একা মায়েদের সংগ্রাম

ছেলে শঙ্খনীলের সঙ্গে লাবণ্য লিপি। ছবি সৌজন্য: লাবণ্য লিপি।

বাবা-মা ও এক বা একাধিক সন্তান নিয়ে তৈরি হয় পরিবার । কিন্তু এমনও কিছু পরিবার আছে, যেখানে শুধু মা’ই সন্তানের সবকিছু। মাতৃত্ব খুব সহজ কোনো বিষয় না। সন্তান গর্ভে ধারণ করা থেকে মাতৃত্বের যে সফর একজন মায়ের শুরু হয় তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানের ভালো থাকাকে ঘিরে আবর্তিত হতে হতে সন্তানকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। একজন মায়ের নিজের জীবনের উপর যত ঝড়ঝাপটাই যাক না কেনো, মা তার আঁচ সন্তানের উপর পড়তে দিতে চান না। সব মা’ই তার সন্তানকে দুধে-ভাতে দেখতে চান। বাংলাদেশে এখন বাড়ছে একা মায়ের সংখ্যা। বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়া এর একটা মূল কারণ । এছাড়া এমন অনেক মায়েরাও আছেন যাদের স্বামী মারা যাওয়ার পর শুধুমাত্র সন্তানের জন্যই একা থেকে গেছেন। তেমনই কয়েকজন নারীর সাথে কথা বলি। ভয়েস অফ আমেরিকাকে তারা জানান তাদের একা পথচলা, সন্তান পালনের সংগ্রামের গল্প।

এক.

ফারজানা আফরোজ (বয়স ৩২) এক সন্তানের মা। সন্তানের বয়স প্রায় পাঁচ বছর। ২০১২ সালে বিয়ে হয় ফারজানার। বিয়ের সাত বছর পর ২০১৯ সালে আইনগত ভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে তখন থেকেই একা জীবনের শুরু। একজন একা মা হিসেবে পথ চলতে গিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন প্রতিদিন। সন্তানকে সামলে ঘরে বসেই শুরু করেন অনলাইনে খাবারের ব্যবসা। রান্নার ওপর একটা প্রাতিষ্ঠানিক ‘শেফ কোর্স’ও করছেন। শেফ হিসেবে টুকটাক কাজও শুরু করেছেন। পাশাপাশি কন্টেন্ট রাইটার হিসেবে কাজ করছেন। ভয়েস অফ আমেরিকার সাথে আলাপে শুনালেন মা হিসেবে তার একলা চলার গল্প।

“ছেলে আয়ানের বয়স যখন সাড়ে তিন বছর তখন ওকে একটা প্রিস্কুলে ভর্তি করাতে যাই। ওরা যখন আয়ানকে ওর বাবার নাম জিজ্ঞেস করে, তখন আয়ান আমার বড় দুলাভাইয়ের নাম বলে। কারণ ছোটবেলা থেকেই ও আমার বড় বোন এবং বড় দুলাভাইকে মা-বাবা ডাকে। স্কুলের ভর্তি ফর্মে আমি ওর বাবার নাম লিখেছি একটা অথচ ও বলছে অন্য নাম, এটা খুব বিড়ম্বনার ছিলো। ছেলের কাছে বারবার বাবার নাম জানতে চাওয়া হচ্ছিলো, আর ও কোনো উত্তর দিতে পারছিলো না। ওর করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা আমিও সহজভাবে হ্যান্ডেল করতে পারছিলাম না। স্কুল কর্তৃপক্ষকে আমার সবকিছু ব্যাখ্যা করতে হয়েছিলো। তাদের কাছে আমার অনুরোধ ছিলো, বাবা সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন যেনো ছেলেকে না করা হয়। এরপর অবশ্য স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে।

আমার বাচ্চার বয়স যখন তিন মাস তখন আমাদের সেপারেশন হয়। তখন থেকেই ছোট বাচ্চা নিয়ে আমার সংগ্রাম শুরু। বাসায় বসে টিউশন শুরু করি। কিন্তু বাচ্চা সামলে, বাসার কাজ সামলে সেটাও বেশিদিন সম্ভব হয়নি। তারপর ভাবলাম, এভাবে তো আসলে সম্ভব না। একটা কাজ বা ব্যবসা শুরু করতে হবে, যেটা আমি বাসায় বসে, বাচ্চার দেখাশোনা করেও করতে পারবো। আমাকে তো আয় করতে হবে, বাচ্চার খরচ চালাতে হবে। এরপর ২০১৮ সালের জুন মাস থেকে আমি ঘরে তৈরি খাবারের ব্যবসা শুরু করি।”

সন্তানের দেখাশোনা ও ব্যবসার কাজে পরিবারের সহায়তা পেয়েছেন ফারজানা। বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ফ্ল্যাটে সন্তানকে নিয়ে থাকতে পারছেন, তাই বাড়ি ভাড়ার ভোগান্তি তাকে পোহাতে হচ্ছে না। ব্যবসার আয় থেকে মা-ছেলের খাবার ও বাকি মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হচ্ছে। তবে মানসিক সাপোর্টের অভাব বোধ করেন ভীষণভাবে। বললেন, “কোনো পারিবারিক, সামাজিক দাওয়াতে যেতে পারি না। আয়ানকে দেখা মাত্রই কেউ না কেউ আয়ানের বাবার প্রসঙ্গ তুলবেই। ‘আচ্ছা, ওর বাবা কি যোগাযোগ করে না? ওর বাবা কি ওর খরচ দেয় না? খোঁজ নেয় না? ও কি বাবাকে চেনে? ও কি বাবাকে ডাকে?’ -এই সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হয়। আমি যতই সন্তানের সামনে এই বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতে চাই না কেনো, আমার বাচ্চাটাকে ওইভাবেই দেখা হয় যে ও সিঙ্গেল প্যারেন্টিংয়েই বড় হচেছ। প্রথমদিকে আমি সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতাম এইসব কথার ভয়ে। পরে দেখলাম, আমাকে আসলে সন্তানকে মানুষ করার জন্যই শক্ত হতে হবে। আমি এখন যেসব আত্মীয় স্বজনের বাসায় গেলে কিংবা যে সমস্ত অনুষ্ঠানে গেলে এইসব নেতিবাচক কথা ও প্রশ্নের সম্মুখীন হই না, সেসব জায়গায় যাই। আত্মীয়-স্বজন, আশেপাশের লোকজন বিয়ে করে নিজেকে গুছিয়ে নিতে বলে, কিন্তু সন্তানের কথা উঠলেই বলে, ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চাদের জীবন এরকমই হয়। আবার বিয়ের প্রোপোজাল আসলে দেখা যায়, পাত্রের সন্তান আছে যার জন্য মা খোঁজা হচ্ছে। সেই সন্তানের দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে কিন্তু আমার সন্তানকে পাত্র গ্রহণ করবে না।”

দুই.

কথা বলি লাবণ্য লিপির (বয়স ৪৬) সঙ্গে। লাবণ্য লিপি পেশায় সাংবাদিক। আছেন ‘দৈনিক আমাদের সময়’ পত্রিকাতে সিনিয়র সাব এডিটর হিসেবে। ২০০৮ সালে বিয়ের দুই বছরের মাথায় হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাটাকে স্বামী মারা যান। ছেলের বয়স তখন মাত্র সাড়ে আট মাস। পুরো ঘটনাটি অকস্মাৎ ছিলো। সেই দুঃসহ স্মৃতি আজো তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। একমাত্র বন্ধু, ছেলে শঙ্খনীল। ছেলের বয়স এখন ১৪। ছেলে আর বৃদ্ধ মাকে নিয়েই বারো বছর ধরে লাবন্য’র সংসার । জানালেন বাড়ি ভাড়া নিয়ে বিড়ম্বনা থেকে শুরু করে তার সামগ্রিক সংগ্রামের কথা- “যখন আমার হাজব্যান্ড মারা গেলো, তখন থেকেই আমার মা আমার সঙ্গে ছিলেন, আজও আছেন। মায়ের কাছে বাচ্চাকে রেখে চাকরি করতাম। ঢাকার গোপীবাগে ভাড়া থাকতাম। আমার হাজব্যান্ড যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রতিবেশি ভদ্রলোক ভীষণ সাহায্য করেছিলেন। বাসার নিচে ভদ্রলোকের ফার্মেসি ছিলো। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর ঢাকা মেডিকেলে নিতেও তিনি সাহায্য করেন। এরপরেও তিনি মৃত্যুপরবর্তী আনুষ্ঠানিকতার কাজে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু এই সহযোগিতাটা তার স্ত্রী সহজভাবে গ্রহণ করেননি। জটিলতা এড়াতে আমরা বাসা ছেড়ে দিয়ে নারায়ণগঞ্জে চলে যাই। ওখানে আমার ভাইরা থাকতেন। কিন্তু সে সময় আমি বুঝতে পারি , বাসা ভাড়া নেয়াটা আমার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করতো আমার অভিভাবক কে? আমি বলতাম, আমার অভিভাবক আমার আম্মা। তবু কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইতো না। আমি একা মহিলা, সঙ্গে ছোট বাচ্চা, বৃদ্ধ মা...আমার সাংবাদিক পরিচয় সবকিছুকেই লোকে সন্দেহের চোখে দেখতো। বাসা ভাড়া দিতে পারবো না এমনটাও ভাবতো। এভাবে বাসা ভাড়ার বিড়ম্বনা ঠেকাতে একসময় আমার বড় ভাইসহ একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি। অর্থাৎ বাসাভাড়াটা আসলে আমার ভাইকেই দেয়া হলো। নারায়ণগঞ্জ থেকে রোজ ঢাকায় যাতায়াত কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিলো। তাই ব্যাংক লোন নিয়ে ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনে শিফট হই। এখানে একই বিল্ডিংয়ে আমার ছোট ভাইও থাকে। বয়স্ক মা, ছোট বাচ্চার নিরাপত্তার চিন্তা করেই মূলত ফ্ল্যাটটা কিনি।

যেহেতু আমি একজন সিনিয়র সাংবাদিক তাই আমাকে সামাজিক বিড়ম্বনা কম পোহাতে হয়েছে। কর্মক্ষেত্রেও আমাকে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি। সন্তানের কথা চিন্তা করেই আর বিয়ের কথা ভাবিনি। ছেলেকেই আমি আমার পুরোটা দেয়ার চেষ্টা করেছি। যেহেতু ওর বাবার ঘাটতি আমি কখনওই পূরণ করতে পারবো না, তাই আমি চেয়েছি মাকে ও পুরোপুরি কাছে পাক।”

একজন একা মায়ের সন্তানকে বড় করার লড়াই খুব কঠিন। সে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন লাবন্য লিপি। বলেন, “বাচ্চা অসুস্থ হয়েছে, সারা রাত নিয়ে বসে থেকেছি। সকালে একাই কোলে করে হাসপাতালে নিয়ে গেছি। কখনও এমন হয়েছে, স্কুল থেকে আনার লোক নাই, অফিস থেকে নিজেই ছুটতে ছুটতে গিয়ে নিয়ে এসেছি। অফিসে কাজ করতে করতেও ছেলের জন্য চিন্তা করতে হয়। এমনও হয়েছে, ছেলের ১০৩ ডিগ্রি জ্বর। তাকে বাসায় রেখেই অফিস করেছি। সন্তান অসুস্থ, সেই দোহাই দিয়ে কখনও অফিস থেকে ছুটি নেইনি। এখনও প্রতিনিয়তই টিকে থাকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছি।’’

তিন.

কথা বলি আরেকজন মায়ের সঙ্গে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বয়স ৫১ বছর)। বিয়ে হয় ২০০৩ সালে, স্বামীর মাত্রাতিরিক্ত সন্দেহপ্রবনতার কারণে ২০০৫ সালের ডিসেম্বর থেকেই আলাদা থাকতে শুরু করেন। তখন তার ছেলের বয়স দুই বছর। ২০১৪ সালে আইনগত ভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। পরিবারের পূর্ণ সহায়তা পেয়েছেন। থাকছেন পরিবারের সঙ্গে। বললেন, “একটা সময় পর্যন্ত আমার ছেলে জানতোই না যে ‘বাবা’ নামের একটা সম্পর্ক আছে। ছোটবেলা থেকে ও বাড়িতে পুরুষ বলতে মামাদের দেখেছে। তাই আমাকে বলতো, ‘মা, সবার মামারা স্কুলে নিতে আসে, আমার মামার কেনো নিতে আসে না।’ অন্য বাচ্চাদের যে বাবারা আসে সেটা ও বুঝতো না। এতটা সময় কেটে গেলেও সমাজের সাথে এখনও লড়াইটা চলছে। সন্তানের বাবা কোথায় সেটা এখনো অনেকে জিজ্ঞেস করে বসে। প্রথমদিকে আমি সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু পরে ভাবলাম আমার সন্তান তো কোনো অপরাধ করেনি। ওকে তো সমাজের সাথে খাপ খাওয়াতে হবে। এরপর আমি সব রকম সামাজিক, পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। মানুষ তো কথা বলবেই। তবে আমার বাবা-মা, ভাই-বোন ছাড়াও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরাও আমাকে সমর্থন দিয়েছে, সাহস যুগিয়েছে এটা আমার পরম পাওয়া।”

চার.

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন নারী (বয়স ৪২) জানালেন সংগ্রামের কথা। ২০১৫ সালে হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাটাকে স্বামী মারা যান। তখন সন্তানের বয়স মাত্র আট বছর। একমাত্র কন্যা সন্তান ছোটবেলায় লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত ছিলো। স্বামী যখন মারা যায় সে সময় মেয়ের চিকিৎসা শেষের দিকে। এই নারী বিয়ের আগ থেকেই চাকরি করতেন বাংলাদেশের এক নামকরা হাসপাতালের গ্রন্থাগারে। মেয়ের অসুস্থতা ধরা পড়লে তার যত্ন ও চিকিৎসা সংক্রান্ত কারণে চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। শ্বশুর-শাশুড়ি সহ যৌথ পরিবারেই থাকতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর ২০১৯ সাল পর্যন্ত শ্বশুর বাড়িতে থাকতে পেরেছেন। এরপর সন্তানকে রেখেই তাকে বাবার বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। তিন মাস পরে মেয়ে স্কুলের পড়াশোনায় খারাপ করলে, স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুল ছাড়ার ওয়ার্নিং দেয়। তখন শ্বশুর-শাশুড়ি মেয়েকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়। এই নারী এখন একটা স্কুলে খুব সামান্য বেতনের চাকরি করেন, যা দিয়ে মা-মেয়ের হাত খরচটা কোনো রকমে চলে যায়। থাকছেন বাবার সঙ্গে, বাবার বাড়িতে। বললেন, “মেয়ের দাদা-দাদী পড়াশোনার খরচ, স্কুলের বেতন নিয়মিত দিচ্ছেন। কখনও কখনও স্কুল যাওয়া-আসার ভাড়াটাও দেন কিন্তু সেটা চাইতে হয়।”

সামাজিক অনেক বিড়ম্বনার কথা শোনালেন- “কাছের, দূর সম্পর্কের পুরুষ আত্মীয়স্বজন, বাবার পরিচিত লোকজন ফোন করে, বাসায় এসে অনেক রকম কথা বলে, সহানুভূতি দেখানোর ছলে গায়ে হাত দিতে চায়। কেনো এভাবে থাকি, কেনো জীবনকে উপভোগ করি না, এ ধরণের কথা বলে। তাদের সাথে বেড়াতে যেতে বলে, সিনেমা দেখতে যেতে বলে।”

জীবন নতুন করে শুরু করতে চাইলে সেখানেও আছে বিড়ম্বনা। “কিছুদিন আগে একটা বিয়ের প্রস্তাব পাই। পাত্র ব্যবসায়ী, বিপত্নিক। ছোট ছোট দুইটা ছেলেমেয়ে আছে। আমি বললাম. আমার মেয়ে আমার সাথে থাকবে, ওর খরচ তো ওর দাদা-দাদী দেয়। যেহেতু আমার মা নাই, নানাবাড়িতে ওকে দেখার লোক নাই। পাত্রের মা তাতে রাজী নন। তাদের কথা, ‘পরের মেয়েকে কি মেনে নেয়া যায়?’ আমি তার ছোটো ছোটো বাচ্চাদের নার্সিং করবো, সব দায়িত্ব নেবো অথচ তারা আমার মেয়েকে আমার সাথে থাকতে দেবে না। এর আগেও বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো, পাত্র বড় সরকারি কর্মকর্তা। কিন্তু সেখানেও শর্ত ছিলো মেয়েকে হোস্টেলে রাখতে হবে। নিজের সুখের জন্য আমি তো আমার সন্তানকে বিসর্জন দিতে পারি না। এদিকে বাবা আমাকে আবার কেন বিয়ে দিচ্ছে না তা নিয়ে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশির চিন্তার শেষ নেই। লোকজন সুযোগ পেলেই কটু কথা বলে। আমার সামনেই বাবাকে জিজ্ঞেস করে, অশালীন ইঙ্গিত করে। এই সবকিছুর ভয়ে এখন আর কোথাও যাই না, কারো সাথে মিশি না। আমার বড় বোন আছেন, বোন কোথাও গেলে আমি ওর সাথে যাই। এ সবকিছুর পরেও আর্থিক সংকট তো আছেই। মেয়ে এখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। টাকার অভাবে ওর জন্য গৃহশিক্ষক রাখতে পারছি না। দাদা-দাদীও ওর পড়াশোনার জন্য যা খরচ দিচ্ছেন তার অতিরিক্ত দিতে পারছেন না।”

সরকারি/বেসরকারী সহোযোগিতা

সিঙ্গেল মাদার বা একা মায়েদের সাহায্য করবার মতো কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান/এনজিও—এর সন্ধান পাওয়া যায়নি। ভুক্তোভোগিরা জানালেন, যদি এমন মায়েদের শিশুদের জন্য ‘শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র’ও থাকতো তাহলেও কর্মজীবি একা মায়েরা শিশুকে সেখানে রেখে নিশ্চিন্তে কর্মক্ষেত্রে যেতে পারতেন।

বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা’ কার্যক্রম চালু আছে। ১৯৯৮—৯৯ অর্থ বছরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সমাজসেবা অধিদফতররের মাধ্যমে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের জন্য এই ভাতা কর্মসূচি চালু করা হয়। কথা বলি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সামাজিক নিরাপত্তা) মুহাম্মদ শাখীর আহম্মদ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানান, যে কোনো বয়সের বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত মহিলারা এই ভাতা প্রাপ্তির যোগ্য। কার্যক্রমটি শুধুমাত্র উপজেলা পর্যায়ে চালু আছে। মাসিক ৫০০/— (পাঁচশত) টাকা ভাতা প্রদান করা হয়। তবে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এই ভাতা প্রদান করা হয় না। ভাতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও আবার অনেক ধরণের মানদন্ড রয়েছে। স্বাস্থ্য, বয়স, আর্থ—সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনা করে ভাতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। ভাতা হিসেবে প্রদত্ত টাকার পরিমান বাড়ানো কিংবা শহরকেন্দ্রিক এই সেবা চালুকরণের পরিকল্পনা আপাতত নেই। উপজেলা ও গ্রামভিভিত্তিক একবোরেই দুঃস্থ, দরিদ্র, অসুস্থ, প্রতিবন্ধী মহিলাদের জন্য ভাতাটি প্রদান করা হচ্ছে।