তালিবান তাদের ক্ষমতা আগের চাইতে আরও বেশি সুসংহত করেছে এবং এই বছর আফগানিস্তান জুড়ে নিরাপত্তায় ব্যাপক উন্নতি করেছে। একই সময়ে, ইসলামপন্থী শাসকরা জনজীবন ও শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীর স্বাধীনতার উপর বিধিনিষেধ অপসারণ করতে অস্বীকার করে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করতে এবং নিষেধাজ্ঞা থেকে পরিত্রাণ পেতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০২১ সালের আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটো-নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা মিত্ররা তালিবানের সাথে দুই দশকের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করার পর তাদের সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নিলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে।
নতুন করে তালিবান শাসনের ১৬ মাসেরও বেশি সময়ে, অর্থনৈতিক পতনের আশঙ্কা, ব্যাপক দুর্ভিক্ষ এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং বিদেশী সাহায্য স্থগিতের কারণে আফগানদের ব্যাপক হারে দেশত্যাগ কমে এসেছে বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু তালিবান শাসন তার মানবাধিকার রেকর্ডের জন্য, বিশেষ করে নারীদের প্রতি আচরণের জন্য কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে।
গত জানুয়ারিতে নরওয়ে আফগানিস্তানের মানবিক ও মানবাধিকার বিষয়ে ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের সাথে তালিবান কূটনীতিকদের বৈঠকের আয়োজন করেছিল। এই উদ্যোগটি আশা জাগিয়েছিল যে ইসলামপন্থী তালিবান পশ্চিমা অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিনিময়ে, নারীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার এবং মেয়েদের জন্য স্কুল খোলার প্রতিশ্রুতি পালন করবে।
কিন্তু এর পরের মাসগুলোর ঘটনা প্রবাহ তালিবান এবং বহির্বিশ্বের মধ্যে ভঙ্গুর সম্পর্ককে আরও টান টান অবস্থায় নিয়ে এসেছে। ইসলামিক আমিরাত নামে পরিচিত কাবুলের নতুন শাসনব্যবস্থা, বারবার প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে নারীর স্বাধীনতা খর্ব করতে শুরু করেছে।
তালিবানের সর্বোচ্চ নিঃসঙ্গ নেতা, হিবাতুল্লাহ আখুদজাদা, মার্চ মাসে সারা দেশে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় পুনরায় চালু হলে কিশোরী মেয়েদের ক্লাস পুনরায় শুরু করার অনুমতি দেওয়ার বিরুদ্ধে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন।
আফগানিস্তানের শাসকরা নারীদের উপর বিধিনিষেধ আরও কঠোর করে চলেছে, পার্ক, সুইমিং পুল এবং ব্যায়ামাগারসহ জনসাধারণের জন্য উম্নুক্ত স্থানে তাদের নিষিদ্ধ করেছে। নারীদের জনসমক্ষে তাদের মুখ ঢেকে রাখতে হবে এবং কেবল মাত্র পুরুষ অভিভাবক সাথে থাকলেই স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলিতে যেতে পারেন বা একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের বাইরে সড়ক পথে ভ্রমণ করতে পারেন। বেশিরভাগ নারী সরকারী কর্মী বলেছেন, তারা কার্যত তাদের বাড়িতে সীমাবদ্ধ বা বেকার হয়ে পড়েছেন।
জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা সরকারগুলি আফগানিস্তানে "মানবাধিকার সংকট" হিসাবে জনজীবন থেকে নারীদের বাদ দেওয়াকে ক্রমাগতভাবে নিন্দা করেছে এবং নিয়মগুলি রদ করার আহ্বান জানিয়েছে।
এছাড়া তালিবান গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকেও নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং সুশীল সমাজের কর্মীদের কাজ করার জায়গা ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়েছে।
বছরের মাঝামাঝি একটি বিরল বক্তৃতায়, আখুন্দজাদা আন্তর্জাতিক ক্ষোভের এবং তাকে নারী ও মেয়েদের উপর নিষেধাজ্ঞা অপসারণের আহ্বানের তিরস্কার করেন।
নরওয়ের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী অ্যানিকেন হুইটফেল্ড এই গত সপ্তাহে অসলোতে একটি অনুষ্ঠানে বলেন, তার সরকার আফগানদের কাছে প্রয়োজনীয় সাহায্য পৌঁছানো নিশ্চিত করার জন্য কাবুলের কর্তৃপক্ষের সাথে অব্যাহত সম্পৃক্ততায় বিশ্বাস করে।
হুইটফেল্ড বলেন, "কিন্তু তালিবান তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। তারা মেয়েদের জন্য স্কুল খোলেনি। তারা একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের দিকে অগ্রসর হয় নি। তারা মানবাধিকারকে সম্মান করে না, উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি প্রকাশ্যে মৃত্যুদন্ডের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে।"
তালিবানের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র আব্দুল কাহার বলখি তার সরকারের নীতির সাফাই গেয়েছেন এবং পারস্পরিক আস্থার ঘাটতি পূরণে অন্যান্য দেশের কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, তিনি আশাবাদী নন তালিবান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আগামী বছর একটি বোঝাপড়ায় আসবে। তিনি বলেন, তালিবানের নীতিগুলি আখুন্দজাদাসহ ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের দ্বারা চালিত হচ্ছে, যারা শাসক গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করে।
কুগেলম্যান বলেন, "লক্ষণ ভালো বলে মনে হচ্ছে না, এবং তালিবান কঠোর নীতিগুলিকে তীব্রতর করছে বলে মনে হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্বিগ্ন করে তুলছে।"
তিনি আরও বলেন, “এবং তালিবানরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পুনর্মিলন, স্বীকৃতি এবং সহায়তার তোয়াক্তা করে না। যদি না তালিবানের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা পরের বছর এমনভাবে পরিবর্তিত হয়, যা নীতির উপর মধ্যপন্থীদের আরও নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে দেয়, আমি সন্দেহ পোষণ করি দুঃখজনকভাবে অনেক কিছুরই তা হলে পরিবর্তন হবে না ।"
তোরেক ফারহাদি নামে একজন সাবেক আফগান কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলেছেন, তালিবান নেতৃত্ব তাদের আন্দোলনের মধ্যে বিভক্ত গোষ্ঠী সৃষ্টি এড়াতে, কট্টরপন্থীদের খুশি করার জন্য শরিয়ার কঠোরতম ব্যাখ্যা ব্যবহার করছে।
ফারহাদি বলেন, “তবে, এটি সামগ্রিকভাবে ইসলামী বিশ্বাসের ভুল চিত্র তুলে ধরে। অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশন [মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলির গ্রুপ] কিশোরী মেয়েদের স্কুল বন্ধ থাকা পর্যন্ত তালিবান শাসনকে স্বীকৃতি দিতে অনিচ্ছুক ।”
ফারহাদি বলেন, "বলা বাহুল্য, পশ্চিমা দেশগুলি তালিবান শাসনের প্রতিনিধি এবং দূতদের তাদের নিজস্ব রাজধানীতে রাষ্ট্রদূত হিসাবে আসন গ্রহণে আগ্রহী নয়।"
পশ্চিমা মিডিয়া তাদের পদে ফাটলের যে খবর প্রচার করে তালিবান নেতারা তা নাকচ করে দিয়েছেন।
ইসলামপন্থী শাসকরা দেশটিতে বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধ শেষ করার কৃতিত্ব দাবী করে। কিন্তু তারা ইসলামিক স্টেট গ্রুপের আফগান সহযোগী আইএসআইএস-কে-এর ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী হামলার মোকাবিলা করতে পারেনি। আইএসআইএস-কে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে তালিবান সদস্যদের, আফগান শিয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, রাশিয়ার এবং পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনগুলির পাশাপাশি দেশটির চীনা নাগরিকদের লক্ষ্য করে মারাত্মক কিছু বোমা হামলা চালিয়েছে।
বালখি তাদের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কর্মের সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি অন্য দেশের বিরুদ্ধে কাউকে আফগান মাটি ব্যবহার করতে না দেওয়ার জন্য তার সরকারের সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন।
তালিবানও একটি ছোট খাটো বিদ্রোহের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট বা এনআরএফ নামে পরিচিত একটি গোষ্ঠী উত্তর পাঞ্জশির প্রদেশের কিছু অংশ এবং আশেপাশের এলাকায় সক্রিয়। এনআরএফ বিদ্রোহী নেতৃত্ব প্রতিবেশী তাজিকিস্তানের ঘাঁটি থেকে কাজ করছে বলে মনে করা হয়, কিন্তু তারা কাবুল শাসনের জন্য খুব একটা হুমকি সৃষ্টি করতে পারেনি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সহিংসতা অব্যাহত রাখাকে নিরুৎসাহিত করেছে। তারা আশংকা প্রকাশ করেছে, এটি আরেকটি আফগান গৃহযুদ্ধের জন্ম দিতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত বর্ধিত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে।
নরওয়ের হুয়েটফোল্ট অসলোতে তার ১২ ডিসেম্বরের বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন, ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী আফগানিস্তানে "আরও বড় হুমকি" এবং এটি এখুনি নিয়ন্ত্রণ না করলে সময়ের সাথে সাথে তা আন্তর্জাতিক স্তরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তিনি বলেন, “আমাদের অবশ্যই খুব বেশি দূরে তাকাতে হবে না। ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, আফগানিস্তানকে ছেড়ে দেওয়া বোকামি হবে। দেশটি গৃহযুদ্ধে নামলে কিংবা সন্ত্রাসের ঘাঁটিতে পরিণত হলে কেউই নিরাপদ থাকবে না। এটা আফগান জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”