গতবছর জনপ্রিয় ভারতীয় সংগীত শিল্পী ও সুরকার বাপ্পি লাহিড়ী যে রোগে মারা যান তার নাম অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া সংক্ষেপে ওএসএ। চিকিৎসকদের মতে, অবসট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ঘুমন্ত অবস্থায় মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা সাধারণ মানু্ষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট কলেজ অফ মেডিসিনের গবেষকগণ ২০২০ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৪২ হাজারের বেশি রোগীর উপর গবেষণা করেন। তাদের প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (ওএসএ) আক্রান্ত ব্যক্তির ঘুমের ভেতর শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ঝুঁকি বাড়ে। স্লিপ অ্যাপনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের কার্ডিওভাসকুলার মৃত্যু সহ বিভিন্ন কারণে আকস্মিক মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। গবেষকদের মতে, বর্তমান বিশ্বে জীবনযাত্রা ব লাইফস্টাইল সহ বিভিন্ন কারণে ১ বিলিয়ন লোকের উপরে ওএসএ প্রভাব ফেলতে পারে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া কী এবং এর উপসর্গ
আমরা ঘুমিয়ে পড়লেও আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়মমাফিক চলতে থাকে। কিন্তু কারোওর কারোওর ক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যে স্বল্প সময়ের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া বা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এটি মূলত শ্বসনতন্ত্রের উপরিভাগের সমস্যা। ঘুমের মধ্যে বারবার শ্বাসনালীর উপরের দিকে শ্বাস চলাচলে বাধা এলে তাকে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া বলা হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক, কান গলা (ইএনটি) বিশেষজ্ঞ ডাঃ মোঃ মাহবুবুল হক বললেন, “স্লিপ অ্যাপনিয়া সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন – সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া, অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া ও কমপ্লেক্স স্লিপ অ্যাপনিয়া। এদের মধ্যে সবচেয়ে কমন হলো অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া।”
তিনি বলেন, “সাধারণত স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগী দু ধরণের উপসর্গ নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। এর একটি হলো ঘুমের ভেতর নাক ডাকা। দ্বিতীয়টি হলো নাক ডাকার পাশাপাশি তাঁর ঘুম ভেঙে যাওয়া। এটাকে আমরা স্লিপ অ্যাপনিয়া বলি। এর মানে হলো ঘুমের ভেতর শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া। সিভিয়ার ফর্মে পৌঁছলে এটি অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া হয়। প্রাথমিক উপসর্গ হলো শুধুই নাক ডাকা। সাধারণত রোগীদের কমপ্লেইন থাকে তিনি একটানা ঘুমাতে পারেন না। রাতে বারবার তার ঘুম ভেঙে যায়। মুখ ভেতরটা শুকিয়ে যায়। সারাদিন ঘুম ঘুম লাগে। কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। মাথা ব্যথা হয়। রোগীর যৌনজীবন ব্যহত হয়। ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়। যেহেতু মনোযোগের অভাব হয়, ঘুম ঘুম লাগে, তাই ড্রাইভিং করতে সমস্যা হয়। পরিবারের সদস্যরা রোগীর নাক ডাকার শব্দ পান কিন্তু যিনি রোগী তিনি তা বুঝতে পারেন না। মর্নিং হেডেক, অবসাদ ও বিষন্নতা দেখা দেয়।”
কী কারণে হয় স্লিপ অ্যাপনিয়া
ডাঃ মোঃ মাহবুবুল হক জানালেন, অবিসিটি এর একটি প্রধান কারণ। যাদের বিএমআই ৩০-এর কাছাকাছি, তাদেরই এসব সমস্যা বেশি হয়। বিশেষ করে যাদের হঠাৎ করেই ওজন বৃদ্ধি পেয়েছে তারা স্লিপ অ্যাপনিয়াতে ভুগতে পারেন। যাদের ঘাড় ছোট, চল্লিশোর্ধ ব্যক্তি তাদের যেমন এর ঝুঁকি থাকে, তেমনি মস্তিষ্কের বিভিন্ন সিগন্যালের কারণেও এই রোগ হতে পারে। অনেক ধরণের অবস্ট্রাকটিভ কারণ থাকতে পারে। এরমধ্যে আরেকটা হলো টনসিল। টনসিল যদি আকারে বড় থাকে সেকারণে হতে পারে। নাকের ভেতরে হাড় বাঁকা থাকলেও হতে পারে। স্বরযন্ত্র ও শ্বসনতন্ত্রের নানাবিধ সমস্যার কারণেও হতে পারে। এছাড়া উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এ ধরণের অসুখেও অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে। নারীদের তুলনায় পুরুষরা এ সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হন। আবার হৃদপিন্ড, ব্রেইন এবং নিউরো সমস্যা থেকে কোনো ব্যক্তির শরীরের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম-এ নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে এবং ওই ব্যক্তি যে স্লিপ অ্যাপনিয়া-এ ভোগেন সেটাকে বলে সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া।
বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের জেনারেল ফিজিশিয়ান ডাঃ মোঃ মেহেদী হাসান বলেন, “নাকের পেছনে মুখগহ্বর থেকে শুরু করে ফুসফুস পর্যন্ত আমাদের যে শ্বাসনালী রয়েছে এখানে যদি কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকে অথবা এই শ্বাসনালী যদি সরু হয়ে যায় তখনই নাক ডাকার শব্দ হয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যহত হয়, শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়, এই অবস্থাটাই আসলে স্লিপ অ্যাপনিয়া। চল্লিশোর্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়। তবে শিশুদের ক্ষেত্রেও হতে পারে, যদি কারো অ্যাডিনয়েড বা টনসিল বড় থাকে তাদের এ সমস্যা দেখা যায়। এছাড়া শিশুদের সাইনোসাইটিসের সমস্যা, নাকে পলিপ, নাকের হাড় বাঁকা থাকলেও স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে। এ এক্ষত্রে রেডিওলোজিক্যাল এক্স-রে করে এয়ারওয়ে সরু কি না তা নির্ণয় করা যায়। বয়স্কদের মধ্যে যারা ধুমপান করেন, অ্যালকোহল পান করেন তাদের এ সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বার্ধক্যের কারণে আমাদের শরীরের উপরিভাগের বিশেষ করে ঘাড়ের পেশীগুলো, গলার ভেতরের পেশীগুলো ছেড়ে দেয় অর্থাৎ রিলাক্স হয়ে যায় তখন শ্বাস-প্রশ্বাসের রাস্তা বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেক্ষেত্রেও এ ধরণের স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে।”
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
রোগীর স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে কি না তা কীভাবে নির্ণয় করা যায়, এ প্রশ্নের উত্তরে ডাঃ মোঃ মাহবুবুল হক জানালেন, “স্লিপ অ্যাপনিয়া নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রধান পরীক্ষা হলো পলিসোমনোগ্রাফি। এর মাধ্যমে আমরা রোগ নির্ণয় করতে পারি। এটা করলে ঘুমানোর সময় রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাসের অবস্ট্রাকশান, ব্রেইন সিগন্যাল, ব্লাড প্রেশার বেশি কিনা, কার্ডিয়াক কোনো প্রবলেম হচ্ছে কিনা ইত্যাদি বোঝা যায়।”
চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি বলেন, “রোগী যদি স্থুলকায় হয় আমরা তাকে ওজন কমাতে বলি। বিএমআই ২৫-এর নিচে নামাতে বলি। যে কোনোভাবেই হোক তাকে ওজন কমাতেই হবে। ওজন কমানোর পরেও যদি রোগীর এই সমস্যা থেকে যায়, তখন মেডিসিন কিংবা ডিভাইসের শরণাপন্ন হই, যেমন কন্টিনিউয়াস পজেটিভ এয়ারওয়ে প্রেশার (CPAP) আছে। শেষ চিকিৎসা হলো সার্জারি করা। বিভিন্ন ধরণের ফেরিঙ্গোপ্লাস্টি আছে। এছাড়া কোনো বিশেষ কারণ যেমন টনসিল বড় হলে, নাকের বাঁকা হাড় থাকলে সেগুলোও সার্জারি করে ঠিক করা হয়। এছাড়া আরো অন্যান্য সমস্যার জন্যও সার্জারি করতে হতে পারে। ”
অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া থেকে মৃত্যুঝুঁকি
এই রোগটি সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষের ধারণা খুব কম। অনেকেই বুঝতে পারেন না যে, তারা স্লিপ অ্যাপনিয়াতে ভুগছেন। ডাঃ মোঃ মাহবুবুল হক জানালেন, বাংলাদেশে স্লিপ অ্যাপনিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে যা ঘুমের ভেতর মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে। নিয়মিত চিকিৎসা করালে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব। স্লিপ অ্যাপনিয়ার কারণে ঘুমের ভেতর শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাপ্রাপ্ত হয়। ১০ সেকেন্ডের বেশি এমন অবস্থা থাকলে দেহে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশ কমে যেতে পারে। এর ফলে হঠাৎ করে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মৃত্যু হতে পারে। ব্লাড প্রেশার বেড়ে গিয়ে স্ট্রোক হতে পারে। হৃদরোগের ঝুঁকি থাকে এবং ডিমেনশিয়া হতে পারে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া এড়াতে ও ভালো ঘুমের জন্য যা করণীয়
স্লিপ অ্যাপনিয়া এড়াতে এবং ভালো ঘুমের জন্য চিকিৎসকরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলো হলো-
- ঘুমের জন্য শান্ত পরিবেশ খুব প্রয়োজন। বিছানা, ঘরের তাপমাত্রা, আলো সবকিছু ঘুমোনোর উপযোগী বা আরামদায়ক হতে হবে
- প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম করা প্রয়োজন
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বিএমআই ঠিক রাখতে হবে। সুষম খাবার খেতে হবে
- টেনশন বা উদ্বেগ মুক্ত জীবন যাপন করতে হবে।
- স্লিপ হাইজিন মেনটেইন করতে হবে। যেমন: দিনেরবেলা অকারণে বিছানায় শুয়ে থাকা যাবে না শুয়ে শুয়ে টিভি দেখা, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন সহ যে কোনো ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে হবে
- রিলাক্সেশন থেরাপি, মেডিটেশন, শ্বাসের ব্যায়াম ঘুমের সমস্যা কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকরী
- এরপরও ঘুমের সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে বা চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে