- শাহ বাবুল আহমেদ একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী চাকুরীজীবী। তিনি একজন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। ছোটবেলায় টাইফয়েড জ্বরে তিনি শ্রবণ ক্ষমতা ও কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। তাঁর স্ত্রীও জন্মগতভাবে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। বাবুল আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী ইশারা ভাষায় কথা বলেন। তাঁর কন্যা বদরুন নাহার তমা ইশারা ভাষার দোভাষী হিসেবে কাজ করেন।
- শিরিন আক্তার রূপা ও তার স্বামী মনোয়ার হোসেন ইশারা ভাষার দোভাষী হিসেবে কাজ করছেন। রূপার বাবা ও মা দুজনেই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। একজন খালা এবং একজন মামাও বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। তাদের জীবনসঙ্গীরাও কথা বলতে পারেন না। রূপার বাবা চাকরি করতেন রাজধানী ঢাকার বিজয়নগরের মূক ও বধির স্কুলে। রূপা যখন খুব ছোট তখন তাঁর বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। মা বর্তমানে জাতীয় বধির সংস্থায় চাকরি করছেন।
উপরে উল্লিখিত বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সকলেই ইশারা ভাষায় কথা বলেন এবং তাদের সন্তানরাও তাদের সকল কাজের সহযোগী হবার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইশারা ভাষা শিখেছেন এবং দোভাষী হিসেবে কাজ করছেন।
ইশারা ভাষা কী?
সংকেত বা হাতের মুদ্রা ও মুখমন্ডলের অভিব্যক্তির মাধ্যমে যে বাচন তাকে ইশারা ভাষা অথবা প্রমিত বাংলায় সংকেত ভাষা বলা হয়। সারা বিশ্বে এটি একটি স্বীকৃত ভাষা। সেইসব মানুষ যাদের বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী বলা হয় তারা হাতের বিভিন্ন মুদ্রায়, ইশারার মাধ্যমে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, মনের ভাব প্রকাশ করেন। আর এটাই হলো ইশারা ভাষা (sign language)।
বিশ্বব্যাপী সংকেত ভাষার সংখ্যা সঠিকভাবে জানা যায় না। প্রতিটি দেশের সাধারণত তাদের নিজস্ব স্থানীয় ইশারা ভাষা আছে; কোনো কোনো অঞ্চলে একাধিক ইশারা ভাষা আছে। এথনোলগের (Ethnologue) ২০২১ সংস্করণে ১৫০টি ইশারা ভাষা তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। আবার সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ স্ট্রাকচারের সাইন-হাব অ্যাটলাস (SIGN-HUB) ২০০ টিরও বেশি ভাষা তালিকাভুক্ত করে এবং এ ছাড়াও আরও কিছু ইশারা ভাষা আছে যা এখনও নথিভুক্ত করা যায়নি বলে মনে করে বা আবিষ্কৃত হয়নি। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী ভারতীয় উপমহাদেশের ইশারা ভাষা হলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সাংকেতিক ভাষা, এবং এথনোলগ এটিকে বিশ্বের ১৫১তম ‘কথ্য’ ভাষার স্থান দিয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব দ্য ডেফ-এর তথ্য মতে, সারা বিশ্বে প্রায় সাত কোটি বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছেন। অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, নরওয়ে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফিনল্যাল্ড ও সাউথ আফ্রিকা সহ বিশ্বের অনেক দেশ ইশারা ভাষা আইন, ইনস্টিটিউট ও দোভাষী সনদ প্রাপ্তিসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ভাষাকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে। ন্যাশনাল সেনসাস অব দ্য ডিফ পপুলেশন-এনসিডিপির তথ্য মতে, ইংরেজি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে যে ১৩টি ভাষা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত তার মধ্যে স্প্যানিশ এবং চীনা ভাষার পরই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইশারা ভাষা। প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ এই ভাষায় পারস্পরিক ভাব বিনিময় করে থাকেন। উগান্ডা বিশ্বের প্রথম দেশ যারা ১৯৯৫ সালে ইশারা ভাষাকে আইনি স্বীকৃতি দেয়।
ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডাও সংকেত ভাষাকে একাডেমিক ও অফিশিয়াল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার প্রাদেশিক আইনে উল্লেখ আছে, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ইশারা ভাষাকে স্বীকৃতি না দেয় তাহলে একাডেমিক ক্রেডিট সেই প্রতিষ্ঠানের কোনো কোর্সকে গ্রহণ করবে না। ২০১১ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারতে ইন্দিরা গান্ধী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ভারতীয় ইশারা ভাষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ইশারা ভাষা ও তার বর্তমান অবস্থা
বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ৩০ লক্ষ। অথচ দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষ ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩৯৭ জন। যার মধ্যে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯০৭ জন বাক প্রতিবন্ধী ও ৪৭ হাজার ৪৯০ জন শ্রবণ প্রতিবন্ধী। এ দেশে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বাংলা ইশারা ভাষায় মনের ভাব আদান-প্রদান করে থাকেন। বাংলা ইশারা ভাষার ওপর ব্রিটিশ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ-এর একটা বড় প্রভাব রয়েছে। ১৯৬৩ সালে কয়েকজন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মিলে বাংলায় প্রথম গড়ে তোলেন ‘ডিসএবেলড পার্সনস অর্গানাইজেশন’(ডিপিও)। ১৯৬৪ সালে ‘ইস্ট পাকিস্তান মূক-বধির সংঘ’ নামে সংগঠনটি পাকিস্তান সরকারের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার থেকে রেজিস্ট্রেশন লাভ করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা’ হয়, যা সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সমাজসেবা অধিদপ্তর ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’ ইশারা ভাষা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর ডিসএবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট’ (সিডিডি), ‘সোসাইটি অফ দি ডেফ অ্যান্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজার্স’ (এসডিএসএল) বাংলা সংকেত ভাষা বা ইশারা ভাষা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, বিশেষ শিক্ষা বিভাগও বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী এবং ইশারা ভাষা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলা ইশারা ভাষার স্বীকৃতি
২০০৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনকালে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা ইশারা ভাষাকে অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেন ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাংলা ইশারা ভাষা চালুর ঘোষণা দেন। তিনি ৭ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলা ইশারা ভাষা দিবস’ ঘোষণা করেন এবং বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে বিটিভি সহ সব টেলিভিশন সংবাদে ইশারা ভাষা চালুর নির্দেশ দেন। তবে হতাশাজনক ব্যাপার হলো বিটিভি বা বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়া আর কোনো বেসরকারি টেলিভিশন ইশারা ভাষায় সংবাদ চালুর ক্ষেত্রে সদিচ্ছা দেখায়নি। একমাত্র বেসরকারি টিভি চ্যানেল দেশ টিভি তাদের সম্প্রচার শুরুর দিন থেকে ইশারা ভাষার সংবাদ উপস্থাপন করে এলেও গত বছর থেকে তা বন্ধ আছে।
বাংলা ইশারা ভাষার অভিধান
ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে কথা বলেছেন সিডিডি-এর নির্বাহী পরিচালক এ. এইচ. এম নোমান খান। তিনি জানান, ইশারা ভাষার অভিধান তৈরির প্রথম উদ্যোগ নেয় সমাজসেবা অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা। তাদের যৌথ প্রয়াসে প্রথম বাংলা ইশারা ভাষার অভিধান প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। এরপর সিডিডি ১৯৯৭-৯৮ সালে স্ট্যান্ডার্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ম্যানুয়াল তৈরির কাজ শুরু করে। নোমান খান বলেন, “সে সময়ে আমরা গ্রামেগঞ্জে বিভিন্ন স্কুলে যেতাম, এ ধরণের প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়াশোনার বিষয়ে গবেষনা করতাম। তখন আমরা বগুড়ার একটি গ্রামে স্কুলে গিয়ে দেখি সেখানে দুজন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে। একজন শিক্ষক সেখানে ওদের সাইনগুলো দেখে নিজস্ব একটি সংকেত বা হোম সাইন তৈরি করে তাদের সাথে কমিউনিকেট করছেন। এসব দেখেই আমরা চিন্তা করলাম হোম সাইনটাকে কী করে স্ট্যান্ডার্ড সাইনে আনা যায় সে বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে হবে। তখন আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে বাংলা ইশারা ভাষার নমুনা যোগাড় করতে শুরু করি। এর সাথে বিভিন্ন হোম সাইন এবং বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিজস্ব কিছু সাইন নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড সাইন তৈরি করতে শুরু করি। প্রথমে একদম সাধারণ ও পরিচিত শব্দ যেগুলো রোজকার সাধারণ যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয়, সেগুলো বাছাই করে কিছু সাইন তৈরি করি। ঢাকার আশেপাশের এলাকা থেকে আমরা বারো-চৌদ্দ জন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুকে নিয়ে কাজ শুরু করি। আমাদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি টিম কাজ করে। ওই শিশুদের কাছ থেকেই ছোট ছোট সাধারণ শব্দের সাইনগুলো নিয়ে আমরা প্রথমে একটি পাঁচশত শব্দের সংকেতের ম্যানুয়াল তৈরি করি। তারপর আমরা আঞ্চলিক শব্দগুলোর সাইন তৈরির জন্য ঢাকার বাইরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আবার কিছু শিশুকে বাছাই করি। এভাবে এই সাইনগুলো আর্টিস্ট দিয়ে আঁকিয়ে ইলাস্ট্রেশন তৈরি করি। সাইনগুলোর ভিডিও তৈরি করি। এভাবে আমরা ছয়টি ভলিউমে চার হাজার শব্দের সাইন, তার ব্যাখ্যা, ইলাস্ট্রেশন, ভিডিও দিয়ে ম্যানুয়াল তৈরি করেছি। এর পাশাপাশি আরো দুটি ভলিউম তৈরি করেছি। এর একটাতে আছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও এলাকার নাম এবং আরেকটি হলো পকেট ডিকশনারি। এ ডিকশনারিতে যোগাযোগের সাধারণ সংকেতগুলো রয়েছে।”
এসডিএসএল-এর নির্বাহী পরিচালক হাসিবা হাসান জয়া। বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ২০০৭ সালে এসডিএসএল প্রতিষ্ঠিত হয়। ভয়েস অফ আমেরিকার সাথে আলাপকালে জয়া বলেন, “ইশারা ভাষা করুণার ভাষা নয়, এটি একটি সাংকেতিক ভাষা বা কোডিং ভাষা। এ ভাষাকে যথাযথ স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আমরা কাজ করছি। প্রথমে আমরা বাংলাদেশের চৌষট্টিটি জেলা থেকে তরুণ ও বয়স্ক বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এনে কিছু শব্দের কোডিং তৈরি করি যেটা বেড়ে এখন এক হাজার পাঁচশত শব্দের হয়েছে।”
ইশারা ভাষা প্রমিতকরণ কী সম্ভব?
ভয়েস অফ আমেরিকার সাথে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের চেয়ারপার্সন তাওহিদা জাহান। বাংলা ইশারা ভাষা প্রমিতকরণ প্রসঙ্গে তিনি আমাদের বলেন, “গত বছর সমাজকল্যান মন্ত্রণালয়ের প্রতিবন্ধিতা শাখা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। এর দুটো মিটিং হয়েছে। আমার পক্ষ থেকে প্রস্তাব ছিলো একটা অবকাঠামোগত (পরিকাঠামোগত হবে কি?) ভবন হওয়া যেমন প্রয়োজন তেমনি এর কারিকুলাম কী হবে, এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা কী কী করতে চাই, কাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, প্রশিক্ষণ নিয়ে কারা শিক্ষক হবেন, কারা গবেষণা করবেন, এর উদ্দেশ্য কী অর্থাৎ শিক্ষাগত অবকাঠামোও নির্ধারণ করতে হবে। বাংলা ইশারা ভাষা যাদের ভাষা অবশ্যই তাদের মাধ্যমেই সেটার প্রমিতকরণ করতে হবে।”
ইশারা ভাষা প্রমিতকরণের পর্যায় কী হতে পারে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে তাওহিদা জাহান বললেন, “প্রতিটি শিশুই কথা শেখার আগে কিছু সংকেতের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভাবের বিনিময় করে। সেটাকে আমরা বলি বেবি সাইন। এরপর শিশুরা একটা দুটো করে শব্দ বলা শেখে। কিন্তু বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুরা কথা না বলে কিছু সংকেত নিজেরাই তৈরি করে যার মাধ্যমে তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। এটা শুধু সেই সব প্রতিবন্ধী শিশুদের বাবা মায়েরা অথবা পরিবারের সদস্যরাই বুঝতে পারে। এটাকে আমরা হোম সাইন বলি। সাধারণত এক পরিবারের শিশুর সাথে আরেক পরিবারের শিশুর হোম সাইন মেলে না। এছাড়া কিছু লোকাল সাইন আছে অর্থাৎ এক একটা অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার আলাদা আলাদা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ আছে। একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের পরে আমি যখন এধরণের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উচ্চ শিক্ষার কথা চিন্তা করি তখন এই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ এর এতগুলো আঞ্চলিক সংকেতের মধ্যে একটা সংকেতকে প্রমিতকরণ করতে হবে। এই প্রমিতকরণ করার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এনে বিভিন্ন শব্দের জন্য তাদের নির্দেশিত সাইনগুলো দেখতে হবে। তার মধ্য থেকে একটি শব্দের জন্য সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ব্যক্তি যে সাইনটি দেখাবেন সেটাকে ওই শব্দের জন্য নির্দিষ্ট সাইন হিসেবে বেছে নিতে হবে। ধরুন, বাবা শব্দটি বেশিরভাগ বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যেভাবে দেখাবেন সেটাই হবে বাবা শব্দের স্ট্যান্ডার্ড সাইন। অর্থাৎ সংকেত ভাষা যারা ব্যবহার করে তাদের মধ্যে যে সাইনটা বেশি ব্যবহৃত হয় সে সাইনটাই হবে সেই শব্দের প্রমিত সাইন।”
তাওহিদা আরো বলেন, “প্রমিতকরণ করা এখনো সম্ভব হয়নি বলেই একটা পর্যায়ের পরে তাদেরকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছেন কিন্তু অধিকাংশ সময়ে আমরা প্রকৃত অর্থে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী কম পাই। কারণ ওই পর্যন্ত উঠে আসার জন্য পড়াশোনা করবার মতো উপকরণ নাই। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ প্রমিতকরণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সাইনকে ঠিকমত লেখা। তার জন্য উন্নত দেশগুলোতে যেমন আছে, তেমন বাংলা স্টক নোটেশন তৈরি করতে হবে।”
নোমান খান বলেন, “ইশারা ভাষাকে প্রমিতকরণ করতে চাইলে প্রথমত সব শব্দগুলোকে সংকেতে আনতে হবে। আমরা মোটামুটি ভাবে সেটা করেছি। চার হাজার শব্দকে সংকেতে এনেছি। তবে সব শব্দকে সংকেতের আওতায় এখনো আনা সম্ভব হয়নি। আমরা শুধু মাত্র শব্দগুলোকে একত্রিত করেছি। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বাংলা ইশারা ভাষার জন্য বাংলা ব্যকরণকে যুক্ত করা প্রয়োজন। এটা আসলে ভাষা বিজ্ঞানীদের কাজ। তারাই এর প্রয়োগিক বিষয়টি বুঝবেন।” তাঁর মতে, দ্রুতই একটি ইশারা ভাষা ইনন্সিটটিউট তৈরি হওয়া দরকার। ইশারা ভাষার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ইশারা ভাষার দোভাষীদের অবস্থা
প্রতিবেদনের শুরুতে ছিল শাহ বাবুল আহমেদের কন্যা বদরুন নাহার তমার কথা। তিনি দীর্ঘ তেরো বছর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দেশ টিভিতে ইশারা ভাষায় সংবাদ উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু চ্যানেলটি গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে তাদের এ কার্যক্রমটি বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া তিনি জাতীয় বধির সংস্থায়ও দোভাষী হিসেবে কাজ করেছেন। তমা জানালেন, তথ্য মন্ত্রণালয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠান, তথ্যচিত্র তৈরি ইত্যাদি কাজে যেখানে ইশারা ভাষার প্রয়োজন হয় সেখানে দোভাষীদের ডাক পড়ে। তমা বলেন, “বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য তো আমরা ছোটবেলা থেকেই একধরণের হোম সাইন ব্যবহার করতাম। কিন্তু বাবা যেহেতু পড়াশোনা করেছেন, বিভিন্ন শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধীদের সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন তাই তাঁর ভাষাটা শুরু থেকেই স্ট্যান্ডার্ড ছিলো। ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে সেটাই রপ্ত করি। পরবর্তী পর্যায়ে আমি জাতীয় বধির সংস্থা, সিডিডি, এসডিএসএল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। দোভাষীদের পেশাগত অবস্থান নিয়ে তমা বলেন, “বাংলাদেশে আমরা হাতে গোনা কয়েকজন রয়েছি যারা ইশারা ভাষার দোভাষী হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আসলে একমাত্র বিটিভি (বাংলাদেশ টেলিভিশন) ছাড়া আমাদের কাজের ক্ষেত্র নেই । সেখানে বেশ কয়েকজনই এখন কাজ করেন। যেহেতু কেরিয়ার হিসেবে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না তাই অনেকেই দোভাষীর কাজের জন্য সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ শেখার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়েছেন।”
একই রকম কথা বললেন ইশারা ভাষার দোভাষী শিরিন আক্তার রূপা। রূপা বলেন, “ইশারা ভাষার দোভাষী হিসেবে পেশাগত ভাবে কাজ করবার ক্ষেত্র বাংলাদেশের এখনো তৈরি হয়নি। গণমাধ্যমের মধ্যে শুধুমাত্র বিটিভি-তে কাজ করবার সুযোগ রয়েছে। তাই পেশা হিসেবে নিতে চাইলেও এই কাজটাকে পুরোপুরি পেশাগত ভাবে নেয়া যাচ্ছে না। আমরা যারা শহর থেকে এটা শিখছি তারা দেখা যাচ্ছে হয়তো ২-৩ মাস পরে গ্রামের স্কুলগুলোতে ট্রেনিং এর জন্য ডাক পাচ্ছি। সরকারি অনুষ্ঠানে অথবা যদি আদালতে এমন কোনও বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যদি থাকেন যিনি লাঞ্ছিত হয়েছেন বা ধর্ষণ হয়েছেন তখন আমাদেরকে তারা খোঁজ করেন এবং নিয়ে যান। কিন্তু এর জন্য আমরা সব সময় পেমেন্ট পাই না। অনেক ক্ষেত্রেই ভলান্টিয়ারি সার্ভিস দিতে হয়। বিশেষ করে সংস্থা থেকে আমাদেরকে যেসব জায়গায় পাঠানো হয় সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য কোন সম্মানীর ব্যবস্থা থাকে না। তবে রাষ্ট্রীয় যে কোন অনুষ্ঠানে অন্যান্য উপস্থাপকদের মতো ইশারা ভাষার দোভাষীরাও সমান মর্যাদা এবং সম্মানী পেয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কিন্তু বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে দোভাষী নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না।”
রূপা আরো বলেন, “বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী যারা আছেন তাদেরকে তথ্যসেবা নিশ্চিত করবার জন্য আমরা নিজেদের তাগিদেই কাজ করতে চেয়েছি। কারণ ইশারা ভাষা নিয়ে যত বেশি কাজ করা হবে ততই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো থেকে শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বঞ্চিত হবেন না। গত দশ বছরে কাজ করার পর আমার কাছে মনে হয়েছে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে এই জায়গাটা এতটাই ডেভলপ হয়েছে যে তারা ফেসবুক থেকে শুরু করে সব রকম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এখন অ্যাকটিভ থাকছেন। এখানে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ দোভাষীর ট্রেনিংগুলো ছয় মাসের বেশি হয় না। আমরা যারা দোভাষী হিসেবে কাজ করতে চাই তারা যেন এ ভাষার উপর আরও প্রশিক্ষণ নিতে পারি সেটার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশের ইশারা ভাষার যে বই আছে তাতে শব্দ ভান্ডার অনেক কম। যখন আরো শব্দ যোগ হবে এবং প্রমিতকরণ করা হবে তখন এই বাংলা ইশারা ভাষা অনেক সমৃদ্ধ হবে।”
বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইশারা ভাষার চর্চা ও এ ভাষার দোভাষী না থাকার ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা। এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তমা বলেন, “হাসপাতাল, আদালত, ব্যাংক ইত্যাদি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে ইশারা ভাষার দোভাষী নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও দোভাষী থাকা প্রয়োজন। যেমন, আমার নানা ভাই চাকরি করতেন এটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে। তিনি মারা যাওয়ার পর তার পেনশনের টাকা নানু তুলতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর আম্মু তুলতে পারেন, যেহেতু তিনি প্রতিবন্ধী সন্তান তাই এ টাকা তোলার ব্যাপারে তার অগ্রাধিকার রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে নামের বানানে কিছু জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় আম্মুকে বারবার অফিসে যেতে হয়েছে। আম্মুর সাথে আমাকে অথবা আমার ভাইকে যেতে হয়। আর যদি আমরা ব্যস্ত থাকি তাহলে একজন ইশারা ভাষার দোভাষীকে হায়ার করে নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সরকারি অফিসে যদি একজন দোভাষী ব্যবস্থা থাকত তাহলে আম্মুকে একজন দোভাষীকে অর্থ ব্যয় করে নিয়ে যেতে হতো না। আবার সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কোটা রয়েছে কিন্তু ইন্টারভিউ বোর্ডে কোনও ইশারা ভাষার দোভাষী থাকেন না। যিনি চাকরিপ্রার্থী তাকে একজন দোভাষীকে ভাড়া করে নিয়ে যেতে হয় যাতে নিয়োগকর্তাদের তার ভাষা দোভাষীরা বুঝিয়ে দিতে পারেন।”
তমার মতে, স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে অন্তত বেসিক সাইনগুলো যদি অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাহলেও এই শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা উপকৃত হতে পারেন। যাতে এ ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা একা একা চলাফেরা করতে পারেন, যোগাযোগ করতে পারেন মানুষের সঙ্গে সে লক্ষ্যে দোভাষীদের কাজের ক্ষেত্র বাড়াতে হবে এবং সরকারি বিভিন্ন চাকরির মতো দোভাষীর চাকরি ক্ষেত্রে গ্রেডিং সিস্টেম প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
রূপা বলেন, “হাসপাতাল, রেল স্টেশন, ব্যাংক, স্কুল এ ধরনের সকল সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের জায়গাগুলোতে দোভাষী নিয়োগ দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী যারা আছেন তারা অত্যন্ত সমস্যার সম্মুখীন হন। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে নিজেদের কথা বোঝানোর জন্য বাসা থেকে লিখে নিয়ে আসতে হয়। ইশারা ভাষার উন্নয়ন ঘটানো এখন সময়ের দাবি। কারণ শুধুমাত্র ভাষাগত সমস্যার কারণে এই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মেধা দক্ষতা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।”
বাংলা ইশারা ভাষার বর্তমান অবস্থা ও উন্নয়ন
নোমান খান বললেন, “অন্যান্য দেশে ইশারা ভাষা চর্চার ইনস্টিটিউট রয়েছে এবং ইশারা ভাষার ওপর সার্টিফিকেট কোর্স করানো হয়। অন্যান্য ভাষার মতোই ইশারা ভাষার কোর্স থাকা দরকার এবং সেটা বাকিদেরও শেখা উচিত। সেরকম যদি করা যেতে পারে তাহলে এ ভাষার বিস্তৃতি বাড়ানো সম্ভব হবে। ইশারা ভাষা তো শুধু বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য নয়। তারা তো যে কোনো ভাবে নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেট করতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিক মানুষ যাতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, তাদেরকে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারেন সেজন্য স্কুলের পাঠ্যক্রমেও যদি ইশারা ভাষার ওপর একটা অধ্যায় থাকে তাহলে এই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে সবার বেসিক কমিউনিকেশন সহজ হয়। মেইনস্ট্রিমের পড়াশোনাতেও ইশারা ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। সরকারীভাবে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য মাত্র ৭টি স্কুল আছে। এ সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। অন্যান্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তুলনায় বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না বলে এদের মেধাকে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।”
হাসিবা হাসান জয়া জানালেন, “পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সিলেবাসে ইশারা ভাষা অন্তর্ভুক্ত করা আছে। এমনকি প্রতিবেশি দেশ ভারতেও আছে। অথচ আমাদের এখানে এটা শুধু বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাষা মনে করা হয়।” তিনি আরো বলেন, “অনতিবিলম্বে ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য পৃথক শিক্ষা নীতি বা কারিকুলাম, উন্নত ও বাস্তবসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা, কারিগরি শিক্ষা, বিভিন্ন বিষয়ে স্বল্প খরচে দেশ বিদেশে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।”