নরসিংদী রেল ষ্টেশনে ‘পোশাকে আপত্তি’ তুলে এক তরুণীকে হেনস্তার ঘটনার প্রদিবাদে ‘পছন্দমতো পোশাক’ পরে শুক্রবার ঢাকা থেকে নরসিংদী রেলস্টেশনে গিয়েছিলেন ২০ তরুণ-তরুণী। প্রতিবাদ জানাতে তরুণীরা পশ্চিমা পোশাক পরিহিত অবস্থায় নরসিংদী রেল স্টেশনে অবস্থান করেছেন। তাদের এই প্রতিবাদ বেশ আলোচিত হয়েছে। নরসিংদী রেলস্টেশনের মাস্টার এ টি এম মুছা মনে করেন তাদের এই প্রতিবাদের ফলে এমন ঘটনার বিপক্ষে একটি কঠোর বার্তা যাবে।
যা ঘটেছিল নরসিংদী রেল স্টেশনে
গত ১৮ মে নরসিংদী রেলস্টেশনে হেনস্তার শিকার হন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। দুই বন্ধুর সঙ্গে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ঢাকাগামী ঢাকা মেইল ট্রেনের অপেক্ষা করছিলেন ওই তরুণী। তার পরনে ছিল জিন্স ও টপ। অভিযোগ এ সময় স্টেশনে মধ্যবয়সী এক নারী ওই তরুণীকে জিজ্ঞাসা করেন, "এটা কী পোশাক পরেছ তুমি?" তরুণীও পাল্টা প্রশ্ন করেন, "আপনার তাতে কী সমস্যা হচ্ছে?" এ নিয়ে বাকবিতন্ডা শুরু হয়। এর মধ্যে সেই বিতর্কে যোগ দেন স্টেশনে অবস্থানরত অন্য কয়েকজন ব্যক্তি। এমন ঘটনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, ওই তরুণীকে ঘিরে রেখেছে একদল ব্যক্তি। এর মধ্যেই এক নারী উত্তেজিত অবস্থায় কথা বলছেন। বয়স্ক এক ব্যক্তিও তরুণীর পোশাক নিয়ে কথা বলছেন। একপর্যায়ে ওই তরুণী সেখান থেকে চলে যেতে উদ্যত হলে ওই নারী দৌড়ে তাকে ধরে ফেলেন। এ সময় অশ্লীল গালিগালাজ করতে করতে তার পোশাক ধরে টান দেন ওই নারী। কোনো রকমে নিজেকে সামলে দৌড়ে স্টেশন মাস্টারের কক্ষে আশ্রয় নেন ওই তরুণী। পরে ভুক্তভোগী তরুণী জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-তে ফোন দিলে নরসিংদী মডেল থানার পুলিশ রেলস্টেশনে এসে তাদের ঢাকাগামী ট্রেনে তুলে দেয়।
এই ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। হেনস্তাকারীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন অনেকে।
ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “সারাবিশ্ব যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের নারীদের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের নারীরা নানাক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে সেই সময়ে পোশাকের আপত্তি তুলে এক তরুণীকে হেনস্তার ঘটনা সমাজের পিছিয়ে থাকা বা পশ্চাৎপদতার নজির বলেই মনে করি। পোশাকের ত্রুটির অভিযোগ করে প্রকাশ্যে রেল ষ্টেশনের মতো একটি জায়গায় নারীকে অবমাননাকর পরিস্থিতির মুখোমুখি কোনো সুস্থ সমাজের লক্ষণ হতে পারে না। আমার মনে হয়, আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক যে উন্নয়ন হয়েছে, তার পাশাপাশি এখন মানুষের মানবিকতার এবং অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের বিষয়গুলোরও উন্নতি করতে হবে। ”
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরিন বলেন, “নরসিংদীতে যে ঘটনা ঘটেছে তা পৃথক কোনও ঘটনা বলে মনে করি না। প্রায় প্রতিদিনই আমরা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই, তখনই পাশে হাঁটতে থাকা অনেক মানুষ বিড়-বিড় করে অনেক কিছু বলতে থাকেন। আমি যখন হেঁটে হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, আমার সবচেয়ে বেশি শোনা কথাগুলো হলো, ‘বুকের ওড়না ঠিক কইরা চলাফেরা করেন, মাথায় কাপড় দেন, বাজারে কাপড়ের অভাব নাকি, ফুলহাতা জামা পরা যায় না?’ এগুলো যে শুধু পুরুষরা বলছে তা কিন্তু নয়, অনেক নারীও তা বলছেন। নরসিংদীতে যে ঘটনা আমরা দেখলাম সেখানেও তা-ই ঘটেছে।” নরসিংদীর ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই ভিডিওর কমেন্ট বক্সে এর পক্ষে এবং বিপক্ষে নানা ধরনের হাজার হাজার মন্তব্য দেখা গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই মন্তব্যগুলোর বেশিরভাগই নারীবিদ্বেষী এবং নারী কেমন পোশাক পরবে সেই বিষয়ে উপদেশমূলক।” এ থেকে নারীদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার একটি প্রবণতাও রয়েছে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।
জোবাইদা নাসরিন বলেন, "একজন মানুষ কী ধরনের পোশাক পরবে সেটি নির্ভর করবে তার নিজস্ব রুচি, অর্থনৈতিক সামর্থ্য এবং স্বাচ্ছন্দ্যের ওপর। এখন এই পোশাক নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে আসলে নারীকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া হচ্ছে।"
প্রতিবাদ জানাতে পশ্চিমা পোশাক
নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাকের জন্য তরুণীকে হেনস্তার প্রতিবাদ জানাতে নিজেদের ‘পছন্দমতো পোশাক’ পরে স্টেশনটিতে গিয়েছেন ২০ তরুণ-তরুণী। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার সকালে ঢাকা থেকে নরসিংদীগামী একটি ট্রেনে তারা সেখানে যান। সেখানে তারা পশ্চিমা পোশাক পরে অবস্থান করেন। তাদের এই যাত্রার নাম ‘অহিংস অগ্নিযাত্রা’। তাদের এ দলে শিল্পী, শিক্ষক, সংগঠক, নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, আলোকচিত্রী, গবেষক, উন্নয়নকর্মী ও প্রকৌশলীরা ছিলেন। এই দলে ছিলেন তৃষিয়া, সুরভী, অ্যানি, আনোয়ার, অর্ণব, নুভা, মম, অপরাজিতা, সামিহা, সানজানা, স্মিতা, লক্ষ্মী, অন্তরা, মিশু, প্রমি, জিসা, নিশা, বিজু, ইফফাত ও নীল।
এই দলটির সমন্বয়কদের একজন থিয়েটারকর্মী সুরভী রায়। ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, “আমরা নরসিংদী রেলস্টেশন ও এখানকার মানুষদের দেখতে গিয়েছিলাম। আমরা মূলত ওই ঘটনার একটি প্রতিবাদ করতেই গিয়েছিলাম। যারা গিয়েছি, তারা চেষ্টা করেছি কিছুটা ওয়েস্টার্ন পোষাক পরতে। যে পোশাক পরার জন্য এক তরুণীকে ওখানে বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সেই ধরনের পোশাক পরেই আমরা গিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা সংখ্যায় অনেক ছিলাম, আর এখন দেশব্যাপী এই ঘটনাটি আলোচিত হওয়ায় কেউ আমাদের টিজ বা কোনো রকম হয়রানি করেনি। আমরা সেখানকার রেলওয়ে পুলিশ, ষ্টেশন মাস্টার, দোকানদার, হকার, পথশিশুদের সাথে কথা বলেছি। সবাইকে বুঝাতে চেষ্টা করেছি, নারীর পোশাক তার নিজের পছন্দেও বিষয়।”
তাদের এই ‘পছন্দমতো পোশাকে’ নরসিংদীযাত্রাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন, জানতে চাইলে ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, “আমরা ওখানকার বাসিন্দাদের সাথে মানবিক যোগাযোগ স্থাপন করতে চেয়েছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, শান্তিপূর্ণভাবে জনপরিসরে শরীর ও পোশাকের স্বাধীনতার জায়গাটা প্রতিষ্ঠা করা।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
নরসিংদী রেলস্টেশনের মাস্টার এ টি এম মুছা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “ওই দিনের (১৮ মে) ঘটনাটি অনাকাঙ্খিত। এই স্টেশনে আমি আর কখনো এমন পরিস্থিতির মুখে পড়িনি। সেদিনের ঘটনার প্রেক্ষিতে ঢাকা থেকে তরুণ-তরুণীদের একটি দল ট্রেনে করে আমাদের স্টেশনে এসেছিল। আমার সঙ্গে তারা বসেছিল, জানতে চেয়েছিল ওই দিনের বিস্তারিত। আমিও তাদের ওই ঘটনার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়েছি। তাদের এই ঢাকা থেকে নরসিংদী আসার ফলে এমন ঘটনার বিপক্ষে একটি কঠোর বার্তা যাবে বলেই আমি মনে করি। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বেশ দ্রুততার সাথে কাজ করে যাচ্ছে।”
নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইমায়েদুল জাহেদী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “তরুণীকে হেনস্তার অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ও ৩০ ধারা এবং দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩২৩ ও ৫০৬ ধারায় মামলা করা হয়েছে। মামলায় মো. ইসমাইল ও শিলা আক্তারের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও একজন নারী ও ৮ থেকে ১০ জন পুরুষকে আসামি করা হয়। এরই মধ্যে ইসমাইলকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তরুণীকে গালিগালাজ, মারধর, শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলার আসামি শিলা আক্তারকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। তবে তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।”
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “নরসিংদীর রেল স্টেশনে যে ঘটনাটি ঘটেছে তা খুবই দুঃখজনক। কেবল এই ঘটনাটি দিয়েই কিন্তু নরসিংদী জেলাকে বিবেচনা করা যাবে না। আমি আমার কথা যদি বলি, আমার এখানে দায়িত্ব গ্রহণের পরে এমন ঘটনা এটিই প্রথম ঘটলো। এই ঘটনার পর নরসিংদী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। পাশাপাশি জেলার সকল ইউএনওদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যাতে এমন ঘটনা ভবিষ্যতে না ঘটে, তা নিশ্চিতে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।”
নারীর সামাজিক নিরপত্তা নিশ্চিতে জেলায় কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে ভয়েস অফ আমেরিকাকে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক বলেন, “জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে এমনিতেই নিয়মিত সভা করা হয়। প্রতিমাসেই এটা জেলার অন্যান্য সংস্থার সাথে আলোচনা করা হয় ও করণীয় নির্ধারণ করা হয়। নারীর প্রতি সহিংসতা, বাল্য বিবাহ, যৌন হয়রানি, যৌতুক, ইভটিজিং বন্ধ থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে জেলার অনান্য প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সাথে আলোচনা হয়। এই ঘটনার পরে এইবার জেলার প্রতিটি শাখায় আলাদা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যে কোনো মূল্যে নারীর অবমাননা হয়, নারী ঝুঁকি বা হুমকির মুখে পড়েন, এমন কাজ বন্ধে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নরসিংদী জেলাকে নিয়ে যেন কোনো ভুল বার্তা না যায়, সে লক্ষ্যে নারীর জন্য নিরাপদ করতে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।”