শারমিন শামস্ একজন সাংবাদিক, লেখক, সংগঠক। দীর্ঘদিন নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। দীর্ঘসময় কাজ করেছেন বাংলাদেশের প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ায়। ২০২০ সালে নারীদের জন্য ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর নামে একটি অনলাইন পোর্টাল গড়ে তুলেন, যা এরই মধ্যে সাড়া ফেলেছে। সম্প্রতি ‘শান্তিবাড়ি’ নামে নারীদের জন্য আরো একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। সম্প্রতি আমরা কথা বলেছি তার সঙ্গে। তিনি আমাদের জানিয়েছেন তার কাজ নিয়ে, উদ্যোগ নিয়ে পরিকল্পনার কথা, স্বপ্নের কথা। নারীবাদ নিয়ে তার ভাবনা ও বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে হতাশার কথাও জানিয়েছেন। ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আফরিন শাহনাজ।
ভয়েস অফ আমেরিকা : ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর শুরুর পেছনে মূল ভাবনা কী ছিলো?
শারমিন শামস্: নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা এবং বিশেষ করে নারীবাদ এ জাতীয় চিন্তাগুলোর ব্যাপক প্রচারণার দরকার আছে, মানুষের কাছে পৌঁছানোর প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়। আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে, বিশেষ করে ফেমিনিজম নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে একটি বিরাট ধরণের মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে। এই মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিংটাকে আমি মনে করি খুব পজিটিভলি হ্যান্ডেল করা দরকার। আমার কাছে মনে হয় যে, আমি যদি ঠিক তথ্য এবং জ্ঞান মানুষকে দিতে পারি, তাহলে মানুষ একটা সময়ে ভুলটা বুঝতে পারবে। ফেমিনিজমের যে সঠিক ধারণাটা, সেটা মানুষের কাছে পৌঁছানোটা খুব জরুরী। এটা একটা কারণ ছিলো ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর শুরু করার পেছনে। আরেকটা কারণ হলো আমাদের দেশের নারীদের, শুধু নারীদের না; ফেমিনিজ ইস্যুতে, লিঙ্গ ইস্যুতে, বৈষম্য ইস্যুতে মানুষের প্রচুর কথা বলার আছে। সাধারণ মানুষ, সাধারণ নারী-পুরুষ লিখতে চায়, অনেক কিছু বলতে চায়। কিন্তু সেই প্লাটফর্মটা নেই। ফেমিনিজম নিয়ে আলাদা একটি পত্রিকা, এরকম তো খুব কম। বাইরে আছে, আমাদের দেশে তো নেই। তাই সেই প্লাটফর্মটা তৈরি করা দরকার। এই যে লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর অধিকার এই বিষয়গুলোতে বিভিন্ন কথা বলা দরকার, মেয়েরা নিজেদের কথা লেখার একটা প্লাটফর্ম দরকার, পুরুষেরও দরকার। সেই সাথে এই বিষয়গুলোতে চিন্তাকর্ষক লেখা আসা দরকার। যেটা আমি শুরুতে বলেছি, মানুষের ভুল জানাটা আছে। তা ঠিক করার জন্য আমাদের আসলে ভালো লেখারও দরকার। অনেক তথ্যবহুল লেখা আসা দরকার আছে। শুধু লেখা না, আমি মনে করি যে, সবরকম কন্টেন্টই আসলে ক্রিয়েট করার আছে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর ইজ ট্রাইং টু ডু অল দিজ কাইন্ড অফ থিংস, যাতে এই জায়গাগুলো ক্লিয়ার হয়। অডিও ভিজুয়াল কন্টেন্টও আমরা তৈরি করি। শুধু লেখা না। যদিও এখনো মূল জায়গাটা লেখালেখির ভেতরেই আছে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পথচলা কবে থেকে শুরু?
শারমিন শামস্: ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখ থেকে। আড়াই বছর হলো।
ভয়েস অফ আমেরিকা: এই যে একটা লক্ষ্য নিয়ে শুরু করেছিলেন, তাতে কতটা সফলতা এসেছে বলে মনে করেন? কতটা সাড়া পেয়েছেন?
শারমিন শামস্: সফলতা না বলে আমি যদি অন্যভাবে জিনিসটাকে বলি, আমি যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে চেয়েছি, সে লক্ষ্যের কতটা কাছাকাছি যেতে পেরেছি বা কতটুকু এক্সপেক্টেশনের জায়গাটা পূরণ হয়েছে সেটা যদি বলি তাহলে আমি বলব, শুরু করার আগে যে চিন্তা করেছিলাম, প্রথম দিন থেকেই সে চিন্তার চেয়েও বেশি আমার এক্সপেক্টেশনের জায়গাটা পূরণ হয়েছে। আমার একটা ধারণা ছিলো, আমি এর আগে তো একজন ইনডিভিজ্যুয়াল, ইনডিপেন্ডেন্ট রাইটার হিসেবে লিখতাম। সেইসময় আমার তো অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে। এই কন্টেন্টগুলো নিয়ে কথা বলা বা এই ধরণের বিষয়গুলো লিখতে গিয়ে অনেক রকম বাঁধা, অনেক রকম ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। আবার অনেক অ্যাপ্রিসিয়েশনও পেয়েছি। সেই জায়গা থেকে আমি যখন একটা পত্রিকা শুরু করলাম, সম্পাদনা করা, প্রকাশক হিসেবে প্রকাশ করা শুরু করলাম তখন আমার চিন্তাই ছিলো কতজন লেখক পাবো, কয়টা লেখা আসবে বা কতটুকু মানুষ পড়বে বা কতটা পাঠক পাবো। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, আমার চিন্তার বাইরে এমন সব জায়গা থেকে লেখা এসেছে। আমি অনেক স্কলার লেখকও পেয়েছি, যারা বাংলাদেশে ও বাংলাদেশের বাইরে থাকেন, বাইরে গবেষণার কাজ করছেন, শিক্ষকতা করছেন এরকম স্কলার মানুষদের পেয়েছি লেখক হিসেবে আবার বড় বড় লেখকদের পেয়েছি, আমার এখানে লিখছেন। আবার ধরেন, একেবারে গ্রামে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটা মেয়ে থাকে। চিন্তাই করা যায় না যে সে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর পড়ছে। কিন্তু সে পড়ছে। তার কাছে ফেমিনিস্ট ফ্যাকটরের লেখা পৌঁছেছে এবং সে আমাকে তার লেখা মেইল করেছে। এবং শুধু মেয়ে না, অবাক হবেন যে অনেক পুরুষও। প্রাইমারি স্কুলের একজন টিচার অথবা একজন পশুর ডাক্তার, তারাও আমাকে লেখা পাঠিয়েছেন। তাদের চিন্তাধারা খুবই প্রগতিশীল, চিন্তাধারা অনেক আলোকিত। তারা লিখছেন এবং এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করছেন, প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এটা খুবই উদ্দীপনা যোগায়। প্রচুর পাঠক লেখা পড়ছেন, আমি প্রচুর রেসপন্স পাই। তর্ক-বিতর্ক হয়, লেখা ভাইরাল হয়। অনেক কিছুই হয়। এটা আমার এক্সপেকটেশনের বাইরে ছিলো এবং এখন তো আমার এটা খুব ভালো লাগে। আমি রিয়েলি এটাকে এনজয় করি।
ভয়েস অফ আমেরিকা: যেটা বলছিলেন যে, বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নারীবাদ নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। কী কী ভুল ধারণা রয়েছে বলে মনে করেন?
শারমিন শামস্: নারীবাদ একটা আদর্শ, একটা দর্শন, একটা রাজনৈতিক অবস্থান। নারীবাদ এ সবকিছুই। নারীবাদের কিন্তু একটা ভিত্তি আছে, একটা সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। চিন্তার জায়গা আছে, চর্চার ইতিহাস আছে, সংগ্রামের ইতিহাস আছে। নারীবাদ কিন্তু ভূইফোঁড় কিছু না। দীর্ঘদিনের সংগ্রামের একটা সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে, সফলতার ইতিহাসও আছে। সেই সফলতার ইতিহাসগুলোর ভেতর দিয়েই কিন্তু নারীবাদ আসছে এবং নারীবাদের একটা দর্শনগত দিক আছে। আদর্শর দিক আছে। মানুষ সেগুলো জানেই না। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং। ভাবে যে নারীবাদ বলতে নারীকে পুরুষের উপর তুলে ধরা। কিন্তু বিষয়টা একেবারেই তার উল্টো। সেটা হচ্ছে, সমতা। নারীবাদ কিন্তু শুধু নারী পুরুষ নয় সব ধরণের লিঙ্গের সমতার কথা বলে। কালো মানুষ-সাদা মানুষের ভেতরেও সমতার কথা বলে। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে সমতার কথা বলে। এই জায়গাটাই বোঝে না। নারীবাদের সাথে যেহেতু নারী কথাটা আছে, ধরে নেয় যে, নারীকে পুরুষের ওপরে ক্ষমতা দিয়ে দেয়া হলো এবং ভয় পেয়ে যায় তখন। এই মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের জায়গাটা মানুষকে ক্রমাগত বোঝাতে হবে। বোঝাতে বোঝাতে একটা সময় মানুষের যখন মূল কনসেপ্টের জায়গাটা ক্লিয়ার হবে তখন নিশ্চয়ই মানুষ বুঝতে শিখবে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের প্রতি সামগ্রিক যে আচরণ বা দৃষ্টিভঙ্গি এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
শারমিন শামস্: নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির জায়গাটা খুবই খারাপ এখন পর্যন্ত এবং আমার কাছে এটা খুবই কষ্টের ব্যাপার যে, আমার নিজের দেশটাই এরকম। আমি পৃথিবীর অনেক দেশে ভ্রমণ করেছি। কিন্তু আমার কাছে কখনও অন্য কোনো দেশের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে এতো খারাপ অনুভূতি হয়নি যেটা আমার নিজের দেশে হয়। এমন না, যে দেশগুলোর কথা বলছি, সেগুলো সবগুলো খুব উন্নত দেশ। আমি নেপালে দীর্ঘদিন থেকেছি। নেপাল তো বাংলাদেশের চাইতেও আর্থিকভাবে গরিব। কিন্তু ওদের ওখানে রাত ১২টা-১টার সময়ও নারীরা যে কোনো পোশাকে, যে কোনো পেশা থেকে মুভ করতে পারে। কেউ তার নিরাপত্তায় ব্যাঘাত ঘটাবে না। তাকে কোনো খারাপ কথা বলবে না। আমাদের দেশে নারীদের সংগ্রামটা এতো বেশি এবং আমাদের একধরণের দ্বিচারিতা আছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে, সামাজিকভাবে। দ্বিচারিতাটা হচ্ছে, আমরা রাষ্ট্রীয় নীতিতে সবসময় নারীবান্ধব কথাবার্তা বলি। যেমন, নারীকে এগিয়ে নিতে হবে। নারীকে শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে, সবকিছু আমরা বলি। কিন্তু, সমাজের যে মানসিকতা, সেটার যে বদল আনা, যে জায়গাটা মূলত নারীবান্ধব করার কথা সেটার কিন্তু কোনো প্রয়াস কোনো পক্ষ থেকেই নাই। উল্টো নারীবিদ্বেষী একটা সোসাইটি এবং সেটাকে এভাবেই রেখে দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিন্তু প্রোমটও করা হয়। একদিকে বলা হচ্ছে নারীর উচ্চশিক্ষা, নারীর পেশা উন্নয়নের কথা। বলা হচ্ছে নারী গার্মেন্টস শ্রমিকরা জাতীয় আয়ে ভূমিকা রাখছে। নারীর উন্নয়ন চাই। অন্যদিকে সোসাইটিটাকে এমন নারীবিদ্বেষী বানিয়ে রাখা হয়েছে, এই নারীরা যে রাত্রিবেলা কাজ করে বের হবে, তাদের তো কোনো নিরাপত্তা নাই। এই নিরাপত্তাহীনতার কারণে (নারীরা) প্রতিনিয়ত ইনসিডেন্টের শিকার হচ্ছেই। আমরা যদি শুধু আমাদের নিজেদের দিক থেকে চিন্তা করি তাহলে হবে না। আমাদের সোসাইটিতে এখনো অনেক মেয়ে গৃহবন্দীর মতো জীবন যাপন করছে। অনেক মেয়ে আছে যারা গ্রামে থাকে, মফস্বলে থাকে, ঢাকা শহরেও বন্দী থাকে। ওদের জীবনটা আসলে রান্নাঘরে শুরু হয়, রান্নাঘরে শেষ হয়। নিজের ডিসিশনটা নিজে নিতে পারে না। কোন পোশাক পরবে, কোন পড়াশোনা করবে, কোন জায়গায় যাবে না যাবে সবকিছুই তার পুরুষ অভিভাবকের দ্বারা নির্ধারিত, কিংবা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দ্বারা নির্ধারিত। তো এই সমাজটাকে তো আমি বলতে পারি না যে, খুব নারীবান্ধব সমাজ।
ভয়েস অফ আমেরিকা: এ সমাজে নারীদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি কোনটা মনে করছেন?
শারমিন শামস্: নিরাপত্তাহীনতা। সবচেয়ে বড় হুমকি। একদমই কোনো ধরণের নিরাপত্তা নেই আমাদের জন্য। একদম নেই। একজন নারী বাসার ভেতরেও নিরাপদ না। এবং সেটার একটা বড় কারণ হচ্ছে আইনের শাসন ঠিকভাবে নেই। ধরেন অনেক ঘটনা ঘটে, অনেক ক্ষেত্রে কিন্তু আইনের কাছে যায়ও না। কারণ হচ্ছে সেটার আল্টিমেটলি বিচার হবে কি না, কতদিনে হবে, বিচার চাইতে গিয়ে তাকে কত ধরণের হেনস্থা হতে হবে এসব ভেবে অনেকে কিন্তু বিচারও চায় না। এরচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কিছু হতে পারে না। ফলে ইনসিডেন্টের সংখ্যা যতটা আমরা জানতে পারি তার চাইতে আরো বেশি ।
ভয়েস অফ আমেরিকা: সম্প্রতি ‘শান্তিবাড়ি’ নামে একটি উদ্যোগ শুরু করেছেন। এটি নিয়ে আপনার পরিকল্পনাটা কী ?
শারমিন শামস্: আমি আসলে গত ছয়-সাত বছর ধরে এক ধরণের সোশ্যাল ওয়ার্ক করি। এক ধরণের নেটওয়ার্কিং করি। নারীরা আমার সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করে। হয়তো আমার লেখা পড়ে ওদের মনে হয় যে আমি এমন কিছু লিখেছি যেটা ওরা বলতে পারছে না, আমি ওদের হয়ে বলে দিচ্ছি। ওরা আমার সাথে খুব ক্লোজ ফিল করে। কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা যেটা হয়তো সেই নারীর কাছে মনে হচ্ছে যে আমাকে শেয়ার করা যায়। অনেক পরিচিত-অপরিচিত নারী, বেশিরভাগই অপরিচিতি; আমার সাথে অনলাইনে কিংবা টেলিফোনে কথা বলে। নিজের সমস্যা শেয়ার করে। এ ক্ষেত্রে যেটা হয় যে, আমি তো প্রফেশনাল কাউন্সিলার না। আমি যেটা করি, একজন বড় বোন হিসেবে পরামর্শ দেই, মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। অনেক সময় দেখেছি, বেশিরভাগ নারী ল্যাক অফ ইনফরমেশনে ভুগে। ইনফরমেশনটাই তাদের কাছে পৌঁছায় না এবং তাদের সচেতনতার জায়গাটাও নাই। বেশিরভাগই জানে না, তার যে সমস্যাটা হচ্ছে এর সমাধানের জন্য সে কোথায় যাবে। তার আসলে লিগ্যাল হেল্প দরকার নাকি মেন্টাল কাউন্সিলিং দরকার। নাকি তার একটা ভালো বন্ধু দরকার। নাকি তার নিজেকে এক্সপ্লোর করা দরকার, তার গ্রুমিং দরকার। আবার অনেক নারী ক্যারিয়ার কাউন্সিলিংয়ের অভাবেও ভোগে। অনেক নারীই বোঝে না যে সে এখন কী করবে। ধরুন একটা ব্যবসায় শুরু করেছে, ভাবছে আমাকে কেউ হেল্প করছে না। একজন নারীকে আসলে সমাজ কোনো হেল্প করে না। 'শান্তিবাড়ি'র চিন্তাটা সেই জায়গাতেই শুরু। আমি একটা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ নারীদের দিতে চাই। যে জায়গাটায় এসে তারা ইনফরমেশন পাবে, স্বস্তি পাবে। যেখানে এসে বুঝতে পারবে তার কী দরকার, তার কী পেতে হবে এবং সেটা সে পাবে। যেমন, আমাদের দেশের নারীদের মেন্টাল কাউন্সিলিং খুব জরুরী। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেটাকে বলি। শান্তিবাড়ি নারীদের মানসিক স্বাস্থসেবা দিবে। কাউন্সিলিং, থেরাপি, মেডিটেশন, ইয়োগার ব্যবস্থা থাকবে। সেই সাথে সবধরণের নীতিগত সহায়তা দেয়া হবে। এখানে এসে সে আইনি পরামর্শ পাবে। তার যদি কোনো অভিযোগ দায়ের করার থাকে, যে কোনো ধরণের আইনের ক্ষেত্রেই আমরা তাকে নেটওয়ার্কিংটা করে দেবো যাতে সে ভালো একজন লইয়ারের মাধ্যমে তার কাজটা করে ফেলতে পারে এবং সেই সাথে তাকে সাহস দেয়া, গ্রুমিং করা। একজন নারী কিন্তু একটা স্টেপ নিতে গেলেও চিন্তা করে, কি যে কনফিউজড থাকে! সে কারণেই গ্রুমিং করা দরকার। আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার জন্য এবং নিজে ডিসিশন নেয়ার জন্য তাকে এম্পাওয়ার করা, মোটিভেট করা প্রয়োজন। শান্তিবাড়ি এই কাজগুলোই করবে।
সেইসাথে আমরা আরেকটা কাজ করছি, যেসব বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা আছে তাদের মায়েদের অনেক রকম পরামর্শ দরকার হয় সন্তানদের গ্রুমিং করার জন্য । মায়েদের আমরা সেই সহায়তা দেবো এবং যদি তারা মনে করে যে তার সন্তানকে বাসায় গ্রুমিং করতে চায়, শান্তিবাড়ির কাউন্সিলর বাসাতেও যাবেন। বাসায় গিয়ে শিশুকে সময় দেবেন এবং মাকে সন্তানের ব্যাপারে সাহায্য করবেন। আপাতত আমরা এই সেবাগুলো নিয়ে শুরু করেছি। আমাদের আরেকটা উদ্দেশ্য নারীদের একটা কমিউনিটি গড়ে তোলা। একজন নারী আরেকজন নারীর শক্তি হবে। আমরা নারীদের একটা আড্ডার ব্যবস্থা করবো। এখানে গানের আসর, কবিতার আসর হবে। বিতর্কের ব্যবস্থা করবো। আড্ডার আসরে নারীরা নিজেদের গল্প বলবে। একজন হয়তো তার নিজের জীবনের গল্প বলল, সেটা কিন্তু আর দশটা মেয়েকে ইনস্পায়ার করে। আবার অনেক তথ্য একজন আরেকজনের সাথে শেয়ার করতে পারে। তাই আমার মনে হয় নারীদের পারস্পরিক শক্তিটাকে শেয়ারিংয়ের মধ্য দিয়ে আরও বাড়িয়ে তোলা যায়। নারীরা যত বেশি নেটওয়ার্কিং করবে, যতবেশি বন্ধু হবে একজন আরেকজনের, ততবেশি তারা শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এটাই প্রোমট করবে শান্তিবাড়ি।
ভয়েস অফ আমেরিকা: শান্তিবাড়ি কোথায় অবস্থিত?
শারমিন শামস্: এটা এখন মিরপুরে, সেকশন-৬ এ শুরু করেছি।
ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনি একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করেছিলেন ‘টু ডিফাইন এ ব্যাড গার্ল’। সেটা সম্পর্কে জানতে চাই। এ ধরণের আর কোনো কাজ করেছিলেন কি?
শারমিন শামস্: আমি আসলে ছোট ছোট কিছু কাজ করেছি। আমার ওইটা একটা বড় কাজ ছিলো। ডকুমেন্টারি নিয়ে কিছু ফ্রিল্যান্স কাজ করেছি। এখন আবার হয়তো কিছুদিনের মধ্যে করবো। আর ‘টু ডিফাইন এ ব্যাড গার্ল’ সম্ভবত ২০১৬ সালে আমি করেছি। তখন ৭১’ টিভি ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স ডে-তে দেখিয়েছিলো। কয়েকটা ফেসটিভ্যালে গিয়েছিলো। আমাদের সমাজে সবাই ভালো মেয়ের একটা সংজ্ঞা তৈরি করে। ভালো মেয়ে হতে হবে সবাইকে। ভালো মেয়ে আসলে কী জিনিস সেটাই একটু বের করার চেষ্টা করেছিলাম।
ভয়েস অফ আমেরিকা: এরকম নতুন কোনো কাজ সামনে করবার প্ল্যান আছে কী?
শারমিন শামস্ : হ্যাঁ, আমার ইচ্ছা আছে। কারণ আমি আসলে দীর্ঘদিন টেলিভিশনে কাজ করেছি। টেলিভিশন জার্নালিস্ট ছিলাম। আমার সবসময়ই ক্যামেরা নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগে। আমি করবো, তবে এখন আমার ধ্যান-জ্ঞান সবকিছু শান্তিবাড়ি। আমি শান্তিবাড়ি শুরু করেছি। আমার আরো পাঁচজন বন্ধু আছেন, আমরা ছয়জন মিলে শান্তিবাড়ির উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের এখন সবার ধ্যান-জ্ঞান সবকিছু শান্তিবাড়ি। আমি ধরে নিয়েছি, আগামী একটা বছর আমি এটাকে গড়ে তুলবো। এখন তো ছোট্ট পরিসরে শুরু করেছি, আরো বড় পরিসরে সবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করবো। আপাতত মিরপুরে শুরু করেছি, এটাকে আরো বড় জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যাতে অনেক নারী সেখানে আসতে পারেন। অনেক ধরণের সুবিধা পেতে পারে। দরকার হলে সারা দেশে এটাকে ছড়িয়ে দেবো। এটার সাথে সবার সহযোগিতা ও শুভকামনা প্রয়োজন।
ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনি তো একাধারে সাংবাদিক, লেখক, সংগঠক, চলচ্চিত্রকার, নারীবাদী আন্দোলনের একজন অগ্রদূত এবং একজন মা। সবকিছু মিলিয়ে কোন ভূমিকায় আপনি বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন?
শারমিন শামস্: আমি সবগুলোতেই স্বচ্ছন্দ। আমি যখন যে কাজটাই করি সেটা পূর্ণ মনোযোগ দিয়েই করি। নিজেকে আমি সে কাজে পুরোটাই ইনভেস্ট করি এবং সে কাজটাকে প্রাধান্য দিয়ে করি। সময় ভাগ করে নেই। এখন আমি যেমন আগামী একবছর শান্তিবাড়িকে সময় দিবো। পাশাপাশি ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরটাও কিন্তু চলছে। এ দুটোকেই আমার এখন দাঁড় করাতে হবে। তবে কোনো ভূমিকাই আসলে ছোট না। আমার সন্তান, আমার লেখকসত্ত্বা সবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার লেখালেখিও চলবে। নারীবাদ নিয়ে কিছু লেখার কাজ চলছে, সেগুলোও শেষ করতে চাই।