বদরূল ইমাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য তিনি গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে সরকারের একটি পক্ষের ‘ইচ্ছাকৃত অনীহাকে’ দায়ী করছেন। সরকার ‘আপাতত দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে ভরসা’ রাখার কথা জানালেও বদরূল ইমাম একে ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ বলছেন। ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তকে অবজ্ঞা করে নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধানে নামছে না। ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অমৃত মলঙ্গী।
ভয়েস অফ আমেরিকা: প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী মঙ্গলবার (৯ আগস্ট) বলেছেন, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে এলএনজি আমদানিই ভরসা। আপনি গত সপ্তাহে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছিলেন, উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানির প্রবণতা থেকে বের হতে হবে। এখন উপদেষ্টার এই বক্তব্য থেকে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে কী ধারণা পেলেন?
বদরূল ইমাম: এই কথায় আমি খুব একটা স্বস্তি পেলাম না। বাংলাদেশের এই সংকট অবহেলাজনিত। এটা মানতেই হবে। এর মানে এই না যে, কোনো অনুসন্ধান হয়নি বা কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি। আমি বলছি, বাংলাদেশে যে পরিমাণ সম্ভাবনা তা কাজে লাগানো হয়নি। জোরালো অনুসন্ধানের পথে গেলে প্রচুর গ্যাস পাওয়া যেত। এটা স্বতঃসিদ্ধ। পৃথিবীর সব ডেল্টা এরিয়ায় গ্যাস আছে। বাংলাদেশে তো এর ব্যতিক্রম হবে না। বৈজ্ঞানিক সূত্র অনুযায়ী, এখানে গ্যাসের সম্ভাবনা খুবই ভালো। সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য আমাদের যে পরিমাণ অনুসন্ধান করা দরকার, আমরা কখনোই সেটা করিনি। গত ১০ বছরেও করিনি; ২০ বছরেও করিনি। এই কথা যদি না বোঝা হয় বা কেউ বুঝতে না চান, সেখানেই সমস্যা।
ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনার এই কথার সূত্র ধরে বলতে চাই, অনুসন্ধান কূপ খননের জন্য আমাদের দেশে তো নানা ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে। সেগুলোর ফলাফল কী হলো?
বদরূল ইমাম: আমাদের এখানে বহুবিধ সায়েনটিফিক অ্যাসেসমেন্ট হয়েছে। এর মধ্যে ২০০১ সালে ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে এবং পেট্রোবাংলার যৌথ একটা মূল্যায়ন হয়েছিল। তারা সার্বজনীন পদ্ধতিতে মূল্যায়নটা করেছিল। এই মূল্যায়নে তারা সম্ভাব্যতা যাচাই করে বলেছে, এখানে আরও ৩২ টিসিএফ অনাবিষ্কৃত গ্যাস পাওয়ার ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা আছে। তারা এটাও বলেছে, ৮.৫ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার ৯০ শতাংশ সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ বছরে এক টিসিএফ গ্যাস ব্যবহার করে। এখন যদি আমরা সর্বোচ্চ সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে ৯০ শতাংশের দিকেও যাই, তাহলে হাতে আট বছরের গ্যাস থাকার কথা। সুতারং সংকট তো এখন আসার কথা না।
এরপর Norwegian Petroleum Directorate কোম্পানি আরেকটা অ্যাসেসমেন্ট করে। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এটাও যৌথ ছিল। এগুলো কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায়ই হয়েছে। নরওয়ের এই সরকারি কোম্পানি বলেছিল, ৩২ নয়; ৪২ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা আছে। আর ৯৫ শতাংশ সম্ভাবনার কথা বললে ১০ টিসিএফ।
২০১৮ সালে হওয়া আরেকটি অ্যাসেসমেন্টের কথা বলি। এরা একটা ড্যানিশ কোম্পানি ছিল। পরামর্শক হিসেবে তাদের সহায়তা নেওয়া হয়। তারা বলেছিল, ৩৪ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার ৯০ শতাংশ সম্ভাবনা আছে।
এই মূল্যায়ন আমলে নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধানে নামা উচিত ছিল। আমরা তিনটি কূপ খনন করলে একটাতে (৩:১) গ্যাস পাওয়া যায়। এটাকে বলে সফলতার হার। বিশ্বে এটা বিরল। সারা পৃথিবীতে এই হার ৫:১।
ভয়েস অফ আমেরিকা: তাহলে সরকারের এলএনজি আমদানি নির্ভরতার সিদ্ধান্তকে আপনি 'ভুল' বলতে চান?
বদরূল ইমাম: অবশ্যই এটা ভুল। অনেক অপশন আছে। অনুসন্ধানে গেলে সংকট থেকে উঠে আসতে পারবো। সরকারি মহলের কোনো কোনো কর্মকর্তা ডেটাবেইজগুলো স্বীকার করতে চাচ্ছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিষ্ঠান সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে, তারা পৃথিবীতে বিখ্যাত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এদের কাজই হচ্ছে, সায়েন্টিফিক ডেটা সংগ্রহ করা। এখন এই সংস্থাগুলোকে অবজ্ঞা করা ঠিক না।
ভয়েস অফ আমেরিকা: তাহলে কি আমরা এটা বলতে পারি, বাংলাদেশ বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাকে 'অস্বীকার' করে এলএনজির ওপর নির্ভর করছে...
বদরূল ইমাম: একদম ঠিক, একদম ঠিক, একদম ঠিক ... । আপনি আমার কথাটাই বলেছেন। বিজ্ঞানভিত্তিক মূল্যায়নকে অবজ্ঞা করে বর্তমান নীতিটা পরিচালনা করা হচ্ছে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: এক সময় বলা হয়েছিল "বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে"। এখন সরকারের উপদেষ্টা বলছেন, মাটির নিচে গ্যাসের কথা শুনেই অত খুশি হওয়ার কিছু নেই। গ্যাস তাহলে গেল কোথায়?
বদরূল ইমাম: বাংলাদেশের একটা কোম্পানি যখন গ্যাস রপ্তানি করতে চেয়েছিল, তখন এই কথা রটানো হয়েছিল। তারাই চারদিকে ছড়িয়েছিল যে "বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে"। তারা মানুষকে বোঝাতে চেয়েছিল বাংলাদেশে অনেক-অনেক গ্যাস আছে। আমরা অনেক আন্দোলন করে তাদের ঠেকিয়েছি।
ওই গ্রুপই এখন আবার বলছে, বাংলাদেশে গ্যাস নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিজ্ঞান। সেই বিজ্ঞানকেই আমরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছি। বিজ্ঞানের ওপর ভরসা রেখে পৃথিবীতে যারা কাজ করেছে, কেউই লোকসানের মুখে পড়েনি।
ভয়েস অফ আমেরিকা: কিন্তু সরকারের প্রতিনিধিরা প্রতিবেশী মিয়ানমারের উদাহরণ দিয়ে বলছে, দেশটি গত ১০ বছরে তেমন কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করতে পারেনি। যা করেছে সব আগের। আসলে কী তাই?
বদরূল ইমাম: আরে কী বলছেন! মিয়ানমার ২০১২ সালের পরে অনেক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। সর্বশেষ করেছে ২০২০ সালে। তার আগে ২০১৯ সালে একটা করেছে। এগুলো তো ম্যাপে আছে।
মিয়ানমারের কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র আমাদের সীমান্তের কাছাকাছি। একই ধরনের গ্যাসক্ষেত্রের কাঠামো আমাদের দেশের এপারে আছে। গবেষকেরা সেটা শনাক্তও করেছে। সিঙ্গাপুরের SEAPEX কনফারেন্সে ভূতত্ত্ববিদ এডউইন বোলসের নেতৃত্বে ‘The Hydrocarbon Potential of the Channel Sands and Basin Floor Fans of Block SS-11, Hatia Trough, Offshore Bengal Basin’- শিরোনামের একটি প্রেজেন্টেশনে এটা প্রকাশও করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মিয়ানমারের কাঠামো এবং বাংলাদেশের কাঠামো জেনেটিক্যালি এক।
ভয়েস অফ আমেরিকা: মঙ্গলবার (৯ আগস্ট) জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস গেল। পেট্রোবাংলা এখন বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে তারা ১৭টি অনুসন্ধান কূপ খনন করবে। এটা সম্ভব?
বদরূল ইমাম: সত্যিকার অর্থে চেষ্টা করলে সম্ভব। তিন-চারটি করে কূপ বাপেক্স (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড) নিজেই খনন করতে পারে। বাকিগুলো চুক্তিতে বাইরে থেকে করাতে পারে। বছরে পাঁচটি করে কূপ খনন সম্ভব। কিন্তু হতাশার কথা হলো, বাংলাদেশে এ ধরণের পদক্ষেপ কখনোই নেওয়া হয়নি।
ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনি বাপেক্সের কথা বললেন। এর আগে তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ২০২১ সালের মধ্যে ১০৮টি কূপ খননের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সেই পরিকল্পনার বিষয়ে কী বলবেন?
বদরূল ইমাম: ওই পরিকল্পনা একদম ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। তখন ফলাও করে এটা বলাবলি হয়েছিল। একদিন হঠাৎ শুনলাম, ওই প্রোগ্রামই বাতিল! এগুলো আসলে হাস্যকর।
ভয়েস অফ আমেরিকা: বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ প্রায়ই বলছেন, ‘জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক মিনিটের জন্যও কখনো বিদ্যুৎ যায়নি, এখন সেখানে লোডশেডিং হচ্ছে, বিদ্যুতের রেশনিং করা হচ্ছে।’ একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনি জার্মানির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনাটা কীভাবে করবেন?
বদরূল ইমাম: এই তুলনা আমি কখনোই করবো না। ডিজেলের দামের ক্ষেত্রে তারা বলছে জার্মানে এত দাম, আমেরিকায় এত দাম, ইউক্রেনে এত দাম...বাংলাদেশে একজন রিকশাওয়ালা রুটি খায় ২০ টাকা দিয়ে, আর আমেরিকাতে এই শ্রেণির মানুষ রুটি খায় এক ডলার দিয়ে। এক ডলারে ওই একই রুটি আপনি বাংলাদেশে ১০০ টাকা দিয়ে কিনবেন?
তাদের সঙ্গে আমাদের যে সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক পার্থক্য, সেটা তো ভুলে গেলে চলবে না।
ভয়েস অফ আমেরিকা: অনেক দিন ধরেই একটা সমন্বিত জ্বালানিনীতির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সেটা হয়নি। বাংলাদেশের এখনকার জ্বালানি নীতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
বদরূল ইমাম: এই নীতিতে সুস্পষ্ট কোনো দিক নির্দেশনা নেই। এটা করা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। কোনো আপডেট নেই। নিয়মমাফিক চলছে। এভাবে হয় না।
"বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তিনি বিদেশি শেল অয়েল কোম্পানির থেকে ৪.৫ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং মূল্যে পাঁচটি গ্যাস ফিল্ড কেনেন ৯ আগস্ট। আমরা এখন যে গ্যাস পাই, তার প্রধান উৎস কিন্তু সেই পাঁচ গ্যাসক্ষেত্র। বঙ্গবন্ধু নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো শেখাতে চেয়েছিলেন। আমাদের সম্পদ বিদেশিদের কাছে রাখতে চাননি। এখন তার আদর্শ থেকে আমরা বিচ্যুত হয়েছি। নিজেদের কয়লাক্ষেত্র থাকতে আমরা আমদানি করছি, গ্যাসক্ষেত্রের সঠিক ব্যবহার করছি না।"
ভয়েস অফ আমেরিকা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার মৃত্যুর কয়েক দিন আগে পাঁচটি কূপ কিনেছিলেন। তিনি জ্বালানিখাতকে মূলত সেবামূলক খাত হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তার মৃত্যুর এত বছর বাদে সেবার সেই মানসিকতা কতটুকু বজায় থাকছে?
বদরূল ইমাম: বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তিনি বিদেশি শেল অয়েল কোম্পানির থেকে ৪.৫ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং মূল্যে পাঁচটি গ্যাস ফিল্ড কেনেন ৯ আগস্ট। আমরা এখন যে গ্যাস পাই, তার প্রধান উৎস কিন্তু সেই পাঁচ গ্যাসক্ষেত্র।
বঙ্গবন্ধু নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো শেখাতে চেয়েছিলেন। আমাদের সম্পদ বিদেশিদের কাছে রাখতে চাননি। এখন তার আদর্শ থেকে আমরা বিচ্যুত হয়েছি। নিজেদের কয়লাক্ষেত্র থাকতে আমরা আমদানি করছি, গ্যাসক্ষেত্রের সঠিক ব্যবহার করছি না।
সরকারের একটি অংশ এসব কথাবার্তা ভীষণভাবে অপছন্দ করে। কিন্তু সত্য আমি বলেই যাবো। বিজ্ঞান যতক্ষণ আমার হাতে, ততক্ষণ আমি কথা বলবো।