ঢাকার শেরে বাংলা নগরের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের নিচ তলায় বেশ উচ্চস্বরে মুঠোফোনে গান শুনছেন এক কিশোরী: ‘‘তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করো/মলিন মর্ম মুছায়ে।’’ হঠাৎ নানীর তাড়া, "ওই সামিয়া (ছদ্মনাম) গান বন্ধ কর। বাড়ি যাইতে অইব।" এক মাস আগের সামিয়া হলে কিছুতেই নাকি গান বন্ধ করতেন না। কিন্তু এই সামিয়া নানীর কথা শুনেই গান বন্ধ করে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়লেন। বহির্বিভাগ পার হতে হতে নিজেই ধরলেন অন্তরা: ‘‘লক্ষ-শূন্য, লক্ষ্য বাসনা ছুটিছে গভীর আঁধারে/জানি না কখন ডুবে যাবে কোন অকুল-গরল-পাথারে...।’’
১৭ বছর বয়সী সামিয়া টানা এক মাস বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার এই মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এখন ‘প্রায়’ সুস্থ। বছর দুয়েক ‘বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার’ রোগে ভুগে পরিচিত একজনের পরামর্শে গাজীপুর থেকে হাসপাতালটিতে আসেন। ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখান। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তাকে পাঠান ১০১ নম্বর কক্ষের আবাসিক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। এরপর মেডিকেল বোর্ড থেকে ভর্তির পরামর্শ দেওয়া হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি ভর্তির জন্য বেড পেয়ে যান।
শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সামিয়াকে নিতে আসা স্বজনদের অনুমতি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। ছবি তোলার অনুমতি চাইলে মুখটা ঝাপসা করে দেওয়ার অনুরোধ জানান তারা। সামিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ভাই ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "সামিয়ার গল্পটা সবার জানা দরকার। ওকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম আমরা। রাতে ঘুমাতো না। কী সব আজগুবি কথা বলতো। আমরা তো ভেবেছিলাম পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু এই হাসপাতালের চিকিৎসায় এখন বেশ সুস্থ। মানসিক সমস্যা দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত এই হাসপাতালে যোগাযোগ করলে যে কেউ সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ সচেতন না। ভুক্তভোগীকে সবাই পাগল-পাগল বলে আরও বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। সামিয়ার ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছিল।’’
সামিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘এটি একটি আবেগজনিত মানসিক সমস্যা। দ্বিপ্রান্তিক মানসিক রোগ। বাইপোলার অর্থ, দুটি পোল বা মেরু। এক মেরুতে বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন। আরেক দিকে অতি উৎফুল্লতা বা ম্যানিয়া। এখানে আবেগের প্রকাশ বেশি। এই রোগীরা স্বাভাবিক পরিবেশ বুঝতে পারেন না। অসম্ভব কল্পনায় ডুবে থাকেন।’’
‘‘আমাদের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করতে নিষেধ করেছি সামিয়াকে। রোগটি যেন বারবার না হয়, সে জন্য তাকে ফলোআপ চিকিৎসা নিতে আসতে হবে।’’
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসকেরা গবেষণা কাজেও নিয়োজিত। জাতীয় পর্যায়ে প্রায় প্রতি বছর বড় ধরনের জরিপ করে হাসপাতালটি। পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার ২০১৯ সালের একটি জরিপের তথ্য উদ্ধৃত করে জানান, দেশের ১৬.৮ শতাংশ মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে অনেকের অবস্থাই সামিয়ার মতো গুরুতর হয়।
তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতালে যত মানুষ চিকিৎসার প্রত্যাশা নিয়ে আসেন, তাদের ৩০ শতাংশ রোগীরই আন্ডারলাইন কোনো না কোনো মানসিক রোগ আছে।’’
তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের সর্বশেষ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের প্রথম ৮ মাসে বাংলাদেশে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের ১৯৪ জন স্কুল-শিক্ষার্থী, ৭৬ জন কলেজ-পড়ুয়া, ৫০ জন বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া এবং ৪৪ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।
আঁচল ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬০ দশমিক ৭১ শতাংশই মেয়ে।
‘‘আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে’’ আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন আঁচলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘‘আমরা দেখেছি শিক্ষার্থীরা পরিবার থেকে কোনো কিছু না পেয়ে অভিমান করেও আত্মহত্যা করেছেন। প্রত্যাশা পূরণ না হলে কীভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সে বিষয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান নেই বললেই চলে। অন্যদিকে পরিবারের সদস্যরাও তাদের মানসিক সমস্যাকে রোগ হিসেবে বিবেচনা করতে চান না। আর এতেই বড় ধরনের বিপদ ঘটে।’’
সামিয়ার উদাহরণ টেনে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার মোহাম্মদ জামাল হোসেন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক ভ্রান্ত ধারণা আছে। এই ভ্রান্ত ধারণার কারণে তারা অপচিকিৎসার কবলে পড়েন। ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মেডিকেল সেটআপে সুশৃঙ্খল টিমের সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে যদি কোনো মানসিক রোগীর ম্যানেজমেন্ট করা হয় এবং পরিবার যদি সাপোর্টিভ হয়, তাহলে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো রোগীর পরিমাণ অবশ্যই কমে আসবে। জাতীয় অর্থনীতিতেও এই মানুষেরা বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবেন।’’
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন (ক্রনিক) মানসিক রোগে ভোগা মানুষদের জন্য বাংলাদেশে এখনো হাফওয়ে হোম, থেরাপিউটিক কমিউনিটি এবং ডে-সেন্টারের মতো সুবিধা সেভাবে দেখা যায় না। এগুলো একদম প্রান্তিক স্তরে দরকার। পাশাপাশি গুরুতর মানসিক রোগীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দরকার। মানসিক রোগীদের পূর্ণ ম্যানেজমেন্টের জন্য ভবিষ্যতে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হবে বলে আমরা আশাবাদী।’’
সামিয়া যেন বিজয়িনী
সামিয়ার অবস্থা বেশ গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছেছিল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু এ যাত্রায় তিনি ‘রক্ষা পেয়েছেন’ বলে আশা তাদের।
একমাস হাসপাতালে থাকলেও সামিয়াকে দেখে বোঝার উপায় নেই, এতদিন বাড়ি ছেড়ে দূরে ছিলেন। মুখে হাসি লেগেই আছে। কথা বলতে চাইলে নিজেই এগিয়ে এলেন।
গান শেখেন কি না-প্রশ্ন শুনে হাসিটা তার চওড়া হলো, ‘‘ছোটবেলা থেকেই গান শিখি। শারীরিক অসুস্থতার কারণে মাঝে কয়েক বছর শেখা হয়নি।’’
এখন কেমন আছেন-এই প্রশ্ন করার আগেই নিজে উত্তর দিলেন, ‘‘আগের চেয়ে শরীরটা অনেক ভালো। হাসপাতালের পরিবেশ খুব সুন্দর। সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ডাক্তাররা এত ভালো বলে বোঝাতে পারবো না। মনেই হয়নি আমি বাড়ির বাইরে ছিলাম।’’
কথা বলতে বলতে সামিয়া চলে আসেন একদম বাইরের গেটের দিকে। সিএনজিতে উঠবেন। বিদায়ের আগে ছবি তুলতে চাইলে হাত দিয়ে ‘‘ভি’’ চিহ্ন এঁকে বলে যান, "অনেক দিন বাড়ি যাওয়া হয় না। সবাই অপেক্ষা করছে। দ্রুত ফিরতে হবে।’’