পাঁচ ইঞ্চি বাই আট ইঞ্চির একটা কালো রঙের চামড়ার বাঁধানো খাতা। বর্তমানে পাতাগুলি খানিকটা আলাগা ও হলদেটে হলেও বেশ স্পষ্ট সুন্দর হাতের লেখায় আজও জ্বলজ্বল করছে খাতার ১৪৭ পাতায় গানের কথাগুলি। নীচের বাঁ দিকে লেখা ‘আকাশবাণীতে প্রচারিত হয় -১৩/০৪/১৯৭১ ও রেকর্ড করা হয় – ২২/০৪/১৯৭১’। আর গানটি হল গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, অংশুমান রায়ের সুরে ও কণ্ঠে গীত –“শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি...।” চায়ের আড্ডায় বসে সৃষ্টি হওয়া একটি গান হয়ে ওঠে একাত্তরের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের অনন্য প্রেরণা।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং দুই বাংলার অগণিত সাধারণ মানুষের মনে বিরাট আলোড়ন ও উন্মাদনা তৈরি করে এই গানটি। “শুধু তাই নয় আজও বাংলাদেশের যেকোন সরকারি অনুষ্ঠানে গাওয়া হয় এই গানটি”- নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এই তথ্য তুলে ধরেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত লোকসঙ্গীত শিল্পী অংশুমান রায়ের পুত্র সঙ্গীতশিল্পী ভাস্কর রায়।
সকালের চায়ের আড্ডায় ভূমিষ্ঠ হল ঐতিহাসিক গান
তবে, এই গান তৈরি যেভাবে হয় সেটাও এক ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্সের ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় আনুমানিক ১৮ মিনিটের একটি বক্তৃতা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের থেকে প্রচারের অনুমতি না মিললেও ভাষণটি রেকর্ড করা হয় এবং ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে তার অনুলিপি পাঠান হয়। স্পুল টেপ রেকর্ডারে ভাষণটি নিয়ে চায়ের আড্ডায় আসেন ভারতের কলকাতার আকাশবাণী কেন্দ্রের তৎকালীন কেন্দ্র অধিকর্তা উপেন তরফদার। ভাস্কর রায় বলেন- “রামগড়ের (কলকাতার দক্ষিণের এক অঞ্চল) কাছে এক চায়ের দোকানে গৌরী জেঠু (গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার), উপেন জেঠু (আকাশবাণী কলকাতার তৎকালীন কেন্দ্র অধিকর্তা উপেন তরফদার), দেবদুলাল জেঠু (আকাশবাণী কলকাতার সে সময়ের অন্যতম ঘোষক ও সংবাদপাঠক দেবদুলাল বন্ধ্যোপাধ্যায়), দীনেন জেঠুর (সঙ্গীত পরিচালক দীনেন্দ্র চৌধুরী) সঙ্গে বাবা আড্ডা দিতেন। ৭ মার্চ থেকে ১৩ এপ্রিলের মাঝেই কোনও এক দিন এইরকম এক আড্ডায় উপেন জেঠু বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি শোনান এবং এও জানান যে আকাশবাণীর ‘সংবাদ বিচিত্রা’-য় এটির সম্প্রচার নিয়ে তিনি ভাবছেন। তাঁর মতে খুব অল্প সময়ে এক বিরাট সংখ্যক মানুষের কাছে এটি ছড়িয়ে পড়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হল যে, ভাষণটি সম্পূর্ণ সম্প্রচার করা হলেও অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত সময়ের আগেই তা শেষ হয়ে যাবে। সেই ফাঁক পূরণ করতে কী করা যেতে পারে?”
তারপরেই সেই আড্ডাতেই কালক্ষেপ না করে সিগারেটের প্যাকেটে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার গানটি লেখেন গানটি এবং তৎক্ষণাৎ দীনেন চৌধুরির বাড়িতে শুধু হারমোনিয়াম আর শক্ত খাতায় দীনেন চৌধুরির তাল দেওয়ার সঙ্গতে তৈরি হয় গানটি। উপেন তরফদার সঙ্গের স্পুল রেকর্ডারেই গানটি রেকর্ড করে নেন। উপস্থিত শিল্পীদের কেউই এই ঐতিহাসিক ভাষণের সঙ্গে যুক্ত হতে পারার সুযোগ হারাতে চাননি। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে সময়ে পরিকল্পিত ব্যবহার এবং বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির আবেদনকে আরও জোরদার করতেই এই গানের জন্ম। সম্প্রচারের দিন অর্থাৎ ’৭১-এর ১৩ এপ্রিল এই গানটি ভাষণের মাঝে মাঝে বাজানো হয়েছিল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই পুরো অনুষ্ঠান বিশেষত গানটি অদ্ভুতভাবে সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
রেকর্ড হল বাংলা ও ইংরেজিতে
এই ঘটনার ঠিক ৯ দিন পর ‘হিন্দুস্তান রেকর্ড’ থেকে বাংলা ও ইংরাজি (ইংরাজি অনুবাদটি করেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার; কণ্ঠ- করবী নাথ ও অংশুমান রায়) উভয় ভাষাতেই গানটি রেকর্ড হয়। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন দীনেন্দ্র চৌধুরী।
ইংরেজি অনুবাদে গানের শুরুটি এইরকম –
“The voice of not one but a million
Mujiburs singing
They fill and thrill the sky
With the echoes ringing-
Bangla Desh! My Bangla Desh!...”
সরকারি স্বীকৃতি মেলেনি পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতে
’৭১-এর গানগুলির মধ্যে এই গানটি একটি শক্তিশালী মাইলস্টোন। ভাস্কর রায়ের বক্তব্য– এই ধরণের ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িত গানের প্রতি ভালবাসা যেন নির্দিষ্ট প্রজন্মের মধ্যে থেকে হারিয়ে না যায়। পরবর্তী প্রজন্ম যেন তাদের শিকড়, তাদের ইতিহাসের প্রতি যত্নবান হয় সে বিষয়ে আপামর বাঙালি জাতিকে আরও সচেতন ও সংবেদনশীল হতে হবে। “তবে যে সঙ্গীত দুটি দেশের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক সেতু রচনা করল তার শিল্পীদের পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কোনরকম সরকারি সম্মান এখনও জানানো এখনও হয়নি। বাবার কাছে এ বড় যন্ত্রণার। আমি একমাত্র সেই যন্ত্রণা জানতাম। বাবা সেই যন্ত্রণা বুকে নিয়েই চলে গেলেন,” ভয়েস অফ আমেরিকা-কে জানালেন তিনি।
বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি ও সম্মাননা প্রদান
এর পাশাপাশি তিনি এও জানান, গানটি ‘বঙ্গবন্ধু’-র খুবই প্রিয় ছিল এবং তিনি অংশুমান রায়কে ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ড মেডেল’ প্রদানের কথাও লেখেন একটি চিঠিতে। ১৭ আগস্ট ১৯৭৫-এ সম্মান নিতে যাওয়ার কথা থাকলেও ১৫ই আগস্টের বিধ্বংসী রাত সব তছনছ করে দেয়। এই ঘটনার দীর্ঘ ৩৭ বছর পর ২০১২ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ সরকার অংশুমান রায়কে ‘মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সম্মান’ এবং ‘মরণোত্তর মুক্তিযোদ্ধা সম্মান’ প্রদান করে। যে কন্যার পিতার জন্য গাওয়া গান তিনি সম্মানিত করবেন সেই পুত্রকে যাঁর বাবা গানটি গেয়েছেন – তাঁর কাছে এ ছিল এক অনন্য প্রাপ্তি। তিনি বলেন, “আমার কাছে বাংলাদেশ যাওয়া, তাঁদের আতিথেয়তা, সর্বোপরি বাবার গানকে যেভাবে সম্মান জানানো হয় তা সত্যিই এক ঐতিহাসিক ঘটনা, আবেগঘন মুহূর্ত।” তিনি যোগ করেন, এই সম্মানের অংশীদার শুধু তাঁর বাবা নন, এ সম্মান বাঙালি জাতির, সবার।
মুজিব শতবর্ষ ও ‘শোন একটি মুজিবুরের থেকে...’
বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করে ২০২০-এর ১৭ মার্চ থেকে ২০২২-এর ৩১ মার্চ পর্যন্ত। এই উদ্যাপনের নাম ছিল ‘মুজিব শতবর্ষ’ বা ‘মুজিব চিরন্তন’। ভাস্কর রায় জানান, এই উদ্যাপনের থিম সঙ্গীত হিসাবে ‘শোন একটি মুজিবুরের থেকে...’ গানটি ব্যবহারের জন্য তাঁর কাছে সরকারিভাবে মেইল পাঠানো হয়, এমনকি সাম্মানিক গ্রহণের অনুরোধও করা হয়। “বাবার গানের প্রতি এই অভিনব সম্মান প্রদর্শনে নিশ্চিতভাবেই আমি সম্মতি দিই। সাম্মানিক গ্রহণ করিনি অবশ্যই, কিন্তু মুজিব শতবর্ষ উদ্যাপনে এই গানকে থিম সঙ্গীত করা নিঃসন্দেহে এক বড় ব্যাপার,” বক্তব্য তাঁর।
বাংলাদেশের ইতিহাস, আগামী প্রজন্ম ও ‘...লক্ষ মুজিবুরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি’
ভাস্কর রায় আশা করেন ভবিষ্যতে এই গানটি নিয়ে আরও চর্চা ও কাজ হবে, স্বপ্ন দেখেন এক মিউজিয়াম-এর। কারণ বাংলাদেশের প্রবীণ তো বটেই নবীন প্রজন্মের কাছে এই গান অত্যন্ত জনপ্রিয়, বহু শিল্পী গান। গানের ইতিহাসটি হয়তো অনেকের অজানা, তাই নবীন ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে গানটির বিষয়ে সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে আগ্রহী তিনি। বললেন, “আমি ইউ টিউবে গানটি আপলোড করলে বাংলাদেশের কত অসংখ্য মানুষ ভালবাসা, শুভেচ্ছা, সম্মান পৌঁছে দেন। তাঁদের কথায় বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও এই গানটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে এই গানটিও রয়ে যাবে। এ এক বিরাট প্রাপ্তি।”