উপাত্ত সুরক্ষা আইন নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগ

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বাংলাদেশে যখন তুমুল ‘সমালোচনা’ তখন ‘উপাত্ত সুরক্ষার’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেশটির সরকার আরেকটি নতুন আইন চূড়ান্ত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আইনের খসড়া প্রকাশ্যে আসার পর আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে ইতিমধ্যে তিনবার সম্পাদনা করা হয়েছে। সর্বশেষ খসড়াটি গত মঙ্গলবার (১৪ মার্চ) সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আইনটি কার্যকর হলে সাধারণ মানুষের যোগাযোগের গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন দেশটির সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলা হয়েছে, ‘‘আইনটি বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদে পরিণত হতে যাচ্ছে।’’

উদ্বেগ যেখানে

আইনের খসড়ায় তিনবার পরিবর্তন আনা হলেও কিছু ধারা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের। খসড়াটি পর্যালোচনার পর মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, "উপাত্তের সংজ্ঞা সেই আগের মতোই অস্পষ্ট। এ ছাড়া ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সংজ্ঞা ও মানদণ্ড কী হবে, তাও খসড়ায় উল্লেখ নেই। খসড়া পড়ে মনে হয়েছে সরকার চাইলেই যে কোনো ব্যক্তির ডিজিটাল তথ্য নিতে পারবে। বলা হয়েছে উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সির মহাপরিচালক নিয়ন্ত্রক, প্রক্রিয়াকারী বা সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় উপাত্ত সরবরাহ করার নির্দেশ দিতে পারবেন। নিয়ন্ত্রক, প্রক্রিয়াকারী বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এ নির্দেশনা পালনে বাধ্য থাকবেন।’’

খসড়ায় ধারা ১০ নিয়ে জাতিসংঘ আগেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই ধারায় বলা আছে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বা অপরাধ প্রতিরোধ, শনাক্ত ও তদন্ত করার উদ্দেশ্যে উপাত্তধারীর কাছ থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা যাবে।

এ বিষয়ে জাতিসংঘ বলেছিল, ‘‘এই ধারা থাকলে বাংলাদেশের ডেটা সেন্টার (উপাত্ত সংরক্ষণ কেন্দ্র) ও সার্ভারগুলোয় সংরক্ষিত উপাত্ত নজরদারির আওতায় আসবে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর ওপর গোপনীয় তথ্য প্রকাশের চাপ সৃষ্টি হবে। এই ধারা গণতান্ত্রিক শাসনকে দুর্বল করতে পারে।’’

আইনের খসড়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারেরও উদ্বেগের কথা জানা গেছে। রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ‘বাংলাদেশে অনলাইন স্বাধীনতা ও ব্যবসায় বিনিয়োগ’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘‘যদি ডেটা স্থানীয়করণের শর্তকে কঠোরভাবে আরোপের মাধ্যমে ডেটা সুরক্ষা আইন পাস করা হয়, তাহলে বর্তমানে বাংলাদেশে কাজ করছে এমন কিছু আমেরিকান কোম্পানি বাজার ছেড়ে যেতে বাধ্য হতে পারে।’’

আইনটি বাংলাদেশের জন্য ‘নেতিবাচক’ প্রভাব ফেলতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘‘প্রতিদিন যে কোটি কোটি বাংলাদেশি ব্যবহারকারী তাদের সেবা নিচ্ছেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’’

তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস নাগরিক সমাজের অনেক সংস্থা এবং সাংবাদিকের কাছ থেকে এ আইন বিষয়ে শুনেছে। তাদের শঙ্কার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এই নিয়ম ও আইন মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতাকে সীমিত করবে।’’

পিটার হাস তার বক্তব্যে একটি স্বাধীন ডেটা তদারকি কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা রাখার ওপর জোর দেন। নতুন খসড়াটি ঘেঁটে দেখা গেছে নবম অধ্যায়ে এজেন্সি গঠনের বিষয়ে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে সরকারকে। খসড়ায় লেখা হয়েছে এভাবে, ‘‘এজেন্সি গঠন, কার্যালয় ইত্যাদি-(১) এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, ১ (এক) জন মহাপরিচালক ও ৪ (চার) জন পরিচালকের সমন্বয়ে বাংলাদেশ উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সি নামে একটি এজেন্সি গঠন করিবে। (২) মহাপরিচালক এজেন্সির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হইবেন। (৩) এজেন্সির প্রধান কার্যালয় ঢাকায় থাকিবে, তবে সরকার, প্রয়োজনে, ঢাকার বাহিরে দেশের যে-কোনো স্থানে উহার শাখা কার্যালয় স্থাপন করিতে পারিবে।’’

উপাত্তের ওপর সরকারের ক্ষমতার ধারণা পাওয়া যায় চতুর্দশ অধ্যায়ের বিবিধ অংশে। সেখানে এভাবে বলা হয়েছে, ‘‘প্রতিবেদন ইত্যাদি-সরকার, প্রয়োজনে, সময়ে সময়ে, মহাপরিচালকের নিকট হইতে এই আইনের অধীন সম্পাদিত যে-কোনো বিষয়ে প্রতিবেদন বা বিবরণী আহ্বান করিতে পারিবে এবং উক্তরূপে কোনো প্রতিবেদন আহ্বান করা হইলে মহাপরিচালক সরকারের নিকট উহা সরবরাহ করিবেন।’’

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশেলেট ২০২২ সালে আগের খসড়ার অব্যাহতি বিষয়ক ধারা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। নতুন খসড়ায় সেখানে তেমন কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। লেখা আছে এভাবে, ‘‘৩৪। অধিকতর অব্যাহতি প্রদানের ক্ষমতা-(১) সরকার, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা, কোনো নিয়ন্ত্রককে এই আইনের কোনো বিধানের প্রয়োগ হইতে, ধারা ৩৩-এ বর্ণিত ক্ষেত্রের অতিরিক্ত হিসাবে, অব্যাহতি প্রদান করিতে পারিবে। (২) উপধারা (১)-এর অধীন অব্যাহতি প্রদানের ক্ষেত্রে সরকার উহার বিবেচনায় প্রয়োজনীয় শর্ত আরোপ করিতে পারিবে।’’

এ বিষয়ে নূর খান বলছেন, "এই আইনে জবাবদিহিতার বিষয়টি অস্পষ্ট। ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশে বাধার আশঙ্কা থাকবে। খসড়ায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এক ধরনের অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে সুরক্ষিত চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার অধিকার এই আইনে নড়বড়ে হয়ে যাবে। অনুচ্ছেদ ৪৩-এ জনগণের যোগাযোগের গোপনীয়তার যে অধিকারের কথা বলা হয়েছে, সেটি আর থাকবে না। আমি মনে করি এই আইনের মাধ্যমে জনগণের বাকস্বাধীনতা এবং মানবাধিকারকে আরও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।’’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক আইনটি এখনো পর্যবেক্ষণ করছেন জানিয়ে বলেন, "আমেরিকায় আইন হওয়ার দুই বছর আগে জাজ সার্কুলেট করেন। আমাদের এখানে সেটি করা হয় না। তাই এখনই আইনটি নিয়ে কিছু বলতে চাই না।"

সরকারের কী বলছে

আইনটির বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "আমরা আমাদের দেশের নাগরিকদের উপাত্ত সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এই সুরক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করেছি। এটি তৃতীয় খসড়া। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেটা প্রটেকশন রুলস অনুসরণ করে এটি তৈরি করেছি। আমরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন এনজিও এবং ইন্টারন্যাশনাল নন গভর্মেন্ট অর্গানাইজেশন, ইউএন অর্গানাইজেশন এবং বিভিন্ন দেশের যারা কূটনীতিকেরা আছেন তাদের সঙ্গে এবং আইনজীবীদের সঙ্গে বসে খসড়া চূড়ান্ত করছি। আশা করছি ভবিষ্যতের জন্য একটি উদার আইন করতে পারব। এটা ভবিষ্যতে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদে পরিণত হতে যাচ্ছে। নাগরিকদের তথ্য, উপাত্ত সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইনটি করা হচ্ছে।"

সুশীল সমাজের অনেকেই আইনটি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, "আমরা তাদের সর্বশেষ খসড়াটি দেখার জন্য অনুরোধ করবো। এটা দেখে তারা পরামর্শ দিলে আমরা বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যতমুখী উপাত্ত সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করব, যাতে যেকোনোভাবেই এটি সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকে।’’