নজরুলের ভাবনায় ও সৃষ্টিতে নারী

কাজী নজরুল ইসলাম

“বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা’ গানটি সমগ্র বিশ্বের নারী জাতির ‘জাতীয় গান’ বলে আমি মনে করি। এই গানের সঞ্চারী অংশে আছে, ‘ধু ধু জ্বলে ওঠো ধূমায়িত অগ্নি/ জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নি!’—এই যে সকলকে জেগে উঠতে বলা হচ্ছে তা ঘুম থেকে জেগে ওঠা নয়, বরং নারীর চিন্তা—চেতনায়, কর্মে, মননে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে জেগে উঠবার কথাই কবি বলেছেন। প্রায় শত বর্ষ আগে কাজী নজরুল লিখে গেছেন, তবু তাঁর এই ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা’ গানটিকে অতিক্রম করতে পারে এমন কোনো গান আর সৃষ্টি হয়নি। তাঁর ‘নারী’ কবিতাকে অতিক্রম করতে পারে এমন কোনো কবিতাও আর হয়নি।”— বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী, গবেষক এবং ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. লীনা তাপসী খান ভয়েস অফ আমেরিকার সাথে কাজী নজরুল ইসলামের চিন্তায় ও লেখায় নারীর মূল্যায়ন নিয়ে আলাপকালে কথাগুলো বলেন।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়কর প্রতিভার নাম। ২৫ মে ১৮৯৯ খ্রীস্টাব্দ, (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী। নজরুলের সাহিত্যে, সৃষ্টিকর্মে নারীর উপস্থিতি অত্যন্ত বর্ণিল ও দৃঢ়। নারীকে তিনি প্রেমের, পূজার, ভক্তির দেবীর আসনে আসীন করেছেন। ঠিক যে সময়টাতে সমাজে নারী ছিলো কেবল ভোগ ও বঞ্চনার বস্তু, নারীকে মানুষের মর্যাদা দেয়া হতো না সেই সময়টাতেই কবির কলম ঝনঝনিয়ে বেজেছিলো। তিনি লিখেছিলেন—

সাম্যের গান গাই,

আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোন ভেদাভেদ নাই

বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যানকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”

(নারী, ‘সাম্যবাদী’ নজরুল রচনাবলী, ১ম খন্ড, পৃ ২৪১)

নারীকেও তিনি রুখে দাঁড়াতে বলেছেন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে। মাথা তুলে বাঁচতে বলেছেন। নিষ্প্রাণ মাটির ঢেলা থেকে তাকে মানুষরূপে জেগে উঠতে বলেছেন। তাই ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা শুরু করেছেন এভাবে—

আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।

দেব-শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,

ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?

নজরুলের সাহিত্যে ও চিন্তায় নারীমুক্তি নিয়ে কথা বলেছিলাম কয়েকজন লেখক ও গবেষকের সঙ্গে। ভয়েস অফ আমেরিকাকে তারা বলেছেন নজরুলের চিন্তায় ও সাহিত্যকর্মে নারীর মূল্যায়ন নিয়ে তাদের বিশ্লেষণ—

নারীর মূল্যায়ন ও নারী-পুরুষের সমতা

নজরুলের সৃষ্টিকর্মে নারী মুক্তি ও নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে ড. লীনা তাপসী খান বলেন, নারী এবং পুরুষের যে বৈষম্য তা অনেক প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। নারী মুক্তি বা স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা অনেক যুগের। ইসলাম ধর্মের মহানবী (সা.) এর যে বিদায়ী ভাষণ সেখানে নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা, সম্মান ও অধিকারকে নিশ্চিত করার জন্য মুসলমানদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। তারপরেও নারীর স্বাধীনতার বিষয়টি অগ্রাহ্য করা, তাদেরকে দুর্বল ভাবা, বোঝা ভাবা এই বিষয়গুলো আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চার অভাবেই হয়ে থাকে। কারণ সবার আগে মানুষ। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করতে কোনো ধর্মেই বলা হয়নি। এত ধর্মীয় অনুশাসন থাকার পরেও পুরুষশাসিত সমাজের কারণে এই বৈষম্য যুগে যুগে হয়ে এসেছে।

আঠার শতকে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করা, নারী শিক্ষার সূচনা করার ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অগ্রনী ভুমিকা পালন করেছিলেন। যার ফলে নারীরা শিক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পেরেছিলেন। এরপর কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গানে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে যুক্ত করলেন নারীমুক্তি ও জাগরণের কথা। কাজী নজরুল ইসলামের স্বকন্ঠে প্রথম রেকর্ড করা হয়েছিলো ‘নারী’ কবিতাটি। তাই বলা যায়, তাঁর ধ্যান ধারণার মধ্যে নারী মুক্তির বিষয়টি কিন্তু খুব জোরালোভাবে ছিল এবং সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে নারীর যে একটা জোরালো ভূমিকা রয়েছে তা কাজী নজরুল ইসলামের কলমে আরো সোচ্চার হয়েছে। সনাতন ধর্মে যে দশভূজা দেবীর কথা রয়েছে সেটা আসলে নারী শক্তিকে প্রতীকী অর্থে দেখানো হয়েছে। একজন নারী তার ঘরে-বাইরে কাজ, সন্তান প্রতিপালনে যে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলছেন সেটাই আসলে দশভূজার কাজ। নারীর এই বহুমুখী কাজের যে শক্তি, সেটাকে সমাজ যুগের পর যুগ উপেক্ষা করে চলেছে। এই বলয়কে ভাঙ্গতে চেয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর গান, কবিতা, উপন্যাস এবং গল্পে নারী চরিত্রের প্রগতিশীলতা দেখিয়েছেন। তিনি যেভাবে অগ্রগামী চিন্তা ও চেতনায় স্বাক্ষর রেখে গেছেন অন্য কোনো কবির সাহিত্যে, গানে আমরা এভাবে কখনও পাইনি।

লেখক, গবেষক ড.সাইমন জাকারিয়া বলেন, কবি কাজী নজরুলের সৃষ্টি বা সাহিত্য কর্মের বিচারে নারী সম্পর্কে তাঁর যে ধারণা সেটা তাঁর ‘নারী’ কবিতায় তীব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে।‘বিদ্রোহী’ কবিতাতেও নারী পুরুষের সাম্যবাদ নিয়ে তাঁর চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। নজরুল তাঁর ছোটবেলা থেকেই দেখেছিলেন, সমাজে নারীর স্থান পুরুষের স্থানের চাইতে অনেক নিচে। নারীকে হেয় দৃষ্টিতে দেখা এবং অবমূল্যায়ন করতে দেখেছেন। সে জায়গা থেকেই নজরুলের নারী কবিতার ভাবনা, পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি হচ্ছে তাতে নারী ও পুরুষের কৃতিত্ব সমান। নজরুল যে সমাজ ব্যবস্থার দিকে তাকিয়েই এটি লিখেছিলেন, বর্তমান সমাজেও তার একই প্রতিফলন দেখতে পাই। নজরুল শ্যামা সাধনা করতেন। নজরুলের শ্যামা সংগীতে আমরা দেখি, সেখানে নজরুল নারীকে একটি উচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি শ্যামা সংগীতের মাধ্যমে যেটা প্রকাশ করতে চেয়েছেন, সেটা হলো নারীকে মর্যাদা দিতে হবে। নারী পৃথিবীতে সৃষ্টির আসনে আছে। সে পৃথিবীতে ন্যায়-নীতি, সভ্যতা, শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছুর মূলে রয়েছে। নজরুলের ‘নারী’ কবিতার মধ্যেও সেটি আছে। জ্ঞানের দেবী, বিদ্যার দেবী, লক্ষ্মী রূপে তিনি নারীকে দেখিয়েছেন। কিন্তু আমরা আমাদের বাস্তব জীবনে নারীকে সেই অবস্থান দিচ্ছি না।

বাংলা ভাষার অন্যতম কথাসাহিত্যিক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন বলেন, ত্রিশের দশকে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সব জায়গায় নারীর অবদান ছিলো। নারীকে তার যোগ্যতার মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করা হতো না। সারা বিশ্বজুড়েই নারীর অবদমন ছিলো। নারী তার অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্নভাবে লড়াই করেছে। এই অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯১০ সালে ইউরোপে ১৭টি দেশের নারী নেতৃবৃন্দ মিলে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ প্রতিষ্ঠা করে। সেরকম একটি সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম যেভাবে নারীর মাহাত্মকে বড়ো করে দেখেছেন সেটা আমার চেতনার একটি বড় জায়গা জুড়ে আছে। আমি নজরুলকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি। নারী মুক্তির ক্ষেত্রে নজরুলের সাহিত্যপাঠ এখনো আমাদের জীবনে খুব প্রাসঙ্গিক। আমি আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই—নজরুল অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ একজন অসাধারণ কবি ছিলেন। তিনি হামদ নাত যেমন লিখেছেন তেমনি শ্যামা সংগীতও লিখেছেন। আমাদের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এসব নিয়ে নানা কথা বলে। কিন্তু নজরুল কখনো এসব নিয়ে ভাবেননি। তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেছেন এবং সকল ধর্ম—বর্ণের উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে নজরুলের নারী ভাবনার বাস্তবায়ন ও নজরুল চর্চার অবস্থা

এ প্রসঙ্গে ড. সাইমন জাকারিয়া বলেন, নজরুল তাঁর সকল সৃষ্টিকর্মের ভেতর দিয়ে চেয়েছিলেন, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পাক এবং সেটা শুধু তাঁর সময়কালে নয়, একটি চিরন্তন জায়গা থেকেই সেটি তিনি চেয়েছিলেন। তিনি প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে তাঁর সময়কাল পর্যন্ত সময়কে উপলব্ধি করেই নারীর মূল্যায়নের কথা লিখেছিলেন। ভবিষ্যতে নারীরা যাতে ওই অবস্থানে যেতে পারে, সমাজ যেনো নারীকে মর্যাদার আসনটি দেয় সেই লক্ষ্যে তিনি লিখে গিয়েছেন। সমসাময়িককালে নজরুলের সাহিত্য, গান, কবিতা, তার সকল সাহিত্যকর্মের চর্চা বেশি হলে এবং তাঁর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যদি বেশি হয় তবেই নজরুল যা আকাঙ্খা করেছিলেন, সেই মর্যাদা আমরা নারীকে দিতে পারবো। নারীও তাঁর অধিকার অর্জন করতে পারবে।

ড. লীনা তাপসী খানের মতে, কাজী নজরুল ইসলামের এই যে নারী মূল্যায়নের বিষয়টি তার দশ ভাগের এক ভাগও আমরা ধারণ করতে পারিনি। যদি তা পারতাম তাহলে আমাদের চিন্তা চেতনায় এতো অন্ধত্ব, এতো এক চোখা মনোভাব থাকতো না। জাতি হিসেবে আমরা আরো এগিয়ে যেতে পারতাম। নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থানের জায়গায় আমরা এগিয়েছি অনেকটাই কিন্তু মূল্যবোধের ক্ষেত্রে সেই প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়নি। কাজী নজরুল ইসলাম নারীকে যেভাবে দেখেছেন, সেভাবে একজন পুরুষ, নারীকে এখনো মূল্যায়ন করে না। সেই সম্মানের স্থান আজও তৈরি হয়নি। আমরা ধন্য তাঁকে জাতীয় কবি হিসেবে পেয়ে এবং বাংলাদেশ সরকার তাঁকে যথাযথ মূল্যায়ন করেছে। তবে আমাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে, গণমাধ্যম, প্রাতিষ্ঠানিক জায়গাগুলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় যদি আর একটু নজরুল চর্চা হয়, তাঁর চিন্তা চেতনার চর্চা হয় তাহলে আমরা আমাদের অন্ধত্বের জায়গা থেকে কিছুটা হলেও বেরিয়ে এসে সাম্যবাদকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবো।

নারী দিবসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন গণমাধ্যম শিশুকিশোরদের জন্য কাজী নজরুল ইসলামের নারী কবিতাটির আবৃত্তি কিংবা ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা গানটির একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারে। যদি পাঁচশত শিক্ষার্থীও তাতে অংশ নেয়, আরও পাঁচশত শিক্ষার্থী তো সেটা শুনবে, আত্মস্থ করবে। এভাবে নজরুল চর্চা বাড়বে, নজরুলের সাম্যচিন্তা, প্রগতিশীলতা, নারী ভাবনা আমাদের ভেতরেও তৈরি হবে।

খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, নারীর প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের যে ভাবনা ছিলো তা এখনকার দিনে ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। নারীকে তিনি কত রূপেই না কল্পনা করেছেন। কখনো দেবী রূপে, কখনো মানবী রূপে, নারীকে তিনি সবকিছুর উপরে স্থান দিতে চেয়েছিলেন এবং চেষ্টা করেছিলেন তাঁর গানে, কবিতায়, কথকতায় নারীকে অত্যন্ত মর্যাদার আসনে স্থাপন করতে। তিনি নারীর যে জয়যাত্রা, যে উন্নতি দেখতে চেয়েছিলেন এখনকার দিনে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। সমাজের সর্বস্তরে আমরা যেভাবে নারীকে পাচ্ছি, নারী তার স্বকীয় প্রতিভায় নিজেকে সমাজে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করছে তাতে আমরা কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার কিছুটা বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছি।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের মতে, নজরুল চর্চার মাধ্যমেই এই প্রজন্মের ভেতরে নারীকে মর্যাদা দান শিক্ষা দেয়া ও নারী দমন বন্ধ করা সম্ভব। নারীরাও তার শক্তি ও অধিকারকে চিনে নিতে হবে। তাইতো নজরুল তাঁর নারী কবিতায় বলে গেছেন,

আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,

আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!

চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায় মল,

মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও—শিকল!

যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ,

দূর ক’রে দাও দাসীর চিহ্ন, যেথা যত আভরণ!