গত ১৪ আগষ্ট নাটোরের বলারিপাড়া এলাকার ভাড়া বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় কলেজ-শিক্ষিকা খায়রুন নাহারের (৪১) মরদেহ। নিহত শিক্ষিকার স্বামী মামুন হোসেন (২৩) দাবী করেছেন তার স্ত্রী সিলিং ফ্যানে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ ঘটনার পর স্বামী মামুন হোসেনকে পুলিশ আটক করে থানায় নিয়ে যায়। নিহত খায়রুন নাহার নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার একটি কলেজের দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। তার স্বামী মামুন হোসেন ডিগ্রী দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ আগষ্ট ২০২২)
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর মামুন ও খায়রুন দম্পতি বিয়ে করেন। গত জুলাই মাসের শেষের দিকে তাদের বিয়ের খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে। সমালোচনা শুরু হয় তার এলাকাতেও। বিভিন্ন গণমাধ্যম চটকদার শিরোনামে এই বিয়ের খবর প্রকাশ করতে থাকে, যেমন- ‘ভালবেসে কলেজ ছাত্রকে বিয়ে করলেন শিক্ষিকা’, ‘৬ মাস প্রেম করে শিক্ষিকাকে বিয়ে করলেন কলেজছাত্র’, ‘শিক্ষিকাকে ছাত্রের বিয়ে’ ইত্যাদি । ব্যাপক সমালোচনা, নিন্দা, পরিবারের অসহযোগিতার মধ্যেও খায়রুন নাহার গণমাধ্যমের কাছে দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, "যারা আমাদের বিয়েটাকে নেগেটিভলি নিচ্ছে, তাদের ধারণা একদিন পাল্টাবে, পাল্টে দিতেই হবে আমাকে।" নেতিবাচক মন্তব্য সম্পর্কে মামুনও আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন, "মন্তব্য কখনও গন্তব্য ঠেকাতে পারে না।" অথচ এর অল্পকিছুদিনের ব্যবধানে শিক্ষিকার বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার হয়। গণমাধ্যমে আবারও শিরোনাম হন তিনি, ‘কলেজ ছাত্রকে বিয়ে করা সেই শিক্ষিকা’ নামে।
ইদানিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে সাইবার বুলিং এবং যার সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন নারী। অনলাইনে প্রকাশিত নিউজের কমেন্ট সেকশনে আমরা প্রচুর নোংরা কমেন্ট দেখি, অনেকসময় সেগুলো প্রকাশযোগ্য হয় না। নারীদের আমরা বিভিন্ন পাবলিক গ্রুপসহ অনেক জায়গাতেই বুলিং, ট্রলিং এর শিকার হতে দেখি। ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর মন্তব্য, ইনবক্সে আপত্তিকর ম্যাসেজ, ছবি পাঠানো, বিভিন্ন মিম, ট্রল বানিয়ে সামাজিকভাবে হয়রানি করার পরিমাণ মারাত্মক হারে বেড়েছে। এ থেকে বাড়ছে হতাশা, নিরাপত্তাহীনতা। অনেকে আত্মহত্যাও করছেন। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ (১) (ক) ধারায় এ ধরনের কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমবার অভিযুক্তকে তিন বছর জেল ও ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে। তবে নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণের প্রকাশ বেড়েছে। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরেই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও আক্রমন প্রকট হচ্ছে। সামাজিক ক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে, চাকরিক্ষেত্রে নারীকে চিরাচরিত বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। নারী যত বেশি অগ্রগামী হচ্ছে ততবেশি তার প্রতি সমাজের বাধা প্রকট হচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন, সমাজের পুররুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন, লিঙ্গসমতা আনয়নে করণীয় কী, নাটোরের শিক্ষিকার বিয়ে-মৃত্যুর খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা, সাইবার বুলিং ইত্যাদি নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছে নারীবাদ ও নারীউন্নয়ন নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে।
ড. কাবেরী গায়েন
অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নারী হচ্ছে পুরুষের সমপর্যায়ের মানুষ এবং তার প্রতি যা করা হচ্ছে সেটা অন্যায় করা হচ্ছে সেটা প্রথমেই আমাদের সমাজকে অ্যাক্সেপ্ট করতে হবে । এই কথাটি যদি তাদেরকে বোঝোনো যায় তাহলেই কেবল অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। এখনও সরকারি চাকরিতে মাত্র ১০% নারী। কিন্তু পুরুষের ধারণা মেয়েরাই সব জায়গায় সুবিধা পাচ্ছে। মেয়েদের তো চাকরি হবেই- এ ধরণের মন্তব্য করার সময় এটা চিন্তা করে না যে হাজার বছর ধরে মেয়েদেরকে কাজ করতে দেয়াই হয়নি। মেয়েরা রাতের বেলা চলাফেরা করছে, চাকরি-বাকরি করছে এটা মেনে নিতে পারে না কারণ তাদের মানস গঠনে এ বিষয়গুলো নেই। ফলে তারই একটা প্রক্রিয়া আমরা সমাজে দেখি। যেহেতু দেখছে নারী হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে ফলে তাকে আরো বেশি স্টিগমাটাইজ করা, আরো বেশি শারীরিক, মানসিক নানা ধরণের আক্রমণ করা হচ্ছে।
একজন কলেজ শিক্ষক, তিনি একটি ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন। এটি তার ব্যক্তিগত চয়েসের ব্যাপার ছিলো। অথচ কীভাবে ট্রল করা হয়েছে! আমাদের গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা যদি বলি, একজন নারী ও পুরুষ বিয়ে করেছে, এটা তো কোনো নিউজ হতে পারে না। বাংলাদেশে হাজার হাজার নারী-পুরুষের বিয়ে হচ্ছে। যে নারী বিয়ে করেছিলেন তিনি কোনো সেলিব্রেটিও নয় যে তাকে নিয়ে নিউজ করতে হবে। কিন্তু গণমাধ্যমে নিউজ হওয়ার কারণ বাইশ বছরের ছাত্রকে বিয়ে করেছেন চল্লিশ বছরের শিক্ষিকা। আমার জানামতে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক পুরুষ শিক্ষক শিক্ষার্থীকে বিয়ে করেছেন। তারমধ্যে শিক্ষক তার সরাসরি ছাত্রীকে বিয়ে করেছেন এমন উদাহরণও অনেক আছে এবং অনেক বয়স্ক পুরুষ অনেক কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে করছে, সেখানে কোনো নৈতিকতার প্রশ্ন আসে না। আর নারী যখন তারচেয়ে এক বছরেরও বেশি বয়সের কোনো ব্যক্তিকে বিয়ে করে তখন তা একটা ঘোরতর ব্যাপার হয়ে যায়। এই মানসিকতা সাধারণ মানুষের না হয় থাকতে পারে, কিন্তু গণমাধ্যম কি এই কাজটি করতে পারে? যেসব গণমাধ্যমে এই নিউজটি ছাপা হয়েছিলো আমি তাদেরকে খুনি মনে করি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ ভুলে যায় যে সে অন্যের জীবন নিয়ে কতটুকু চর্চা করতে পারবে। এমনভাবে ট্রল করা হয়েছে, যদি সেই নারী শিক্ষক আত্মহত্যা করে থাকেন তাহলে সেটা হচ্ছে সমাজের কাঠামোগত আত্মহত্যা। সমাজ তাকে বাঁচতে দেয়নি অথবা তাকে হত্যা করা হয়েছে। যেটাই ঘটুক না কেনো তার তো বাঁচার অধিকার ছিলো। সমাজ তার কুৎসিত মানসিকতা দিয়ে সেই শিক্ষকের জীবনটাকে স্বাভাবিক থাকতে দেয়নি। বিয়ের ক্ষেত্রে নারীকে কেনো পুরুষের চেয়ে অল্পবয়সী হতে হবে? কারণ নারীটি যদি পুরুষের চাইতে বয়সে অনেক ছোট হয়, পুরুষ তার প্রতি নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম করতে পারবে। নারীকে তার ইচ্ছা অনুযায়ী চালিত করতে পারবে। তাই যখনই একজন নারী পদমর্যাদায় সমান হয়ে যায় বা বড় হয়ে যায় তখন তাদের মধ্যে একটা ভীতি তৈরি হয়। তবে শুধু পুরুষ নয়, পুরুষতন্ত্রের অন্তর্গত যেসব নারীরা আছেন, তারাও একই ভাবনা ও আদর্শ দ্বারাই পরিচালিত। তারাও 'হায় হায়' রব তুলেছেন, সেই নারীকে সমাজের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু আমাদের গণমাধ্যমে কিংবা আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তো এটা হওয়ার কথা নয়। গণমাধ্যমে বলা আছে, কোনো মানুষের ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে কথা বলা যাবে না। তাহলে দুইজন নারী ও পুরুষ বিয়ে করেছে, এটা কীভাবে নিউজ আইটেম হয়? আমি প্রশ্ন করতে চাই একজন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। আমি প্রশ্ন করতে চাই, সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি নারী পুরুষ প্রতিদিন বিয়ে করছে, একটা বিয়ের ঘটনা কেনো সংবাদ হবে? এই নিউজ করাই হয়েছে ওই নারীকে হেয় করবার জন্য। এই ঘটনার অসাম্ভব্যতা বোঝানোর জন্য। পৃথিবীতে কি ব্যতিক্রম নেই? আমি মনে করি নারী শিক্ষিকা আত্মহত্যা করুন কিংবা হত্যাই হোন, সমাজ তাকে মেরে ফেলেছে। যদি আত্মহত্যা করে থাকেন, আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে। এ ধরণের বিয়ের উদাহরণ যে আমাদের সমাজে একেবারেই নেই তা তো না। আমি মনে করি তার এই মৃত্যুর ঘটনা থেকে নারীদের এখন প্রতিবাদী হওয়া উচিত। সমাজের এসব আচরণের জবাবদিহিতা দরকার। যারা ওই নারীকে নিয়ে ট্রল করেছেন তাদের আইডি খুঁজে বের করে বিচারিক ব্যবস্থার আওতায় আনা দরকার বলে আমি মনে করি। আমাদের যে সাইবার ক্রাইম ইউনিট রয়েছে, সেখানে খুব স্ট্রং আইন আছে। সেই আইন অনুযায়ী ইঙ্গিতে, কথায় বা কোনোভাবে যদি কাউকে অনলাইনে হয়রানি করা হয় সেটাকে বিচারের আওতায় আনা হবে।
যে কোনো সোসাইটিতে যখন একটা নতুন টেকনোলজি আসে, তার সাথেসাথে সেটার শিক্ষাটা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের কোনো লিটারেসি নাই, আমরা কী বলতে পারবো আর কী বলতে পারবো না, আমাদের সেই আইনকানুন নেই। আর যদি বা আইন থেকেও থাকে সেই আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। প্রয়োগ হয় শুধুমাত্র কেউ যদি কোনো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব (যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন) নিয়ে কিছু সামাজিক মাধ্যমে কিংবা গণমাধ্যমে লেখে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এসব ঘটনার কোনো ধরণের নজরদারীও করা হয় না। ফলে এটি খুব দুঃখজনক। আমি মনে করি যারা এই ধরণের ট্রল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করেছেন তাদের আইডিগুলো আইডিনটিফাই করে তাদেরকে কোন না কোন জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হোক এবং এই মর্মে আইন প্রণয়ন করা হোক যে, যদি কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ট্রল করা হয় সেক্ষেত্রে শাস্তির বিধান রাখতে হবে। যদি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এধরণের কর্মকান্ডের জন্য ব্যক্তিকে শাস্তির আওতায় আনা হয় তাহলে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যারা এরকম ঠাট্টা মশকরা এবং নোংরামি করছে তাদেরকে কেনো আইনের আওতায় আনা হবে না? এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের নিয়মকানুন বারবার প্রচার করতে হবে, যাতে মানুষ এ ধরণের কোন কাজ করার আগে দুইবার ভাবে। আরেকটি বিষয় হলো গণমাধ্যম হয়তো সরাসরি অসংবেদনশীল বাক্য ব্যবহার করে না। কিন্তু তাদের নিউজের নিচে মন্তব্যের ঘরে যেসব কথাগুলো বলা হয় সেগুলোও কিন্তু গণমাধ্যমেরই একটি পার্ট। কাজেই এ ধরণের মন্তব্য মনিটরিং করতে হবে এবং বন্ধ করতে হবে। এ ধরণের মন্তব্য প্রচার করা যাবে না। গণমাধ্যমকেও দায়িত্বশীল হতে হবে, সামাজিক মাধ্যম যারা ব্যবহার করছেন তাদেরকেও দায়িত্বশীল হতে হবে। সেই মর্মে যা করা দরকার, রাষ্ট্র সেই ব্যবস্থা নেবে। সাথে সাথে বিভিন্ন অ্যাকটিভিস্টদেরও কাজ করতে হবে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ, সাংস্কৃতিক কর্মী সবাইকেই এ ধরণের হয়রানির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
আমাদের মানসিক পরিবর্তনের জন্য প্রথমেই কালচারাল পরিবর্তন প্রয়োজন। আর কালচারাল পরিবর্তন কখনো একদিনে করা যাবে না। এটার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া আছে এবং প্রক্রিয়াটির জন্য একটা প্রতিজ্ঞার প্রয়োজন। নারী আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে চলছে এবং এসমস্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনাও চলছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি তার কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। সমাজের মানসিকতা পাল্টানো খুব সহজ কাজ নয়। এর জন্য কতগুলো বিষয় দরকার হয়। যেমন-পরিবারে সে কী শেখে, স্কুলে তাকে কী শেখানো হয়, টেক্সবোর্ডের যে বইগুলো আছে, সেখানে মেয়েদেরকে সম্মান করার জন্য, ইকুয়াল নাগরিক মনে করবার জন্য যথেষ্টভাবে শেখানো হয় কি না। তারপর দেখতে হবে গণমাধ্যমে নারীকে কিভাবে উত্থাপন করা হয়। এবং সর্বোপরি নাটক, সিনেমা, সাহিত্য, দর্শন, আইন সব জায়গায় নারীকে আসলে কী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়। এসব থেকেই আমাদের মানস গঠন হয়। এখন যদি দেখা যায় যে, স্কুল টেক্সট বইতে ‘থাকবো না কো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে’-কবিতায় পাশে থাকে একটি ছেলের ছবি। আবার সেবামূলক যে কোন কন্টেন্টের পাশে থাকে একটা মেয়ের ছবি, এভাবে বিভাজন তৈরি করা হয়। বুঝিয়ে দেয়া হয় যে নারীরা ঘরের ভেতরেই থাকবেন এবং নারী থাকবে অধস্তন। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে যদি আমরা সত্যি পাল্টাতে চাই তাহলে সমাজের, রাষ্ট্রের, রাজনৈতিক পরিসরের সমস্ত জায়গায় আমূল পরিবর্তন দরকার। পরিবর্তনের মাধ্যমে নারীকে সমমর্যাদার নাগরিক হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। হাজার বছর ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী পুরুষের বশ্যতা স্বীকার করবে, এটাই চলে আসছে। কিন্তু এত প্রতিরোধের মধ্যেও নারী কিন্তু আবার এগিয়েও যাচ্ছে। গত পঞ্চাশ বছরে নারীর অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু পুরুষের মানসিকতার অগ্রগতি সেই অনুযায়ী হয়নি। ফলে আমি মনে করি, পুরুষ এই মুহুর্তে মনে করছে তার দুর্গের পতন শুরু হয়েছে নারীশিক্ষার জন্য, নারীর বাইরে যাওয়ার জন্য, নারীর চাকরির জন্য। ফলে কোনো একটা মেয়েকে ভালো করতে দেখলে পুরুষরা ভয় পায় এবং সে বুঝতে পারছে নারীর ওপর তার যে নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিলো, সে জায়গায় নারী আর নেই। তাই এ জাতীয় অপরাধগুলো ক্রমাগত করে যাচ্ছে। সেখান থেকে যদি উত্তরণ ঘটাতে হয় তাহলে আমাদের মানস গঠনের একেবারে শুরুতে- পরিবারে, স্কুলের টেক্সটবইতে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে, গণমাধ্যমে নারীর প্রতি সম্মানজনক যে দৃষ্টিভঙ্গি, সমনাগরিকের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা স্ট্যাবলিশ করতে হবে। সেই কাজটাও এখন পর্যন্ত শুরুই হয়নি। নারী চাকরিবাকরি করছে কিন্তু তার মর্যাদার জায়গাটি, দর্শনগত জায়গাটি এ্রখন পর্যন্ত সমন্বয় করা হয়নি। এটি সমন্বয় করতে হলে ইমিডিয়েট কাজ হচ্ছে, আইন প্রণয়ন করা। যারা নারীর বিরুদ্ধে অবমাননাকর বক্তব্য রাখে, নির্যাতন করে তাদের যেনো তাৎক্ষনিক সঠিক বিচার হয়। সর্বোপরি যে কাজটি করতে হবে, সেটা হলো সাংস্কৃতিক পরিবর্তন করা দরকার। সেই সাংস্কৃতিক পরিবর্তন শিক্ষার মাধ্যমে আসবে। সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে এ সমস্ত বিষয়ের মধ্যেই এই দৃষ্টিভঙ্গিটাকে নিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে পারিবারিক শিক্ষারও কোনো বিকল্প নাই। সন্তানকে সুশিক্ষিত করার জন্য বাবা-মায়ের শিক্ষা আগে প্রয়োজন। যে বাবা সন্তানের সামনে তার মাকে ছোট করে তার ছেলেটাও মেয়েদেরকে ছোট করতেই শিখবে।
সুপ্রীতি ধর
সাংবাদিক, প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক-উইমেন চ্যাপ্টার
আসলে সাইবার বুলিং শুধু বাংলাদেশের সমস্যা না। এটা একটা বিশ্বব্যাপী সমস্যা। সারা বিশ্বেই বুলিং হচ্ছে, ট্রল হচ্ছে।
বাংলাদেশে যেহেতু জনসংখ্যার আধিক্য আছে, ফেসবুকের ব্যবহারও এখানে বেশি হয়। অন্যান্য দেশের তুলনায়
এখানে ইন্টারনেটও সস্তা। এ কারণে ইন্টারনেট ব্যবহারের যে লিটারেসি তা জেনে এবং না জেনেও ইন্টারনেটের ব্যবহার অনেক বেশি হচ্ছে। একজন বিবেচক মানুষ যখন একটা কাজ করবে, জনসমক্ষে একটা কথা বলবে চিন্তাভাবনা করে বলবে। কিন্তু অনলাইন জগতটা এমন হয়ে গেছে, যে কেউ একটা কিছু হুট করে বলে ফেলছে। নারীবিদ্বেষ সবসময়ই ছিলো। আমরা যদি আদি ইতিহাস থেকে চিন্তা করি, সমাজে সবসময়ই নারী বিদ্বেষ ছিলো। যে নারীই একটু মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে বা কোনভাবে একটু আলোচনায় এসেছে সে নারীর প্রতি একটা বিদ্বেষ সবসময়ই কাজ করেছে। কিন্তু এখন যেহেতু নারী বেশি দৃশ্যমান, নারীরা এখন কথা বলছে, লিখছে সেজন্য বিদ্বেষটাও বাড়ছে। একটা শ্রেণী তৈরি হয়েছে যারা নারীর প্রতি বিদ্বেষটাকেই স্মার্টনেস ভাবছে। এটা একটি ট্রেন্ড চলছে। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে আমাদের দেশে বা বিশ্বে আত্মহত্যার পরিমাণ কিন্তু কম না। তবে শুধু নারী না, পুরুষরাও বুলিংয়ের শিকার হয়। তারাও আত্মহত্যা করে। এটা আমরা আজকে নয়, অনেক আগে থেকেই দেখছি। বরঞ্চ এখন সেটা কমে যাওয়ার কথা। এখন আমরাও বুলিং, ট্রলিংকে ইগনোর করতে শিখে গেছি। কিন্তু হয় কি, যে মানুষটার কাছে এসব কিছু নতুন, যে মানুষটা নতুন লিখছে, নতুন সামনে আসছে, সে কিন্তু এইসব বুলিংয়ের সাথে পরিচিত না। তখন তার এক ধরণের মনস্তাত্বিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হয়। কেউ নিতে পারে, কেউ নিতে পারে না। যেমন আমি একটি উদাহরণ দেই। নতুন কোন লেখক আসলে আমি যখন তার লেখাটি উইমেন চ্যাপ্টার পেজে সেটা শেয়ার করি, আমি লেখককে বলে দেই, তুমি পেজে যেও না। কারণ লেখাটি ভাল হোক কিংবা খারাপ হোক এবং যে বিষয়ের উপরেই হোক লেখাটির কিছু নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া আসবে, সেটা সেই নতুন লেখক সহ্য করতে পারবেন না। উইমেন চ্যাপ্টারের অনেক লেখক এখন আর লেখেন না শুধুমাত্র এ ধরণের আচরণের কারণে। আমি যেটা খেয়াল করেছি, এটা খুব সংঘবদ্ধভাবেই করা হয়। মানে আমরা নারীরা যত প্রকাশ্যে এসেছি, যত কথা বলেছি, যত লেখা লিখেছি আমাদেরকে দমানোর জন্য হেন প্রক্রিয়া নাই যেটা ঘটানো হয় নাই। বাজে কথা বলা, হত্যার হুমকি দেয়াসহ সবই করা হয়েছে। পাবলিকলি একটা মেয়ে যখন নানারকম ট্রলিং, বুলিংয়ের শিকার হয় তখন তো পুরো পরিবার এটার সাথে ইনভলভ হয়ে যায়। তখন এটা সহ্য করাটা খুব কঠিন হয়। এখানে সামাজিক শিক্ষার একটি ব্যাপারও আছে। আমরা হাতে তুলে দিয়েছি মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট সহজলভ্য করে দিয়েছি কিন্তু জাতিকে শিক্ষিত করতে পারিনি। আমাদের পুরো সিস্টেমেই যখন ধস নেমেছে, কেউ কাউকে মানছে না, সম্মান করছে না তখন এর প্রতিফলন তো হবেই, অনলাইন জগৎ তো সিস্টেমের বাইরে না।
নাটোরের গুরুদাসপুরের শিক্ষিকার বিয়ের নিউজ নিয়ে গণমাধ্যমের ভুমিকার কথা যদি বলি, গণমাধ্যমে কি এটা কোনো নিউজ হওয়ার মতো বিষয় ছিলো? চল্লিশ বছরের একজন শিক্ষিকা বাইশ বছরের একজন ছাত্রকে বিয়ে করেছে, তো কী হয়েছে? সে তো তারকাও না, খুবই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন নারী। তারকাদের বিয়ে, ডিভোর্স সন্তান হওয়া এগুলো নিয়ে নিউজ হতে পারে বিনোদন পাতার জন্য। কিন্তু এটা তো কোনো নিউজ না, স্বাভাবিক একটা ঘটনা। গণমাধ্যমে যখন এধরণের বিষয় নিয়ে চর্চা হয় তার প্রভাব সেই আলোচিত ব্যক্তির এলাকাতেও পড়ে। শিক্ষিকা যেহেতু মফেস্বল এলাকায় থাকতেন, গণমাধ্যমে তার বিয়ের খবর উঠে আসা তাকে অনেক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে থাকতে পারে।
আমরা এখনও জানি না যে, শিক্ষিকা আত্মহত্যা করেছেন নাকি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আত্মহত্যা করলেও তো তাকে প্ররোচিত করা হয়েছে। আত্মহত্যার পেছনেও কারণ থাকে, প্ররোচনা থাকে। এমনিতেও সে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছিলো। তাকে নিয়ে যে পরিমান কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়েছে তার তো একটা প্রভাব রয়েছে। একটা নিউজে পড়েছিলাম তার বাড়ি থেকে কেউ যোগাযোগ করতো না, তারা কেউ মেনে নেয়নি। মেনে নেবে না সেটা হয়তো ওই নারীর জানার কথা ছিলো, কারণ আমাদের সমাজে মেনে নেয় না। কিন্তু মেনে না নেয়া আর কথা শোনানো এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রতিনিয়ত যদি তাকে তার কাজের জন্য সামাজিকভাবে, পারিবারিকভাবে কথা শুনতে হয়, গালাগাল শুনতে হয় সেটাও আত্মহত্যার একটা কারণ হতে পারে। এছাড়াও পারিপার্শ্বিক আরো কারণ এখানে থাকতে পারে। সমাজে এ ধরণের দুঃখজনক ঘটনা যেনো আর না ঘটে, তার জন্য আমাদের অনেক কিছু করার আছে।
শারমিন শামস্
সম্পাদক, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কারণে কিছু মানুষ সবসময় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। যখনই নারীর সমান অধিকারের কথা বলবেন, তখনই কিছু মানুষের সেই সুবিধার জায়গা, সেই সুপিরিয়র জায়গাটি ভেঙ্গে পড়বে। তখন তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে, বিদ্বেষমূলক মানসিকতা প্রকাশ পেয়ে যায়। সোসাইটির মানুষগুলো নারীর অস্তিত্বটাকেই অস্বীকার করে। নারী একটা ঊনমানুষ আসলে।
কলেজ শিক্ষিকাকে নিয়ে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর বিষয়টিতে সোশ্যাল মিডিয়া এবং গণমাধ্যম দুটোরই একটি বিশাল বড় নেগেটিভ ভূমিকা রয়েছে আমি বলব। গণমাধ্যমের শিরোনামগুলো দেখেন, তারা লিখছে ‘কলেজ ছাত্রকে বিয়ে করা সেই শিক্ষিকার আত্মহত্যা।’ কতটা অশ্লীল, নোংরা, জাজমেন্টাল একটি শিরোনাম। শিরোনামটি আরো সংবেদনশীল হতে পারতো। অনেকভাবেই খবরের শিরোনামটি হতে পারতো। যখন কোনো অপরাধীকে (পুরুষ) নিয়ে নিউজ করা হয় তখন সেই অপরাধীর অপরাধের দিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। কিন্তু কোনো অপরাধী কিংবা কোনো ভিকটিমও যদি নারী হয়, তাহলে প্রথমেই সেই নারীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে তার যৌন জীবন সংক্রান্ত যত ধরনের তথ্য দেয়া সম্ভব তা মেইন স্ট্রিম মিডিয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের মিডিয়া প্রচার করতে শুরু করে। এটা পুরোপুরি গণমাধ্যমের পলিসির ব্যাপার যে আমি একটা ঘটনাকে কিভাবে দেখব, কিভাবে প্রকাশ করব। জেন্ডার ইস্যুতে আমাদের গণমাধ্যমেরও একটা আপডেট দরকার। এ ধরনের দায় গণমাধ্যম এড়াতে পারে না। আমি বলব শিক্ষিকা খায়রুনের ঘটনায় গণমাধ্যম রীতিমতো অপরাধ করেছে।
সিমন দ্য বোভোয়ার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “নারীরা যত বেশি আত্ম সচেতন হয়ে উঠবে পুরুষরা তত বেশি হিংস্র হয়ে উঠবে।” আগে মেয়েদেরকে যখন খারাপ কথা বলা হতো, গালাগাল করা হতো তখন মেয়েরা ভীত হয়ে যেত। এখন মেয়েদের কেউ খারাপ কথা বললে তারা রুখে দাঁড়ায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গালাগাল করলে রুখে দাঁড়ায় অথবা টোটালি ইগনোর করে। মোটকথা যে কোনভাবেই হোক মেয়েরা এটা প্রতিরোধ করে। এখন সবাই বুঝে গেছে যে একটা শ্রেণী আছে যারা মেয়েদের ক্রমাগত আক্রমণ করবে তাই মেয়েরাও এ ব্যাপারটায় সচেতন হয়ে গেছে। এটা একটা খুব ভালো স্ট্র্যাটেজি। আমরা যারা সরব, নারীর অধিকার নিয়ে লিখি তারা প্রতিমুহূর্তেই ট্রলের শিকার হচ্ছি। আমার মেসেজ বক্স ভর্তি নানারকম হুমকিতে। এর প্রতিকার চাইবো কার কাছে? তাদের মেয়েদের জন্য অনেক আইনের কথা বলা হয় কিন্তু এত দীর্ঘ মেয়াদী, এত ঝামেলাপূর্ণ, অদ্ভুত সব প্রক্রিয়া যে আসলে আগ্রহ হারিয়ে যায়। হ্যাঁ, আমাদের সাইবার ক্রাইম ইউনিট আছে কিন্তু সেখানে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। আমার সাথে অনেক মেয়ে যোগাযোগ করে, অনেক বড় বড় ঘটনার কথা শেয়ার করে। তারা এসব বিচারিক জায়গাগুলোতে যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না? তারমানে আইনটা মেয়েদের কাছে পৌঁছতে পারছে না। বা আইনের যে বিচারটা সেটা এখনো কঠিন। মেয়েরা আইন থাকলেও সেটার দ্বারস্থ হয় না। পত্রিকার নিউজের নিচে যারা বাজে কমেন্ট করে তাদেরকে তো সাইবার ক্রাইম ইউনিট সহজেই ধরতে পারে। সাইবার ক্রাইম অথরিটি যদি ঢালাওভাবে কয়েকজন কে ধরতে থাকতো, যদি একশ জনকেও ধরতো তাহলে তো আমরা একটা উদাহরণ চোখের সামনে দেখতাম। কিছু মানুষ সতর্ক হতো। কার আইডি, কারা কোত্থেকে এ কাজগুলো করছে এগুলো তো সাইবার ক্রাইম ইউনিটের জন্য বের করার কোন ব্যাপারই না । সেই সক্ষমতা এই ইউনিটের আছে। আসলে একটা সভ্য রাষ্ট্রে কোন অন্যায়ের বিচার অটোমেটিক্যালি হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদেরকে সেই বিচার চেয়েও লিখতে হয়, মানববন্ধন করতে হয়।
একটা ছেলে বা একটা মেয়ের সামাজিক শিক্ষা তার পরিবার থেকেই শুরু হয়। কিছুটা সে শিখে প্রতিষ্ঠান থেকে, স্কুল কলেজ, বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্য পরিবেশ থেকে। কিন্তু বাবা-মা যদি তার বেসিকটা গড়ে দেয়, তাহলে বাইরে যদি সে অন্য কিছু দেখে সেটা সে তার শিক্ষা দ্বারা যাচাই করে নিতে পারে। পরিবারে যদি পারস্পরিক সম্মানের শিক্ষা থাকে, বাবা-মাকে সম্মান করে, বাড়িতে যদি কাজগুলো সমানভাবে বাবা ও মাকে ভাগ করে নিতে দেখে তাহলে ছেলেমেয়ের মধ্যে জেন্ডার সেনসিটিভ বিষয়গুলো এবং সমঅধিকারের বিষয়গুলো আসবে। মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া নারীর প্রতি বিদ্বেষ কমবে না এবং মানসিকতার পরিবর্তন শুধু মুখে মুখে হবে না এর জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপ নেয়ার আছে। সবার আগে আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের জেন্ডার ইনসেনসিটিভ যে মানসিকতা সেটাকে আনলার্ন করা, একদম ছোট বয়সেই সেটা শেখানো। তাকে মানুষের মধ্যে সমতা শেখাতে হবে এবং জেন্ডার এডুকেশন দিতে হবে। এটা আমাদের শিক্ষা প্রণেতাদের খুব সিরিয়াসলি নিতে হবে। এছাড়া একটি বড় ধরণের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার এবং এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অনেক বড় একটি ভূমিকা রয়েছে। যারা প্রগতিশীল চিন্তা করেন, যারা সমতার কথা ভাবেন বা আসলেই যারা নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাসী সেরকম মানুষদেরকে সামনে রেখে একধরণের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা এবং প্রত্যেকটি স্তরেই আন্দোলনটিকে নিয়ে যাওয়া, এ দুটোই আমার কাছে এখন মনে হচ্ছে বেশি জরুরী। এর ভেতর দিয়ে আরো অনেক ধরণের স্টেপ নেয়ার আছে। ব্যাসিকালি আমাদের মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য এগুলো করতে হবে।
কিযী তাহ্নিন
কথাসাহিত্যিক এবং উন্নয়নকর্মী
নারীর প্রতি বিদ্বেষ বা সামাজিক আক্রমণের একটা বড় কারণ ছোটবেলা থেকেই আমরা আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, আমাদের সংস্কৃতি সাহিত্য চলচ্চিত্রে নারীকে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে দেখতে ভালোবাসে। সে সৌন্দর্যগুলো হলো চাঁদের মতো মুখ, ফর্সা রং, শারীরিক সৌন্দর্য। কিন্তু তার মেধা, অন্যান্য গুণাবলী ও মানবিক বৈশিষ্ট্যকে ছোট করে দেখা হয়। যদিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা বেশি দেখছি কিন্তু এই বুলিং আগেও ছিল, ইভটিজিং নামে ছিল। নারীকে একটা অবজেক্ট হিসেবে দেখার ব্যাপারটা সবসময়ই ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপারটা এখন অনেক বেশি চলে এসেছে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সঠিক সেক্স এডুকেশন দেয়া হয় না। নারীকে সবসময় একটা ধোঁয়াশার জায়গায় রাখা হয়, ভোগের বস্তু হিসেবে দেখা হয়। অনেক প্রাচীন সময় থেকেই এটা চলে এসেছে। খনার জিভ কেটে দেয়া হয়েছিল কেন? কারণ সে কথা বলতো। সত্যি কথাগুলো তার মুখ দিয়ে ভবিষ্যতবাণী রূপে বের হতো। এই উপমহাদেশে যখনই মেয়েরা প্রথার বাইরে গিয়েছে তখনই অনার কিলিং হয়েছে। এই যে আমাদের মনস্তত্ত্বে আছে, নারী থাকবে পেছনে, হবে কম ক্ষমতাশালী এবং নারী কথা বলবে না। সেটারই প্রতিফলন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পড়ছে। এখন মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া মনস্ত্বাত্বিক জায়গা থেকে নিতে পারছে না। সেই ক্ষোভ, বিদ্বেষ থেকে নেগেটিভ কমেন্ট, বুলিং করা, ট্রল করা। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এটা শুধু পুরুষদের কাছ থেকে না নারীদের কাছ থেকেও আসে। শুধু নারী না পুরুষরাও ট্রলের শিকার হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমন একটা অদ্ভুত প্ল্যাটফর্ম সেখানে ব্যক্তির যদি কাউকে ভালো না লাগে একটা কমেন্ট করে তাকে ছোট করতে পারছে। এখন ছোট হবেন কি হবেন না সেটা আপনাকে ঠিক করতে হবে।
আমরা আমাদের জীবনটাকে গত ১০ বছরে এমন একটা ছাঁচে ফেলেছি যে প্রাইভেসি শব্দটা এখন সবচেয়ে দামি হয়ে গেছে। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে আমাদের ভালোলাগা, খারাপ লাগা সবকিছু এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভিত্তিক হয়ে গেছে। মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার থেকেও এই সোশ্যাল মিডিয়া, যেটা নাকি আসলে একটা অল্টারনেটিভ মিডিয়া সেটার নিউজটাই মানুষ বেশি ফলো করে। সেখানে শিক্ষিকা খাইরুনের মৃত্যুতে প্রচ্ছন্নভাবে তো একটা নেগেটিভ ভূমিকা অবশ্যই রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াকে তো আপনি আসলে কন্ট্রোল করতে পারেন না। আমাদের মূলধারার যে মিডিয়াগুলো রয়েছে, খবরের শিরোনাম তৈরি করতে গেলে তাদের আসলে আরো অনেক বেশি সচেতন হওয়া উচিত। সাংস্কৃতিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি সংবেদনশীল হওয়া উচিত। সংবেদনশীলতাটা আমরা দিন দিন হারিয়ে ফেলছি। যারা এই অসংবেদনশীলতার বোঝাটা বহন করতে পারে না তারা দুর্বল হয়ে পড়ে, তারা আত্মহত্যার মতো একটি পথ বেছে নেয়। যার পরিণাম হয়তোবা যে শিক্ষিকার মৃত্যু হয়েছে কিংবা বলা হচ্ছে আত্মহত্যা করেছেন। তার ক্ষেত্রে এই অসংবেদনশীলতা একটি বড় কারণ হতে পারে।
সাইবার ক্রাইম আইন বা আইসিটি আইন কিন্তু খুব শক্ত আইন, এখানে এর যথাযথ প্রয়োগ করা হয়। তবে নিউজের নিচে কমেন্ট সেকশনে আমরা যে কমেন্টগুলো পড়ি তার আশি শতাংশই থাকে নেগেটিভ। এই আশি শতাংশ মানুষকে তো আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। যখন একটি বিষয় এক্সট্রিম লেভেলে যায়, তখন কিন্তু সরকার ব্যবস্থা নেন। এরকম কিন্তু আমরা বেশ কিছু উদাহরণ দেখেছি। এখন সবাইকে তো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সেক্ষেত্রে আমাদের ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনের জায়গাটিকে আরএকটু জোরদার করতে হবে। এর প্রতিকার হল নিজের কাজটি করে যাওয়া। আমার কাজটি আমাকে করে যেতে হবে। আমি বিশ্বাস করি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যদি আমরা কাজ দেখাতে চাই সেটা যারা গ্রহণ করার তারা গ্রহণ করবেন। আমাকে দেখে যদি পাঁচ শতাংশ নারী বা পুরুষ অনুপ্রাণিত হন বা আমি কাউকে দেখে অনুপ্রাণিত হই
সেটাই যথেষ্ট। আর বাকি যারা কমেন্ট করবেন, তারা আপনার জীবন যাপন করছে না, আপনার সংগ্রামটাও করছে না। তাই আমার কাছে সব সময় মনে হয় বেস্ট উপায় হল তাদেরকে ইগনোর করা। শিক্ষাগত জায়গায়, সংস্কৃতি, সমাজে নারীকে বস্তু হিসেবে দেখা বন্ধ করতে হবে। নারীর সমতার জায়গাটা ওখান থেকেই শুরু করতে হবে। এখনো যদি শুরু করা হয় এর প্রতিফলন দেখতে আরো তিন চার প্রজন্ম লেগে যাবে।
সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য আমাদের যে সংস্কৃতিক জীবনধারা সেখান থেকেই শুরু হয়। যেটাকে আমরা কালচার বলি এবং সেটারই প্রতিফলন আমরা সবখানে দেখি। একটি উদাহরণ দেই, আমরা নারীকে ডিফাইন করি কিভাবে? যখন আমরা মানুষ সম্পর্কে বলি, একজন পুরুষ হেঁটে গেলে আমরা বলি মানুষটা যাচ্ছে, মেয়ে হেঁটে গেলে বলি মেয়েমানুষটা যাচ্ছে। আমাদের ছোট ছোট ভাষাগত জায়গা থেকেই আমরা আসলে বৈষম্যটা শুরু করি। আমাদের দেখবার জায়গা থেকে শুরু করি। সেটার প্রতিফলনই আসলে পড়ে এবং এটা খুবই ডিপ-রুটেড। পাঠ্যপুস্তকে নারীদেরকে সবসময়ই সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে মেয়েটি সংসারের কাজ করবে এবং ছেলেটি বাইরের কাজ করবে। এই বৈষম্য যেহেতু একদিনের না, এর পরিবর্তন ঘটাতে চাইলে অনেক কিছু দরকার। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন, নীতিবোধের জায়গায় পরিবর্তন দরকার। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমতা থাকা দরকার। পুরুষতান্ত্রিকতার থেকেও আমি বলবো আমাদের সমাজটা চলছে ক্ষমতাতন্ত্র দিয়ে। যার হাতে ক্ষমতা তার অধিকারেই সবকিছু থাকে এবং অবশ্যই ধরে নেয়া হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে, সাংস্কৃতিগতভাবে মেয়েরা কম ক্ষমতাধর এবং সেটারই প্রতিফলন হচ্ছে এই বৈষম্য। আমার কাছে মনে হয় যে আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটা দরকার। মেয়েদের ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট থাকা দরকার। এমন শিক্ষা ব্যবস্থা থাকা দরকার যে শিক্ষা ব্যবস্থা পাঠ্যপুস্তকের তথাকথিত শিক্ষা না। যেটা আমাদের মেয়েদেরকে এম্পাওয়ার্ড করবে, তাদের রাজনৈতিক অধিকারকে নিশ্চিত করবে। একজন নারী বা পুরুষের রাজনৈতিক অধিকার সুনিশ্চিত না হলে সে বাকি অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। আইনের সমতাটাও খুব দরকার আসলে। আইন যদি বিভাজন তৈরি করে তাহলে আমাদের কর্মক্ষেত্র, আমাদের সমাজ বিভাজন তৈরি করবেই।
পরিবারে বাবা মায়ের সম্পর্ক সন্তানের উপর সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলে। আমাদের পরিবারগুলোর একটা প্রথা হচ্ছে আমরা চাপিয়ে দেই। আমরা মনে করি একটি শিশুর জন্মানো মানে তাকে পরিবার থেকে কতগুলো গোল সেট করে দিতে হবে। শুধু মেয়েরা নয়, ছেলেদের ব্যাপারেও পরিবার অনেক কিছু চাপিয়ে দেয়। যেমন লক্ষ্য করে থাকবেন, ছেলেদেরকে বলা হয় তুমি মেয়েদের মত কাঁদছো কেন? একটা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া করতে মানা করা হয়। আমার আনন্দে চোখে পানি আসতে পারে, কষ্ট চোখে পানি আসতে পারে, সেই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকে বন্ধ করে দেয়া হয়। সেই আবেগের জায়গাটাকে দমন করা হয়। তখন সেই অনুভূতিটা রূপান্তরিত হয় রাগে-ক্ষোভে, হিংস্রতায়, ক্ষমতার দম্ভে। ফলে একজন কিশোর পুরুষ হয়ে ওঠে কিন্তু তার মানবিকতা অবদমিত হয়। একইভাবে একটি মেয়েকেও খেলার জন্য ধরিয়ে দেয়া হয় হাড়ি-পাতিল, পুতুল। বল নিয়ে খেলতে দেয়া হয় না। রংয়ের বিভাজন করে দেয়া হয়। ছেলেরা এই রং পরবে, মেয়েরা ওই রং পরবে। ছেলেরা কম সংবেদনশীল হবে, মেয়েরা বেশি সংবেদনশীল হবে। এই বিভাজনগুলো না করে একজন কিশোর ও কিশোরীকে যদি অনেকগুলো রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বলা হয় এগুলো হচ্ছে সঠিক পথ। এই সঠিক পথগুলোর মধ্য থেকে তুমি তোমার পছন্দের পথটি বেছে তোমার গন্তব্যে যাও। এই উদারতা, এই বন্ধুত্বটা যদি থাকতো তাহলে আমার মনে হয় মানসিক গঠনটা আরো দৃঢ় হতো। আমাদের সামাজিক কাঠামো বাবা-মাকে বন্ধু হতে শেখায় না। বাবা-মাকে একটা কঠিন শাসকের জায়গায় বসানো হয়। সেটা না করে বন্ধু হলে সন্তানের কথা বলার একটা বড় জায়গা তৈরি হবে। এর ফলে সন্তান কম মাদকাসক্ত হবে, কম বিষন্নতায় ভুগবে, কম আত্মহত্যা করবে। বুলি হলে কথা বলার জায়গা খুঁজে পাবে। পরিবারকে আশ্রয় বলে মনে করবে।