ঢাকার একটি কর্পোরেট অফিসের মানব সম্পদ বিভাগে চাকরি করেন রোখসানা আজিম। পিরিয়ড বা মাসিকের প্রথম দিন তলপেটে তীব্র ব্যথা হয় তার, মাথা ঘোরে। পিরিয়ডের শারীরিক অসুস্থতায় নৈমিত্তিক ছুটি থেকেই ছুটি কাটাতে হয় তাকে। অফিসে পিরিয়ডের জন্য অসুস্থতা বা ছুটির কথা বলা অসম্ভব। সেরকম পরিবেশই নেই।
আশুলিয়ার একটি পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ করেন, সাবিহা বেগম। সাবিহা অবিবাহিত, বয়স ২০ বছর। মাসিকের সময় প্রায়ই তার প্রচন্ড পেট ব্যথা হয়। কাজ করতে কষ্ট হয়। কিন্তু সে সময় বসে থাকবেন বা রেস্ট নেবেন সেই সুযোগও নেই। বললেন, কাজ না করলে সুপারভাইজারের বকা শুনতে হয়। ছুটি নিলে বেতন কাটা হয়। তাই অসুস্থতাকে গুরুত্ব দেয়ার সুযোগ নেই। সাবিহা জানালেন, তাদের কারখানায় নারী-পুরুষের আলাদা টয়লেট আছে। সাবিহা ও অন্যান্য নারী শ্রমিকরা স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড ব্যবহার করেন না। তারা গার্মেন্টসের ঝুট কাপড় সংগ্রহ করে রাখেন। সেগুলোই মাসিকের সময় ব্যবহার করে থাকেন। পিরিয়ডকালীন ছুটি সম্পর্কে তার জানা নেই। তবে বললেন, "শরীর খারাপ লাগলে ছুটি পাইলে, বেতন না কাটলে ভালো হইতো।"
বাংলাদেশে পিরিয়ড, মাসিক বা ঋতুস্রাব এখনও জনসমক্ষে অনুচ্চারিত শব্দ। যদিও পুরো বিষয়টাই নারীদেহের একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া, তবুও এ সময়ে নারীর যে শারীরিক-মানসিক অস্বস্তি, ব্যথা, ক্লান্তি বোধ হয় তা যেনো শুধুই নারীর একান্ত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাসিকের প্রথম দুইদিন সারাদিন শারীরিক যন্ত্রণা, অধিক রক্তপাত সহ্য করেই কর্মজীবী নারীরা কাজ করে যান। এ বিষয়ে পুরুষ সহকর্মী কিংবা উর্ধ্বতনকে জানানোর ক্ষেত্রে আছে সামাজিক ট্যাবু। কারণ এ বিষয়টাকে খুব গোপনীয়, ফিসফিস করে বলার বিষয় হিসেবে ধরা হয়। সমাজে মাসিকের কারণে নারীর শারীরিক সমস্যাগুলোও উপেক্ষিত। তাই পিরিয়ডকালীন অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে ছুটি নেয়াও প্রায় ক্ষেত্রেই হয় অসম্ভব ব্যাপার।
যে দেশগুলোতে আছে পিরিয়ডকালীন ছুটি
যারা মাসিকের দিনগুলিতে প্রচন্ড ব্যথায় ভোগেন তাদের জন্য কর্মক্ষেত্রে ছুটির সুবিধা চালু করছে স্পেন। গত ১৭ মে স্পেনের মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়। খসড়ায় মাসে তিন অথবা পাঁচ দিনের ছুটির প্রস্তাব করা হলেও মন্ত্রিসভা কোনো সময় বেঁধে না দেয়ায় পিরিয়ড জটিলতা যত দিন চলবে ততদিন পর্যন্ত সবেতনে ছুটি নিতে পারবেন স্পেনের নারীরা। তবে এজন্য চিকিৎসকের সনদ থাকতে হবে। এটি কার্যকর হলে পশ্চিমা দেশের নাগরিক হিসেবে প্রথম স্পেনের নারীরাই পিরিয়ডের সময় ছুটি পাবেন।
বর্তমানে জাম্বিয়ায় ও এশিয়ার কয়েকটি দেশ, যেমন- জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়ায় নারীদের পিরিয়ডকালীন ছুটির অনুমোদন আছে। এসব দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের বেতনসহ ছুটি দেয়া হয়।
ভারতে কয়েকটি প্রাইভেট কোম্পানী তাদের নারী কর্মীদের পিরিয়ডের দিনগুলোতে ছুটি গ্রহণের সুবিধা দিয়ে থাকে। ২০১৬ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্মজীবী নারীদের জন্য পিরিয়ড ছুটি আইনের ব্যাপারে আলোচনা করেছিল। তবে সেটা আলোর মুখ দেখেনি। তবে বিহার সরকারের নারী কর্মীদের জন্য এমন একটি আইন আছে। বিহার সরকারের কিছু বিভাগের নারী কর্মীরা ‘শারীরিক কারণে’ প্রতি মাসে দুদিন ছুটি পান।
পিরিয়ডকালীন ছুটির পক্ষে বাংলাদেশের নারীরা
শুরুতেই বলেছিলাম রোখসানা আজিমের কথা। তার কাছে জানতে চাই, পিরিয়ডের সময় এক/দুইদিন ছুটি পেলে কেমন লাগতো? বললেন, "কোনো প্রতিষ্ঠান যদি এ ধরণের উদ্যোগ নেয়, তাহলে সেটা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য উদাহরণস্বরূপ হবে। এমন না যে নারীরা পিরিয়ড ছুটি নেই বলে কর্মক্ষেত্রে কম আসছেন বা পেশাগত ক্ষেত্রে এটা বাঁধা হয়ে দাড়াচ্ছে । কিন্তু এই বিশেষ দিনগুলো নারীদের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই অস্বস্তিকর হয়। তাই একদিন বা দুই দিন বিশ্রাম নিতে পারলে কাজের ক্ষেত্রে নারীরা প্রণোদনা পাবে। আবার সব মাসেই যে কোনো নারীর ছুটি লাগবে সেটাও কিন্তু না। কোনো না কোনো মাসে শরীর বেশি খারাপ লাগতে পারে, এর জন্য প্রতিষ্ঠানে ছুটির ব্যবস্থা থাকলে নিশ্চিন্তে ছুটি কাটিয়ে পরের দিন যোগ দিতে কাজে পারবে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ইশরাত শাহনাজ বলেন, "ঋতুস্রাব চালাকালীন নারীর মানসিক চাপ বেশি থাকে। এ সময় হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে মানসিক অস্বস্তি হয়, মুড সুইং হয়। এ সবকিছুর প্রভাব কাজের ওপর পড়ে। বিভিন্ন স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়, শুধুমাত্র ন্যাপকিন বা প্যাড ব্যবহার করলেই এ সময় নারীরা সকল দৌড়ঝাপ করতে পারে। এখানে কিন্তু তার শারীরিক-মানসিক সমস্যাগুলোকে উপেক্ষা করা হচ্ছে যা সমাজকে ভুল বার্তা দিচ্ছে।" বাংলাদেশেও স্পেনের মতো পিরিয়ডকালীন ছুটির আইন করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী সানজানা ইসলাম বললেন, "আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইনের মাধ্যমে পিরিয়ড লিভ চালু হলে ভালো হয়। এ সময় যেহেতু ব্যথা হয়, মুড সুইং হয়, শারীরিক ও মানসিক চাপ বেশি নেয়া যায় না তাই নারীদের জন্য এ ধরণের একটি ছুটি প্রয়োজন।"
পাল্টাচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি
সমাজের বেশিরভাগ পরিবর্তন আসে তরুণ সমাজের হাত ধরে। ঠিক তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দুই উদ্যোক্তা নোশিন আঞ্জুম ও রিয়াদ হোসেন। তারা জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ঢাকার লালবাগে চালু করতে যাচ্ছেন ‘চালচিত্র’ নামের একটি কফিশপ। ছোটখাটো উদ্যোগ হলেও সাড়া ফেলেছে তাদের একটি ব্যতিক্রমী ঘোষণা। তারা তাদের কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছেন, পিরিয়ডের সময় নারী ওয়েটারদের জন্য থাকবে দুইদিনের সবেতন ছুটি। স্বত্বাধিকারীদের একজন, নোশিন আঞ্জুমের সঙ্গে কথা হয় ভয়েস অফ আমেরিকার। নোশিন জানান, তাদের ব্যবসার কর্মপরিবেশ কেমন হবে সেটা নিয়ে আলাপকালে তারা দুজন উদ্যোক্তা মিলেই এ স্বিদ্ধান্তটি নিয়েছেন। স্বিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে নোশিনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও কাজ করেছে। বললেন, "বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠানে এ ধরণের ছুটি দেয় না। যদিও বা একজন নারী কর্মী সেদিন ছুটি নেন সেটাকে তার সিক লিভ বা অন্য কোনো লিভের সাথে সমন্বয় করা হয়। আমরা এমন কর্ম পরিবেশ তৈরি করতে চাই যেখানে একজন নারীকে শারীরিক-মানসিক চাপ নিয়ে কাজ করতে হবে না। যদি একজন নারী পিরিয়ডের সময় কাজ করতে স্বস্তি বোধ না করেন তাহলে আমরা তার কাছ থেকে ভালো সার্ভিস পাবো না। কিন্তু ছুটি কাটিয়ে আসার পর তার যে উদ্যোম, মানসিক প্রশান্তি কাজ করবে সেটা প্রতিষ্ঠানের সাথে তার সম্পৃক্ততা বাড়াবে। ফলে অন্য কোথাও কিছুটা বেশি বেতন পেলেও এ সুবিধার জন্য সে আমাদের প্রতিষ্ঠানে থেকে যাওয়ার কথা ভাববে। নোশিন বলেন, "নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পিরিয়ড লিভ উল্লেখ থাকার কারণেই নারীদের কাছ থেকে সাড়া পেয়েছেন বেশি। যেসব সিভি তারা পেয়েছেন তার মধ্যে নারীর হার ৬০ শতাংশ।"
ঢাকায় অবস্থিত প্রাইভেট কোম্পানী ‘পপ অফ কালারে’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিংকার জান্নাত মিম। শুরুতে এটি নারীদের কমিউনিটি হিসেবে ফেসবুকে যাত্রা শুরু করে। পরে কোম্পানীর রূপ নেয়। কোম্পানী শুরুর সময় থেকে অর্থাৎ ২০১৮ সাল থেকে তারা নারী কর্মীদের পিরিয়ডকালীন ছুটি দিচ্ছেন। প্রথমে সেটা আনঅফিশিয়ালি ছিল কিন্তু এখন তারা এটা অফিশিয়ালি অফার করছেন। তাদের নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে তারা উল্লেখ করেছেন, নারী কর্মীদের মাসে একদিন তারা সবেতনে পিরিয়ডকালীন ছুটি দেবেন। টিংকার জান্নাত মিম বলেন, "পিরিয়ড চলাকালে প্রথম দিন বা দ্বিতীয় দিন অনেক নারীরই শরীর খারাপ থাকে। মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, দুর্বলতা থাকে। কারো কারো মুড সুইং হয়। সেক্ষেত্রে সে অফিসে আসলেও কাজ করতে পারে না, শতভাগ মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে আমরা তাদেরকে মুখে মুখেই ছুটি দিয়ে দিতাম। বলতাম বাসায় চলে যান। পরে দেখলাম, এই যে আসা যাওয়া পুরোটাই অকারণে হচ্ছে। তারচেয়ে সেদিনটা যদি তাকে ছুটি দিয়ে দেয়া যায় তাহলে পরের দিন সে পূর্ণ গতিতে কাজ করতে পারবে।
প্রথমে আমরা এটি খুব আনঅফিসিয়ালি শুরু করেছিলাম। লোকজনের সামনে বলতাম না, অস্বস্তি হতো, কে কিভাবে নেয়। পরে ভাবলাম, এটা সবাইকে জানাতে হবে। আমাদের দেখা দেখি যদি একটিও বড় কোম্পানী এগিয়ে আসে তাহলে তাদের দেখাদেখি অন্য কোম্পানীগুলো এগিয়ে আসবে।"
টিংকার জান্নাত নারীবান্ধব অফিস করতে চান। অফিসে তারা জরুরী প্রয়োজনের জন্য স্যনিটারী ন্যাপকিন রাখেন। বড় পরিসরে অফিস নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। তখন ভেন্ডিং মেশিন বসাতে চান।
ভাঙ্গতে হবে ট্যাবু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সানজানা ইসলাম বললেন, "পিরিয়ড নিয়ে জনসমক্ষে কথা বলতে এখনো অনেকেই অস্বস্তি বোধ করে। ফার্মেসি থেকে ন্যাপকিন কেনার ক্ষেত্রেও প্রায় সময় আমরা অস্বস্তিতে পড়ি এমনকি বিক্রেতারাও অস্তস্তি বোধ করেন। ঠিক ভাবে শোনেনও না কোনটা চাচ্ছি। তাড়াহুড়ো করে কাগজে মুড়িয়ে একটা দিয়ে দেন। এই সংকোচগুলো ভাঙ্গা উচিত।"
পপ অফ কালারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিংকার জান্নাত মনে করেন, এখন পুরুষরাও সচেতন হচ্ছে। পিরিয়ডের ব্যথা যে কত কঠিন সেটা পুরুষরাও উপলব্ধি করতে পারছে। তাই নারী সহকর্মীকে মাসে একদিন বা দুইদিন এই ছুটি দিলে কোনো পুরুষ সহকর্মী আপত্তি করবেন না তার বিশ্বাস। বললেন, "একটা ট্যাবু ভাঙতে শুরুর দিকে তো কিছু ঝামেলা হয়। কিন্তু প্র্যাকটিসটা শুরু করতে পারলে এই ছুটিটাও একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে আসবে।"
স্বস্তি দিচ্ছে ভেন্ডিং মেশিন
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি স্থানে এসিআই গ্রুপের ফ্রিডম ব্র্যান্ডের স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভেন্ডিং মেশিন বসানো হয়। বর্তমানে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বিএএফ শাহীন কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভেন্ডিং মেশিন বসানো হয়েছে। মাত্র ১০ টাকা দিয়ে নারী শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে যেকোনো সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে নিতে পারেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সানজানা ইসলাম বললেন, "ভেন্ডিং মেশিন থেকে কিনলে আমাদের কিছুটা সাশ্রয় হয়। আমরা যখন প্যাকেট কিনি তাতে প্রতি পিস ১২/১৩ টাকা করে পড়ে। আর মেশিন থেকে আমরা ১০টাকায় নিতে পারি। অল্প দামে খুচরা প্যাড পাওয়া যাওয়ায় এটা মেয়েরা বেশ ব্যবহার করছে। আর জরুরী প্রয়োজনে এর ওর কাছে চাইতেও হচ্ছে না। অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে এই ভেন্ডিং মেশিন।"
বাংলাদেশে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না, সম্প্রতি তৈরি পোশাক শিল্পের নারী কর্মীদের জন্য পাঁচটি কারখানায় স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার ভেন্ডিং মেশিন স্থাপন করেছে বাংলাদেশে মোবাইলে আর্থিক লেনদেনের সেবা প্রদানকারী সংস্থা বিকাশ। এর মধ্যে আছে সাভারের আশুলিয়া, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের কয়েকটি কারখানা।