বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার শুরুতে রাখঢাক রেখে কথা বললেও, কয়েক মাস হলো প্রায় সবাই বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, জানুয়ারি নাগাদ সমস্যা কেটে যাবে। কিন্তু অর্থনীতিবিদেরা ভয়েস অফ আমেরিকার কাছে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ডলার সংকটের বিষয়টিকে সরকার ‘মৌসুমি সমস্যা’ হিসেবে অভিহিত করলেও এটি মূলত ‘কাঠামোগত সমস্যা’। জানুয়ারিতে ঠিক হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ সহায়তা আসলে কিছুটা স্বস্তি মিলবে।
করোনার প্রতিঘাত পেরিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ‘প্রধান’ কৌশল হিসেবে আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি দেশজ বাজারে পণ্য এবং গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়ার চেষ্টা চালায়। ঋণ পেতে যাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হলেও বাংলাদেশের অস্বস্তি বাড়াচ্ছে মেগাপ্রকল্পগুলো। সামনের কয়েক মাসে এই প্রকল্প বাবদ বহু ডলার খরচ হয়ে যাবে। ওদিকে রেমিট্যান্সও আগের মতো আসছে না। তাহলে উপায়?
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, সমস্যা সমাধানের জন্য রপ্তানির ক্ষেত্রে রূপান্তর দরকার।
তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘সরকার আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে সংকট মোকাবিলা করতে চাইলেও হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। এটা সামনে আরও মেলানো যাবে না। কারণ বিভিন্ন ধরনের মেগাপ্রকল্প চলছে। তার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানিতে ডলার প্রয়োজন। এগুলো অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পেলে কিছুটা স্বস্তি হয়তো আসবে। কিন্তু সমাধান হবে না। সমাধান করতে হলে রপ্তানির ক্ষেত্রে রূপান্তর দরকার। নতুন নতুন পণ্য দরকার। মধ্যমেয়াদী পদক্ষেপ দরকার।"
তিনি আরও বলেন, ‘‘পাশাপাশি আগামী দুই-তিন বছরে কীভাবে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো যায়, স্বল্প মেয়াদে সেটি ভাবতে হবে। বৈদেশিক হিসাবের ঘাটতি অর্থনীতির স্থিতিশীলতা যেন নষ্ট না করে দেয়, সেটি ঠেকা দেওয়ার কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে আইএমএফের লোন কিছুটা সাহায্য করবে। আইএমএফকে ব্যবহার করে অন্যান্য দেশ যেমন জাপান থেকে যদি বাজেট সমর্থন নিয়ে আসা যায় অথবা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে আনা যায়, তাহলে আমরা কিছুটা স্বস্তি পাব।’’
বাংলাদেশে রিজার্ভ ঠিক কত- তা নিয়ে এখন কিছুটা ধোঁয়াশা কেটেছে। আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে গত ৯ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার জানান, বাংলাদেশে এখন গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪ দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে আট বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে যা থাকবে, সেটাই নেট রিজার্ভ। সেই হিসাবে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার। এরপর ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য উদ্ধৃত করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়, ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভ কমে ২৫ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে।
এমন অবস্থায় ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা লেটার অফ ক্রেডিট (এলসি) খুলতে পারছেন না।আমদানি-নির্ভর নতুন কোনো ব্যবসা কেউ-ই হাতে নিচ্ছেন না। যেগুলো চলমান, সেগুলোর পরিধি কমিয়ে এনেছেন। এতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে।
ডলার সংকটের এমন দুর্দশার বিষয়ে গত ১৭ নভেম্বর ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, "জানুয়ারি মাসের মধ্যে এই সংকট কেটে যাবে।" প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও নভেম্বরের শেষদিকে এমন কথা বলেন।
সরকারের এ ধরনের তথ্যকে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি মনে করেন, ‘‘এই সংকট কোনো মৌসুমি বিষয় না। এটা কাঠামোগত বিষয়। ওনারা তিন মাস রোলিং প্লানের প্রজেকশন করেন। তিন মাস আগে সেপ্টেম্বরে বলেছিলেন নভেম্বরে কমে যাবে। অক্টোবরে এসে বলেছেন, ডিসেম্বর নাগাদ কেটে যাবে। এখন নভেম্বরে বলছেন, জানুয়ারি নাগাদ কেটে যাবে। এই ধরনের আশাবাদের কোনো ভিত্তি নেই। এটা সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত করে। আমি মনে করি নীতিপ্রণেতাদের কাছ থেকে তথ্যভিত্তিক বা বাস্তব সম্মত নয় এমন কথা আসলে ওনাদের নীতিই অকার্যকর হয়ে যাবে। বাজারে এতে আস্থার সৃষ্টি হয় না।’’
ডলার সংকটের দুটি অংশের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "একটি হলো বাংলাদেশ যে ডলার আয় করছে সেটা, আরেকটি যেটা ব্যয়ের পর সে আমদানি করছে। আয়ের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, নেট রপ্তানি পড়ে গেছে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স আয়ও ওঠানামা করছে। ডলার এবং টাকার বিনিময় হার একাধিক হওয়ায় এবং টাকা-ডলারের বিনিময় হার বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় অবধারিতভাবে হুন্ডি বাড়ছে। এতে সরকারের কোষাগারে সেভাবে অর্থ না আসায় জাতীয় মুদ্রাকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দিয়েছে।’’
‘‘এখানে কাঠামোগত বিন্যাস পরিবর্তনের একটা প্রয়োজন রয়ে গেছে। বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ এবং লভ্যতার বিষয়ে কোনো স্বচ্ছতা নেই। আস্থার অভাব রয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে একাধিক যারা খেলোয়াড় বা প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের ভেতরেও সম্পর্কের ক্ষেত্রে, নিয়মনীতির ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। বিশেষ করে তফসিলি ব্যাংকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পরিপালনের ব্যাপারটি রয়েছে, মানি এক্সচেঞ্জ যারা করেন, তাদের ব্যাপার রয়েছে। এর বাইরে যারা ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিদেশ থেকে টাকা আনেন, তাদের বিষয়টি রয়ে গেছে।’’
রিজার্ভ সংকটের জন্য করোনা এবং যুদ্ধের প্রভাব থাকলেও মোটাদাগে সরকারের আত্মতুষ্টিকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা আমাদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা একটা আত্মপ্রসাদে ভুগছিলাম…ফরেন রিজার্ভ অনেক আছে, এমন কিছু অসুবিধা নেই…। এই ভাবনায় আমাদের পেয়ে বসেছিল। এখন কিছুটা অবশ্য আসছে, তবে উল্লেখযোগ্য নয়। এখন সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর নির্ভর করলে হবে না। আমদানি-রপ্তানি যারা দেখভাল করেন, তাদের তদারকি বাড়াতে হবে। আগেও করার কথা ছিল, কিন্তু তারা করেননি।’’
মেগা প্রজেক্টগুলোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "যেগুলো প্রায় শেষের পথে, কিংবা খুব দরকারি সেগুলো চালু রেখে অপ্রয়োজনীয় প্রজেক্টের গতি কমিয়ে দিতে হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কম পড়বে।’’
‘‘অর্থপাচার কিংবা বৈদেশিক মুদ্রাপাচারের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে তথ্য দিতে পারে। কিন্তু মূল অ্যাকশন নিতে হবে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে। সর্বোপরি বাইরে অর্থপাচারের ব্যাপারে যাদের নাম শোনা গেছে, তাদের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। ভবিষ্যতে যেন এসব না হয়, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা বিশেষ করে দুদক-সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। না হলে অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলা করা কঠিন হবে।’’
রিজার্ভ সংকটের এই দুর্দশার জন্য গত ১০ বছরের অর্থপাচারকে দায়ী করছেন উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, ‘‘গত দশ বছরে দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ পাচার হয়েছে। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের ডিপোজিট বেড়েছে। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম ইনভেস্টমেন্টেও বাংলাদেশ শীর্ষ দেশগুলোর একটি। কানাডার বেগমপাড়ায় বিনিয়োগের কথা তো সবারই জানা। এই জিনিসগুলো দেখলে বোঝা যায়, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণে যে অর্থ পাচার হয়েছে তার প্রভাব পড়েছে রিজার্ভে।’’
‘‘বৈদেশিক অর্থ আয়ে গার্মেন্টস সেক্টর আমাদের অন্যতম প্রধান উৎস। মালিকেরা রপ্তানি করে যতটুকু ডলার আয় করছেন, তার বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার করছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে দুদক একটি অভিযোগের অনুসন্ধানে নামে। তখন জানা যায়, ওভার-ইনভয়েসের (বেশি দাম দেখানো) মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বছরে ৬৪ হাজার কোটি পাচার হয়। এসবের ওপরে আসলে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কারণ গার্মেন্টস মালিকদের একটা অংশ সরকারের খুবই ঘনিষ্ঠ। ওদিকে কভিডের পর প্রবাসী শ্রমিকেরাও সেভাবে অর্থ পাঠাচ্ছেন না বা পাঠাতে পারছেন না।’’
ডলার সংকট কবে কাটবে সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না মন্তব্য করে মাহা মির্জা বলেন, ‘‘আমাদের হাতে হাজার-হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। ২০২৪ সাল থেকে আবার স্বল্প মেয়াদি ঋণগুলো শোধ করতে হবে। তার মানে বড় অংকের ডলার সেখান থেকে বেরিয়ে যাবে। বাছবিচার ছাড়া যেভাবে প্রকল্পগুলো অনুমোদন হয়েছে, তাতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সামাল দেওয়ার কোনো উপায় এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। আমার ধারণ আমরা জাতীয় সংকটের দিকে যাচ্ছি।’’