ম্যানেজ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন রোখসানা। তিনি বলেন, “আমি এখন থেকেই চিন্তা করছি রমজানের এই এক মাসের ভেতর আমার কী কী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো থাকবে। যেমন, মার্চ মাসে যাদের চাকরির কনফার্মেশন লেটার দিতে হবে সেগুলোর কাজ আমি এখন থেকেই করতে শুরু করে দিয়েছি। এছাড়াও একটা মাসে কী কী গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকতে পারে তা আগে থেকেই বোঝা যায়। সেভাবে কাজগুলোর জন্য সময় নির্ধারণ করে নিয়ে প্রায়োরিটি অনুসারে কাজগুলো করলে সব কাজ ঠিকঠাক সময় মতো করা যাবে বলে মনে করি।”
নাসরীন অফিসের কাজ সারবার জন্য কাজে লাগাবেন লাঞ্চ টাইমটাকে। বললেন, “রমজানে যেহেতু লাঞ্চ টাইম নাই, তাই দুপুররের নামাজের পর একটানা কাজ করলে ঠিক সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব।”
ঘুমের সময় নির্ধারণ
রমজান মাসে রোজাদারদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় ঘুমের। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক, কান গলা (ইএনটি) বিশেষজ্ঞ ডা. মো. মাহবুবুল হক পরামর্শ দিলেন, “সন্ধ্যা রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এ রাতে তারাবীর নামাজের পর রাতের খাবার খেয়ে রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। অনেকে রাতে না ঘুমিয়ে সেহরি পর্যন্ত জেগে থাকেন, সেটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। বরং সেহেরীর পরে আর না ঘুমিয়ে একটু খোলা হাওয়ায় হেঁটে আসতে পারেন। মেডিটেশন করতে পারেন। এছাড়া যারা পড়াশোনা করছেন, তারা এ সময়টাতে নিরিবিলি পড়াশোনা করতে পারেন।"
ব্যায়ামের জন্য সময় বের করবেন কিভাবে
ফিটনেস কোচ ও বাংলাদেশ বডি বিল্ডিং ফেডারেশনের জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড় রাশেদ রবিন রমজান মাসে ব্যায়াম করার ব্যাপারে পরামর্শ দিলেন। তিনি বলেন, “রমজান মাসে রোজা রেখে সাধারণত সকালবেলা খুব কম লোকজনই ব্যায়াম করেন। ব্যায়াম করার ভালো সময় হলো ইফতারের ঘন্টাখানেক আগে ও ইফতারের পরে। যারা ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন তারা ইফতারের আগে ব্যায়াম করতে পারেন। সে সময়ে খালি পেটে এক্সেরসাইজ, ওয়েট ট্রেনিং করলে ফ্যাট বার্নিং বেশি হয়। এছাড়া একজন সুস্থ ব্যক্তি ইফতারের পর ৩০ মিনিট থেকে ৪৫ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে ব্যায়াম করতে পারেন। তবে রোজা রাখলে ব্যায়ামগুলো মধ্যম মানের হতে হবে। রোজাদার ব্যক্তির খুব বেশি শক্ত ব্যায়াম করবার প্রয়োজন হয় না। ফ্রি হ্যান্ড, ওয়েট ট্রেনিংয়ের মতো ব্যায়াম করার পর কেউ চাইলে কিছু সময় কার্ডিও করতে পারে। সব মিলিয়ে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা ব্যায়াম করাই যথেষ্ট। অর্থাৎ এই এক মাস একদম ব্যায়াম ছেড়ে না দিয়ে রেগুলারিটি মেইনটেইন করতে হবে।”
ডায়বেটিস রোগীর সময়-ব্যবস্থাপনা
ডায়বেটিস রোগী রমজানে কীভাবে শরীরের যত্ন নিবেন, কীভাবে সঠিক সময়ে ওষুধ ও ইনসুলিন গ্রহণ করবেন সে ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন বারডেম হাসপাতালের পুষ্টি বিভাগের প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান শামসুন্নাহার নাহিদ মহুয়া। তিনি বলেন, “যেসব ডায়াবেটিস রোগী মুখে খাওয়ার ওষুধ ও ইনসুলিন নেন তাদের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম হলো সকালে ওষুধ বা ইনসুলিনের যে ডোজটা নিতেন সেটা ইফতারে নেবেন আর রাতের ডোজের হাফ ডোজ সেহরিতে নেবেন। তবে ব্লাডসুগার টেস্ট করে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধের ডোজ ঠিক করে নেয়া ভালো। ডায়েবেটিস রোগীরা সেহরির পরে না ঘুমিয়ে দুপুরের আগ পর্যন্ত দিনের প্রয়োজনীয় কাজগুলো শেষ করতে পারেন। দুপুরের পরে যতটা সম্ভব বিশ্রাম নেয়া উচিৎ কারণ দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকার পর ইফতারের আগে বেশি কায়িক পরিশ্রম করলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”
সময় রাখুন ঈদের কেনাকাটার জন্য
ছুটির দিনগুলোতে পরিকল্পনা করে ঈদের কেনাকাটাগুলো সেরে ফেলুন। রমজান মাসের শেষের দিকে মার্কেটে অনেক ভীড় বেড়ে যায় তাই শুরুর দিকেই কিছু কেনাকাটা সেরে রাখুন। যে পোশাকগুলো দর্জিবাড়ি পাঠাতে হবে সেগুলো রমজান মাস শুরুর আগে আগেই পাঠিয়ে দিন। চেষ্টা করুন আপনার এলাকার আশেপাশের মার্কেট থেকেই বেশিরভাগ কেনাকাটা সারতে। তাহলে অনেক কম সময়ে এই বড় কাজগুলো শেষ করতে পারবেন।