বিশ্ব বাজারে দাম বাড়ার যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশ সরকার রেকর্ড হারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করেছে। গত ৫ আগস্ট বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে দাম বাড়ানো হয়।
এভাবে দাম বাড়ানোয় মন্ত্রী-উপমন্ত্রীরা নানা যুক্তি তুলে ধরলেও ভয়েস অফ আমেরিকার কাছে জানানো প্রতিক্রিয়ায় বিরোধীদলসহ সরকারের বিভিন্ন শরিক দলের রাজনীতিবিদ এবং সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন।
বাংলাদেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এখন ১১৪ টাকা। আগে ছিল ৮০ টাকা। এতে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। ৫১ দশমিক ১৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮৬ টাকা লিটারের পেট্রলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩০ টাকা। অন্যদিকে ৫১ দশমিক ৬৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৮৯ টাকার অকটেনের নতুন দাম করা হয় ১৩৫ টাকা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে একবারে এমনহারে দাম আগে কখনো বাড়ানো হয়নি। আইন অনুযায়ী পেট্রোলিয়াম পদার্থ, বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের মূল্যহার নির্ধারণ করার কথা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি’র। কিন্তু বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে। এভাবে দাম বাড়ানোর কারণ এবং প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চেয়ে হাইকোর্ট ইতিমধ্যে রুল জারি করেছেন।
বিইআরসি’র চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল ১৭ আগস্ট ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যহার নির্ধারণ করার আইনগত দায়িত্ব কমিশনের হলেও প্রবিধান চূড়ান্ত না হওয়ায় তারা করছেন না। তবে গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম তারা নির্ধারণ করে থাকেন।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি নীতির সমালোচনা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরূল ইমাম ১০ আগস্ট ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তকে অবজ্ঞা করে নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধানে না নামায় এই সংকট দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য তিনি নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে সরকারের একটি পক্ষের ‘ইচ্ছাকৃত অনীহাকে’ দায়ী করছেন।
এ পর্যায়ে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছে কয়েকজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে।
প্রতিক্রিয়া
হাসানুল হক ইনু
সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)
জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মৃল্যবৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ আমি খুঁজে পাইনি। এটা অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী। সিদ্ধান্তটা প্রত্যাহার এবং বাতিল করা উচিত।
দাম বাড়ানোর পেছনে কর্তাব্যক্তিরা যেসব যুক্তি দিচ্ছেন...বৈশ্বিক সংকট, ইউক্রেন যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি...এসবের কারণে তারা বাড়তি আয় করতে চায়। যুক্তিগুলো আমি সঠিক মনে করছি না। ভর্তুকি বহন করার সক্ষমতা বাংলাদেশের অর্থনীতির আছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংকটও মোকাবিলার সক্ষমতা আছে।
জ্বালানির এই মূল্যবৃদ্ধি শিল্প এবং পরিবহনখাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সার্বিক অর্থনীতির ভেতরে উৎপাদন কমাবে। এটা নিয়ে যেহেতু বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়া আছে, তাই আগের মূল্য রাখলে যে উৎপাদনটা বাড়বে, সেখানে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও থাকবে, বাড়তি রপ্তানিও হবে, আমদানিও কমবে।
আমি সরকারের যুক্তি গ্রহণ করছি না। তাই সিদ্ধান্ত বাতিল করার আহ্বান জানাচ্ছি।
আমি মনে করি জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি বা মূল্যস্ফীতি নিয়ে ক্ষমতা দখলের খেলায় নামা ঠিক না। সমাধানের জন্য কথা বলা উচিত।
রাশেদ খান মেনন
সভাপতি, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি
বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের সংকট চললেও বাংলাদেশে যেহারে মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে, সেটা খুবই অযৌক্তিক এবং অমানবিক। ওদিকে বিপিসির লাভের টাকার হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। এই টাকা দিয়েই এখন সমন্বয় করা যেত।
সরকার প্রথম থেকেই আমদানি নির্ভর যে নীতি গ্রহণ করেছে, সেটা কার্যকর সিদ্ধান্ত ছিল না বলে আমি মনে করি। এটা ভ্রান্তনীতি। মূলত এলএনজি আমদানি করতে তারা এই নীতি গ্রহণ করেছে। এখন বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বেশি। তাই দাম সমন্বয় করতে পেট্রোল, ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিল্প উদ্যোক্তাকে পর্যন্ত আঘাত করা হলো। দাম সহনীয় সীমায় রাখতে কর কমানো যেত।
দাম বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা যেমন সমর্থন করছেন না, তেমনি সরকারের অনেকেই করছেন না। কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে সরকারের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করছে। এটা রাজনৈতিক প্রভাব।
একমাত্র জ্বালানি মন্ত্রণালয় বাদে কেউ যৌক্তিকতা দেখতে পাচ্ছে না। তারা বারবার বলছে, বিশ্বে দাম কমে গেলেই সমন্বয় করা হবে। কিন্তু বাংলাদেশের নিয়ম হচ্ছে একবার দাম বেড়ে গেলে সহসা সেটা নামে না।
দিলীপ বড়ুয়া
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল এবং সাবেক শিল্পমন্ত্রী
সরকার যেভাবে, যেহারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে, এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। জ্বালানি তেল আর তেলের ভেতর থাকছে না; এর নেতিবাচক প্রভাব সমাজের সর্বস্তরে পড়ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা অর্জন করেছেন, সেই অর্জনগুলো জ্বালানি তেলের মধ্য দিয়ে অনেকটা বর্জনের দিকে চলে যাচ্ছে। এখন বিরোধী দলও জনগণকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ খুঁজবে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি কোনো অবস্থায়ই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না। এটা আমলা নির্ভর সিদ্ধান্ত। দেশের শিল্পক্ষেত্র থেকে শুরু করে কৃষিক্ষেত্রে পর্যন্ত এর প্রভাব পড়বে।
রাজনীতিবিদ হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে এটা আমাদের জন্য একটা চাপ। মানুষকে আমরা বলছি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সঠিক হয়নি। এটা কিন্তু আমরা ইতিমধ্যে বলা শুরু করেছি। প্রয়োজন হলে মানুষের কাছে আরও যাব।
রুমিন ফারহানা
বিএনপির সংসদ সদস্য ও হুইপ
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি একেবারে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে। দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ যখন দারিদ্রসীমার নিচে, শ্রেণি কাঠামো পাল্টে গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি তীব্র হয়েছে-সেই সময় হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। এতে প্রান্তিক মানুষ থেকে শুরু করে প্রত্যেকের জীবনে প্রভাব পড়ছে। পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। এর ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম বেড়েছে। ডিম থেকে শুরু করে টুথপেস্ট পর্যন্ত-কোনো কিছুই বাদ নেই, যেটার দাম বাড়েনি। ডিম গরীবের প্রোটিন বা আমিষের চাহিদা পূরণ করে, তার হালি এখন ৫০ টাকার বেশি। মানুষ তাহলে খাবে কী?
মানুষকে এই দুরবস্থায় ফেলে দেওয়ার কোনো দরকার ছিলো না। বিপিসি তো লাভেই ছিলো। গত কয়েক বছরে ৪৬ হাজার কোটি টাকা তাদের মুনাফা হয়েছে। তারা দাবি করছে, আট হাজার কোটি টাকা সম্প্রতি লোকসান হয়েছে। এখন আট হাজার কোটি টাকা বাদ দিলেও তাদের ৩৮ হাজার কোটি টাকা লাভ থাকে। আগামী ২১ মাস তারা দাম না বাড়িয়ে জ্বালানি তেলের চাহিদা মেটাতে পারতো। সেটা না করে এই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় দাম বাড়ানোটা জনগণের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণের সামিল। বিপিসি লাভে তো আছেই। পাশাপাশি সরকার ৩৪ শতাংশ রাজস্ব নেয় তেল থেকে। সেই রাজস্ব যদি কমিয়ে আনতো, তাহলে তেলের দাম হঠাৎ এতটা বাড়ানোর দরকার হয় না।
মানুষকে এভাবে চাপে ফেলাতেই প্রমাণিত হয়, সাধারণ মানুষের ভালো থাকার সঙ্গে এই সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই।
এখানে রাজনৈতিক কৌশল হলো পুরো দায়টা মানুষের ঘাড়ে চাপানো। আমাদের লেনদেন তীব্র ভারসাম্যহীন অবস্থায় আছে। রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে। সরকার মুখে যাই বলুক না কেন, তারা জানে রিজার্ভের অবস্থা কতটা খারাপ। সেকারণেই আইএমএফের কাছে যেতে হয়েছে। তাদের শর্ত ছিল জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি কমিয়ে আনা। ভর্তুকি কমাতে গিয়ে সরকার পুরো দায়টা মানুষের ঘাড়ে চাপিয়েছে। সরকার দুর্নীতি কমাতে পারতো, অব্যবস্থাপনা কমাতে পারতো, কর কমিয়ে আনতে পারতো-এসব না করে পুরো দায় জনগণের ওপর চাপিয়েছে।
ড. রেজা কিবরিয়া
আহ্বায়ক, গণ অধিকার পরিষদ
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের ওপর আরেকটা জুলুম। এমনিতে সবকিছুর দাম বাড়তি। এর ওপর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় সবকিছুর দাম আরও বাড়ছে। ট্রাকের ভাড়া বাড়ায় সবজির দামও বেড়েছে। এখন সাধারণ একটা পরিবারের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্বে দাম বাড়লে এখানে তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এখন যে দাম কমছে, সেদিকে কারো খেয়াল নেই। পৃথিবীতে তেলের দাম কমলে এখানে আর কমে না।
আমেরিকায় তেলের দাম বেড়েছিল। সেখানে দাম এখন কিছুটা কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারটা একমুখী। বাড়ার পর দাম আর কমে না।