মেয়েদের দেখা মেলে না ঢাকার খেলার মাঠগুলোতে

এনজিওকর্মী মোহাম্মদ ফয়সাল খন্দকার সোহান মেয়েকে নিয়ে ঢাকার শ্যামলী পার্ক মাঠে এসে প্রবেশপথ পাচ্ছেন না। সব গেট বন্ধ দেখে হতাশ। তার হতাশা আরও বাড়ল যখন দেখলেন মেয়েদের জন্য মাঠের সংরক্ষিত এলাকা ‘নারী অঙ্গনে’ প্রবেশের মুখে একাধিক তালা। বাধ্য হয়ে পাশের আরেকটি মাঠের দিকে পা বাড়ালেন। ক্লাবমাঠ বলে পরিচিত এই মাঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "একটু ভালো পরিবেশের অভাবে তার মতো অনেক অভিভাবকই মেয়েদের নিয়ে মাঠে আসতে পারেন না।"

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার মাঠ ঘুরে এই প্রতিবেদক দেখেছেন ছেলেরা হইহুল্লোড় করে খেলায় মেতে থাকলেও কোনো মেয়ে নেই। শহরটির উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়র ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন, মেয়েদের মাঠে আসার সুযোগ করে দিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বাড়ানো হচ্ছে পার্ক এবং মাঠের সংখ্যা। অভিভাবকেরা বলছেন, আলাদা মাঠ না হলে তারা মেয়ে সন্তানকে খেলতে পাঠানোর কথা ভাবতেই পারেন না।

মেয়েদের জন্য মাঠ নেই

প্রায় আড়াই কোটির মানুষের শহর ঢাকায় ফাঁকা জায়গা মানে ‘সোনার হরিণ’। সেই ‘হরিণ’ মেয়েদের কাছে কোনোদিন আলাদাভাবে খেলার মাঠ হয়ে ধরা দেয়নি!

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন, কয়েক বছর আগে তারা ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের খেলার মাঠের অবস্থা, ঘাটতি ও চাহিদা পর্যালোচনামূলক একটি গবেষণা করেন। সেই প্রতিবেদনে তারা বলেন, দুই সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন অঞ্চলে বসবাসরত প্রায় আড়াই কোটি মানুষের জন্য কমপক্ষে দুই হাজার পার্ক এবং চার হাজার খোলা মাঠ প্রয়োজন। তাদের ক্ষেত্রের পরিমাণ ন্যূনতম এক একর হওয়া উচিত।

তবে সিটি কর্পোরেশন দুটির অধীনে কেবল ২৩৫টি খেলার মাঠ রয়েছে এবং এর মধ্যে ১৪১টিই প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ। এর ৪২টি খেলার মাঠ সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত। এছাড়া ১৭টি সরকারি মাঠ, ২৪টি আবাসিক কলোনি মাঠ এবং ১২টি ঈদগাহ রয়েছে। এর মধ্যে মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো খেলার মাঠ নেই। ‘ছেলেদের মাঠের’ মধ্যে মাত্র সাত শতাংশ মাঠে মেয়েরা খেলতে পারে।

আলাদা মাঠ চান অনেক অভিভাবক

ধানমন্ডি মাঠে ছেলেকে নিয়ে আসলেও মেয়েকে বাসায় রেখে এসেছেন শিক্ষক রিভানা ইয়াসমীন। এর কারণ জানতে চাইলে ভয়েস অফ আমেরিকা বলেন, ‘‘আমরা গার্ডিয়ানরা ইনসিকিউরড ফিল করি। এই মাঠে ছেলেরা খেলছে। এখানে একসঙ্গে খেলা তো সম্ভব না। আমরা নিজেরাও যেতে দিব না। এরকম একটা ব্যাপার। মেয়েদের জন্য সব মা-বাবাই একটা সিকিউরড প্লেস চায়। আমি চাই না এই ধরনের সিচুয়েশনে আমার মেয়ে খেলুক।’’

অভিভাবক মোহাম্মদ আকতার হোসেন খান বলেন, ‘‘মেয়েদের কোনো মাঠ নেই। তাদের খেলার কোনো পরিবেশও নেই। মেয়েদের জন্য আলাদা মাঠ হলে ভালো হয়। খেলার পরিবেশও থাকতে হবে সেখানে।’’

৫৩ বছর বয়সী এই বেসরকারি চাকুরীজীবী বলেন, "আমার বাচ্চা যদি মেয়ে হয়, তাহলে সব ছেলের মধ্যে তো পাঠাবো না। খেলার জন্য মেয়েরা যেমন আলাদা কোচিং করে, এইটা কিন্তু সাধারণ মাঠগুলোতে নেই। ছেলেদের শুধু ব্যবস্থা আছে। এ কারণে মেয়েদের জন্য আলাদা মাঠ, আলাদা পরিবেশ থাকতে হবে।’’

মোহাম্মদ পিন্টু ৪৩ বছর বয়সেও ছেলের সঙ্গে মাঠে এসেছেন ফুটবল খেলতে। সেন্টারব্যাকে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষ দলে খেলা ছেলের গোল ঠেকাচ্ছিলেন তিনি। খেলা থেকে দুই মিনিটের বিরতি নিয়ে তুলে ধরলেন মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডের মাঠের পরিবেশ, ‘‘মাঠগুলোতে মেয়েদের দেখাই যায় না। কারণ হলো পরিবেশ। আমরা যদি পরিবেশটা ভালো করতে পারি, তাহলে মেয়েরা মাঠে আসবে।’’

‘‘মাঠগুলোতে মেয়েদের দেখাই যায় না। কারণ হলো পরিবেশ। আমরা যদি পরিবেশটা ভালো করতে পারি, তাহলে মেয়েরা মাঠে আসবে।’’

‘‘আমরা যেভাবে মেয়েদের অবহেলা করি, সেটা না করে যদি মেয়েদের সাপোর্ট দেই সেক্ষেত্রে মেয়েরা অবশ্যই মাঠে আসবে এবং তারা ছেলেদের থেকে ভালো করবে।’’

‘নারী অঙ্গনে’ নারী নেই

ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েক বছরে মাঠের পরিবেশে অনেক পরিবর্তন আসলেও মেয়েদের ভাগ্য সেই আগের মতোই থেকে গেছে। সিটি করপোরেশনের অধীনে থাকা মাঠগুলোয় বসেছে শক্তিশালী লাইট। চারদিকে প্রাচীর দিয়ে হাঁটার জন্য রাখা হয়েছে আলাদা পথ। কয়েকটি মাঠের একদিকে সাইনবোর্ডে ‘নারী অঙ্গন’ লিখে মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনের শুরুতে যে মাঠটির কথা বলা হয়েছে সেটি তেমনই একটি মাঠ। মাঠের ভেতরে কয়েক জন তরুণকে খেলার প্রস্তুতি নিতে দেখা গেলেও ওই ‘নারী অঙ্গন’ একদম সুনসান। মাঠের এক নিরাপত্তাকর্মী জানালেন, বিকেল পাঁচটার দিকে ঘণ্টাখানেক মাঠ খোলা হয়। তখন কিছু মেয়ে আসে। তবে তারা খেলে না। হাঁটাহাঁটি করে বাসায় ফিরে যায়। মাঠটি ২৬ মার্চ পুরোদমে উন্মুক্ত করা হবে। তখন মানুষের আনাগোনা বাড়তে পারে বলে ধারণা তার।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম মেয়েদের মাঠে না আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘বড় কারণ হলো মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো মাঠ নেই। যে মাঠগুলোতে খেলা হয়, সেগুলো ছেলেদের জন্য খুব একটা আইডিয়াল না। মাঠই কমে গেছে।’

ঢাকার মানুষের পারিবারিক অবস্থার কথা উল্লেখ করে মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন সংগঠকদের অন্যতম এই ব্যক্তিত্ব ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "ঢাকা শহরে মেয়েদের খেলাটাকে মেনে নিতে অনেক ধরনের সমস্যা আছে। ঢাকার বাইরেই বরং মেয়েদের খেলাধুলাকে গ্রহণ করা হয়। ঢাকা শহরে মেয়েদের ঘেরাটোপের মধ্যেই রাখা হয়।’’

লক্ষ্মীবাজার খেলার মাঠে নিয়মিত জগিং করতে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহসিনা তাবাসসুম পুষ্প। কিন্তু কখনো খেলার কথা ভাবেন না। কেন? জবাব তার এমন, ‘‘আমি এখানে হাঁটতে আসলেও খেলার কথা কখনো ভাবিনি। যারা খেলছে তারা সবাই ছেলে।’’

‘‘আমি এখানে হাঁটতে আসলেও খেলার কথা কখনো ভাবিনি। যারা খেলছে তারা সবাই ছেলে।’’

‘‘আমাদের আর্থ-সামাজিক স্ট্রাকচারটাই এমন। ফ্যামিলি থেকে আমরা মেয়েদের ওভাবে অ্যাপ্রিশিয়েট করি না। এখানে দশটা ছেলে খেলছে। একটা মেয়ে যদি নিজে থেকে আসে তাহলে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে না।’’

পেশাদার ক্রিকেটারের মিশ্র অভিজ্ঞতা

মিশু চৌধুরী

মিশু চৌধুরী পেশাদার ক্রিকেট খেলছেন ২০০৬ সাল থেকে। ঢাকার মাঠে খেলতে গিয়ে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেও অনেক ছেলের কাছ থেকে সমর্থনও পেয়েছেন। ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, "নেতিবাচক ঘটনা আমাদের সঙ্গে অহরহ ঘটে। কিন্তু ইতিবাচক অনেক ব্যাপারও আছে। অনেক ছেলে আমাকে টিজ করেছে। অনেকে ছেলে আবার সাপোর্ট করেছে। ছেলেদের সঙ্গে অনেক প্রাকটিস করেছি। আমার অনেক সময় বল ছিল না, ব্যাট ছিল না, তখন ওই ভাইয়ারাই আমাকে সাহায্য করেছে।"

"নেতিবাচক ঘটনা আমাদের সঙ্গে অহরহ ঘটে। কিন্তু ইতিবাচক অনেক ব্যাপারও আছে। অনেক ছেলে আমাকে টিজ করেছে। অনেকে ছেলে আবার সাপোর্ট করেছে।"

মিশু চৌধুরী মনে করেন গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সাধারণ মাঠে মেয়েদের দেখা না গেলেও যারা পেশাদার লেভেলে খেলতে চান, তাদের জন্য সুযোগ বেড়েছে, ‘‘অনেক মেয়ে জানে না কোন মাঠে কী খেলা হয়। সাধারণ মেয়েরা সুলতানা কামাল মহিলা কমপ্লেক্সে খেলতে যাচ্ছে। শেখ জামাল মাঠে খেলতে যাচ্ছে। সেখানে স্কেটিং চালু হয়েছে। টেবিল টেনিস থেকে শুরু করে ব্যাডমিন্টন, হ্যান্ডবল এগুলো কিন্তু চলছে। কোথায় এগুলো খেলা হচ্ছে জানি না বলে আমরা অনেক সময় আড়ালে থাকি।’’

মেয়েদের জন্য সুবিধা বাড়াতে দুই মেয়রের ভাবনা

মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)

মাঠের সংকট দূর করতে ২৪টি পার্ক করার পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানালেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, ‘‘জুলাই মাসের মধ্যে ২৪টি পার্ক ওপেন করে দেব আমরা। সেখানে খেলার সুবিধা থাকবে। মেয়েদের বিষয়টি ভেবেই ডিজাইন করা হচ্ছে।’’

সিটি করপোরেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৪টি মাঠের দুটি করছে বুয়েট। বাকি ২২টির দায়িত্বে স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ভিত্তি।

মেয়েরা যেন মাঠে এসে খেলতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে কিছু পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানালেন আতিকুল ইসলাম, "পার্কে যেন মেয়েরা আসতে পারে এ জন্য সব জায়গায় সিসি ক্যামেরা বসানো হচ্ছে। মাঠ এবং পার্কে সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে পারলে যারা মহিলা আছেন, যাদের বাচ্চা আছে তারা কনফিডেন্স পাবেন। পুরো পার্ক এলাকা কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করা হবে। সিটি করপোরেশনের কমান্ড সেন্টার থাকবে। তাদের মাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো হবে।"

এই পরিকল্পনা গ্রহণের সময় নিজের পরিবারের কথাও ভেবেছেন আতিকুল ইসলাম, "সাধারণ মানুষের মতামত নিয়ে পার্কের ডিজাইন করেছেন স্থপতিরা। আপনি কিংবা আমার মেয়েরা কীভাবে মাঠে যেতে পারে সে বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছে।’’

মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি)

"ঢাকার ছেলে-মেয়েদের এখন আর ফুটবল ও ক্রিকেটে পাওয়া যায় না" এই আক্ষেপ ঘোচাতে চাওয়ার কথা বললেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, "আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডেই ন্যূনতম একটি করে খেলার মাঠ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আমরা যেখানেই প্রয়োজনীয় জমির হদিস পাচ্ছি সেখানে খেলার মাঠ তৈরি করছি। ঢাকার ছেলে-মেয়েদের এখন আর ফুটবল ও ক্রিকেটে পাওয়া যায় না-এই আক্ষেপ আমি ঘোচাতে চাই।’’

‘‘আমরা খেলাধুলায় ঢাকার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আমি দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডে লক্ষ্মীবাজার খেলার মাঠ, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে বাংলাদেশ বয়েজ ক্লাব খেলার মাঠ, ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে আলমগঞ্জ খেলার মাঠ, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে বকশীবাজার খেলার মাঠের উন্নয়ন করে তা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছি।’’

‘‘পাশাপাশি ৭০ নম্বর ওয়ার্ডে মেন্দিপুর খেলার মাঠ, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে বাসাবো বালুর মাঠ এবং ২ নম্বর ওয়ার্ডে ভূঁইয়ার মাঠের উন্নয়নে আমাদের কর্মযজ্ঞ চলমান রয়েছে।’’

মেয়েদের মাঠের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘মাঠ তো সবার জন্য উন্মুক্ত। তাই সকলেই এখানে আসতে পারেন, খেলাধুলায় অংশ নিতে পারেন। সেখানে ছেলে-মেয়ে কোনো বিভেদ নেই।’’