বাংলা ভাষায় সবচেয়ে মধুর শব্দ হলো মা। ছোট্ট এই এক বর্ণের শব্দের সঙ্গে আমাদের পুরো অস্তিত্ব জড়িয়ে থাকে। তাই মাকে কেন্দ্র করে বাংলায় রচিত হয়েছে অনেক উপন্যাস, গান, কবিতা ও গল্প। সাহিত্যে মা এসেছেন বারবার। শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও মাকে নিয়ে বেশ কিছু আলোচিত সাহিত্যকর্ম রয়েছে। মায়ের কোমল-কঠোর রূপ, স্নেহ-ভালোবাসা, মমতা উঠে এসেছে সাহিত্যে। আবার প্রচলিত চরিত্রের বাইরেও, ভিন্ন ধারার মা চরিত্র দেখি আমরা সাহিত্যে। বিখ্যাত পাঁচটি বাংলা উপন্যাসে মাকে আমরা দেখতে পাই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে।
পথের পাঁচালীর সর্বজয়া
প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের অনন্য সৃষ্টি, পথের পাঁচালী। গ্রামীণ পটভূমিতে সামাজিক প্রেক্ষাপটে লেখা বিখ্যাত উপন্যাস। উপন্যাসটির প্রধান চরিত্রগুলো হলো, অপু, দুর্গা, তাদের মা সর্বজয়া, বাবা হরিহর রায় এবং আশ্রিতা ইন্দির ঠাকুরন। উপন্যাসে দেখা যায় একই সংসারকে ঘিরে নারীর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান। তারমধ্যে, হরিহর রায়ের স্ত্রী এবং অপু-দুর্গার মা সর্বজয়াকে দেখা যায় আদর্শ গৃহিনী ও স্নেহশীল জননী হিসেবে। নিজ সংসারে সে সম্রাজ্ঞী। হরিহরের সংসারে প্রবেশের পর থেকেই সমস্ত দায়িত্ব বহন করে চলছে। তাই অল্পতেই তাকে মেজাজ হারাতেও দেখা যায়। আপাত দৃষ্টিতে সর্বজয়াকে মুখরা ও সংকীর্ণ নারী মনে হলেও, সন্তানের জন্য তার রয়েছে গভীর ভালোবাসা। আশ্রিতা ইন্দির ঠাকুরণের সাথে দুর্গার সখ্যতা সে সহ্য করতে পারে না। ইন্দির ঠাকুরণকে সর্বজয়া হিংসা করে। তার মনে হয় যে, দুর্গা মায়ের চাইতে ওই বৃদ্ধাকেই বেশি ভালোবাসে। সে মনেমনে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সে মনে করে, বুড়ি তার মেয়েকে পর করে দিচ্ছে। সর্বজয়া একজন চিরন্তন মা। একজন সাধারণ মায়ের মতোই মেয়ে দুর্গার চেয়ে, ছেলে অপুর প্রতি তার টান বেশি। তথাপি, দুর্গার প্রতি তার ভালোবাসা কম নয়। ঝড় বৃষ্টির রাতে সর্বজয়া ছেলেমেয়ের কুড়নো নারকেল, প্রতিবেশির বাড়িতে ফেরত পাঠানোর কারণ ছিলো, ছেলেমেয়েকে অমঙ্গল থেকে রক্ষা করা। প্রতিবেশির শাপ-শাপান্তের ভয়ে, এক দরিদ্র মাকে কেঁপে উঠতে দেখা যায়। সর্বজয়ার চরিত্র চিত্রণে, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের মা মৃণালিনীর প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়। বিভূতিভূষণ তাঁর দিনলিপি“স্মৃতিরেখায়, যেভাবে মায়ের কথা জানিয়েছেন, তার সাথে সর্বজয়া চরিত্রটির সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
পথের পাঁচালী উপন্যাসের সর্বজয়া চরিত্রটি সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় আজ থেকে প্রায় একশত বছর আগে, বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা, জীবনধারা, পারিবারিক যৌথজীবন তুলে ধরেছেন। সেই জীবনে জৌলুস ছিলো না, কিন্তু মমতামাখা সম্পর্কগুলো ছিলো। সেটারই প্রতীক হিসেবে আমরা দেখতে পাই সর্বজয়াকে। দারিদ্র, অভাব, বেদনার মধ্যে অপু ও দুর্গাকে যেভাবে আগলে রেখেছে, তা চিরন্তন মাতৃত্বের প্রতিচ্ছবি। আমাদের বোধে এবং চিন্তা চেতনায়, সাহিত্য সংস্কৃতিতে সর্বজয়ার এই মাতৃত্ব কিংবদন্তি হয়ে থাকবে।
হাজার চুরাশির মা উপন্যাসের সুজাতা
বিখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী রচিত, কালজয়ী উপন্যাস “হাজার চুরাশির মা। ১৯৭০ এর দশকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসটি, তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিলো। ১৯৭৪ সালে এটি প্রকাশিত হয়। মহাশ্বেতা দেবী ১৯৯৬ সালে এই উপন্যাসের জন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পান। দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা ও প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন।
এটি সুজাতা নামের এক মায়ের গল্প। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সুজাতা, একজন আধুনিক ও দৃঢ় মানসিকতার মা। সুজাতার ছেলে ব্রতী চ্যাটার্জী একজন বিপ্লবী। তাকে তার আদর্শের জন্য রাষ্ট্র পাশবিকভাবে হত্যা করে। লাশকাটা ঘরে ব্রতীর লাশের নম্বর ১০৮৪। ব্রতীর লাশের নাম্বার অনুযায়ী, সুজাতা হাজার চুরাশির মা নামে পরিচিত হয়। উপন্যাসের শুরু হয়, বিপ্লবী ব্রতীর মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে। সুজাতা ছেলের জন্ম থেকে স্মৃতিচারণা শুরু করেন। সুজাতা চার সন্তানের মা। ব্রতী ছিলো তার দ্বিতীয় সন্তান। স্বামী দিব্যনাথসহ পরিবারের সবার চাহিদা পূরণ করাই ছিলো তার একমাত্র কাজ। সংসারে সে ছিলো পদদলিত। স্বামী ও শ্বাশুড়ীর অত্যাচার নীরবে সহ্য করতো। এমনকি, সন্তানদের জন্ম দেয়ার সময়ও, তাদেরকে সে পাশে পায়নি। চার সন্তানের মধ্যে একটু অন্যরকম ব্রতী, তার আশ্রয়ের একটি মাত্র জায়গা। পুঁজিবাদের রাহু যে সময়টাতে সমাজকে গ্রাস করতে শুরু করে, শ্রেণী বৈষম্য প্রকট হতে থাকে, ঠিক তখনই, সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রতীদের মতো বিপ্লবীদের আবির্ভাব হয়। ব্রতী প্রচন্ড মা ভক্ত। মা ছাড়া পরিবারের আর সবাইকে সে ঘৃণা করতো। তার বাবার বিলাসবহুল জীবনযাপন, ব্যাভিচার, বহুনারীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন, মায়ের প্রতি অত্যাচার, অমানবিকতা; ব্রতী মেনে নিতে পারতো না। ব্রতী তার বাবাকে বাবা বলে না ডেকে, বস বলে ডাকতো। তবে, তার বাকি ভাইবোনেরা বাবার অন্ধ ভক্ত ছিলো। পিতার বিকৃত যৌনকামনাকে তারা পুরুষত্ব বলে দাবি করতো। ব্রতী তার মা কে আগলে রাখার চেষ্টা করতো। মায়ের নীরবে অত্যাচার সহ্য করে যাওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলো সে। ব্রতীই তার মা সুজাতার অভিভাবক ছিলো। মা যেনো তার ছোট্ট মেয়ে। সুজাতার সেই অভিভাবক ছেলে যখন হারিয়ে গেলো, সুজাতার পরিচয় হয়ে যায়, হাজার চুরাশির মা হিসেবে। রাতের অন্ধকারে, দিনের আলোতে সে খুঁজে ফেরে হাজার চুরাশিকে। একজন মাকে পরামর্শ দেয়া হয়, তার ছেলেকে ভূলে যাওয়ার। বলা হয় তার ছেলের মতো লোকেরা ‘ক্যানসারাস গ্রোথ অফ ডেমোক্রেসি। এমনকি তার পরিবার যখন জানতে পারে ব্রতী আন্দোলনে যুক্ত ছিলো, তাদের প্রতিক্রিয়া হয় লজ্জার। তারা ব্রতীর পরিচয় গোপন করতে চেষ্টা করে, কেসের ফাইল বন্ধ করিয়ে দেয়া হয়। সুজাতা ব্রতীর সত্য জানার চেষ্টা করেন। ব্রতীর আদর্শ, ভাবনা বুঝতে না পারার অনুতাপ তাকে ক্ষতবিক্ষত করে।
কবি ও গবেষক পিয়াস মজিদ এ উপন্যাসটি সম্পর্কে বললেন, “এটি শুধু ভারতের পশ্চিমবঙ্গ নয়, এ অঞ্চলের মানুষের মুক্তির আন্দোলনের উপর লেখা। হাজার চুরাশির মায়ের যে বিশেষত্ব আমি পড়ার সময় খুঁজে পেয়েছি, তাতে একসময় মনে হয়েছে, সুজাতা চরিত্রটি খুব রুক্ষ ও কঠিন। এর কারণ, লেখক মহাশ্বেতা দেবীর বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁর লেখনিতে খুব মানবিক বিষয়েও, লেখকের লিপ্ততা প্রকাশ পায় না। লেখক যেনো খুব নির্লিপ্তভাবে দূরে দাঁড়িয়ে, বিষয়টি প্রত্যক্ষ করছেন। তাছাড়া সুজাতা এখানে এক ভিন্ন রকম মা, যার সন্তান সংখ্যায় পরিণত হয়েছে এবং এই মা একজন না, এমন শত শত মা রয়েছেন, যাদের ছেলেরা শোষণ, সিস্টেম- সবকিছুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় সংখ্যা হয়ে চালান হয়ে যায় কলকাতা থেকে বিহার, বিহার থেকে দিল্লী, দিল্লী থেকে উড়িষ্যার বিভিন্ন জেল থেকে জেলে। এর মধ্যে ব্রতীর মতো অনেককে এনকাউন্টারে মেরে ফেলা হয়। অর্থাৎ, নতুন ভোর আনতে গিয়ে তারা সংখ্যা হয়ে হারিয়ে যায়। এই যে ব্রতী চ্যাটার্জীকে ১০৮৪ সংখ্যা দিয়ে প্রতীকায়ন এবং তার মা সুজাতাকে হাজার চুরাশির মা নামে সংখ্যা দিয়ে প্রতীকায়ন, তা এই উপন্যাসটিকে একটি নতুন শিল্পমাত্রায় উন্নীত করেছে।
আগুনপাখি উপন্যাসের মা
কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের প্রখ্যাত উপন্যাস “আগুনপাখি। উপন্যাসটি নিয়ে কথা বলি লেখক,গবেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক হামীম কামরুল হকের সঙ্গে। তিনি বললেন,“হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখির মা এতো বেশি বাস্তবসম্মত এবং আমাদেরকে এতাটাই নাড়িয়ে দিয়ে যায় যে, এই উপমহাদেশের একটি কঠিন ক্রান্তিলগ্ন, দেশভাগের সময় একজন নারী কীভাবে তার অবস্থানকে বুঝতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি কোনোভাবেই তার ভূমি, তার দেশ ছেড়ে আসতে রাজী হননি। এই নারী চরিত্রের সাথে আমি মিল খুঁজে পাই আমার আম্মার দাদীর সাথে। তিনি কোনোভাবেই দেশ ছেড়ে আসতে রাজী হননি। তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানে আমি যাবো না। ‘আগুনপাখি’ পড়তে গিয়ে, আমার বারবার আম্মার দাদীর কথা মনে হয়েছে। তাই আমি স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছি, এটি কতটা বাস্তবসম্মত। সে সময়ে শুধু উপন্যাসের মা চরিত্রটিই নয়, বর্ধমানের অনেক নারীরাই এই ভুমিকা পালন করেছিলেন, তারা সবকিছু ছেড়ে পাকিস্তান চলে আসতে অসম্মতি জানিয়েছিলেন।
আগুনপাখি’ উপন্যাসটি লিখবার জন্য যে গভীর বেদনা, অস্তিত্বের দ্বন্দ, ইতিহাস সচেতনতা ও শিল্পবোধের প্রয়োজন হয় তা গল্পের প্রতিটি বাক্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথম মহাযুদ্ধের পরের সময় থেকে শুরু করে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, বিলিতি পন্য বর্জন, তেতাল্লিশির দুর্ভিক্ষ, সাতচল্লিশের দেশভাগ এবং দুটো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে রচিত এ উপন্যাসের কথক চরিত্রে উঠে এসেছে, অতি সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দীক্ষাহীন এক মায়ের আঞ্চলিক ভাষার বয়ান। হাসান আজিজুল হক এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন,-এটা আদতে আমার মায়ের মুখনিঃসৃত ভাষা। উপন্যাসের কথক-চরিত্র, তথা মূল প্রটাগনিস্ট (নায়ক) যে আদতে তিনিই, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারো। তিনি যেভাবে কথা বলতেন, সেই বাকভঙ্গিতে আমি লিখেছি। তাঁর দেহভাষা, তাঁর ব্যবহৃত বুলি, এইসব ধরার একটা প্রচেষ্টা ছিল। উনি যেভাবে কথা বলতেন, আমার ফুফুরা বা চাচিরা তো সেভাবে বলতেন না। এমনকি গ্রাম ভেদে কথা বলার ঢংও একেক রকম।
উপন্যাসটি অবিভক্ত ভারতের এক মুসলিম নারীর বয়ানে আত্মস্মৃতি। উপন্যাসে নারীর নাম অনুহ্য রাখা হয়েছে। তার জীবনের বেশিরভাগটাই একান্নবর্তী পরিবারে স্বামী, সংসার সন্তান নিয়ে কেটেছে। এই নারী মায়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে গল্প বলতে শুরু করেন, তা তার বাবার পুনর্বিবাহ, দাদীর মরে কাঠ হয়ে যাওয়া,বিয়ের মাধ্যমে নিজের বাড়িকে পিতার বাড়ি বানিয়ে, ডোবা থেকে দীঘিতে আসার মতো স্বামীর বিরাট একান্নবর্তী পরিবারে প্রবেশ, ইত্যাদি সরল ঘটনার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে আস্তে আস্তে জটিল হতে থাকে। তার বড় ছেলের মৃত্যুতে মায়ের আকুতি,সন্তানকে বাঁচানোর প্রানান্ত চেষ্টা পাঠককে অশ্রুসজল করে।
সাংসারিক সাফল্যের চরম শিখরে পৌঁছে, একদিন এই নারী উপলব্ধি করেন, সংসারে তার ও অন্য নারীদের অবস্থান। তিনি তার স্বামীর সহযোগিতায় ধীরে ধীরে পড়তে শেখেন। তার ভেতরে রাজনৈতিক এবং সামাজিক সচেতনতা তৈরি হয়। এভাবে তার ব্যক্তিসত্তা তৈরি হতে থাকে। তথাপি, কাহিনীর শেষে আমাদের জন্য এক অপার বিস্ময় অপেক্ষা করে, যখন তিনি অস্বীকার করেন দেশভাগ, দেশত্যাগকে। তিনি কখনোই হিন্দু-মুসলমান-কে আলাদা করে দেখেননি। নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তিনি দেখেছেন, হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের কাছে তার স্বামী কতটা প্রিয়। সেই নারী বাকরুদ্ধ হয়ে যান, যখন দেখেন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিভেদ, হত্যা, বিভৎসতা। দেশত্যাগের ব্যাপারে তার উপলব্ধি, “চারাগাছ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় লাগাইলে হয়, এক দ্যাশ থেকে আরেক দ্যাশে লাগাইলেও বোধায় হয়, কিন্তুক গাছ বুড়িয়ে গেলে আর কিছুতেই ভিন মাটিতে বাঁচে না।
সবাই যখন চলে যেতে লাগলো, ভিটে ছেড়ে তিনি গেলেন না। তিনি বলেন, “আমাকে কেউ বোঝাতে পারলেনা, ক্যানে আলেদা একটো দ্যাশ হয়েছে, এই দ্যাশটি আমার লয়।
হাঙর নদী গ্রেনেডের বুড়ি
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের বিখ্যাত উপন্যাস“হাঙর নদী গ্রেনেড। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসের পটভূমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এ উপন্যাসে উঠে এসেছে,যশোরের কালীগঞ্জ গ্রামের এক মায়ের সত্য ঘটনা। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বুড়ি। এক গ্রাম্য বালিকা। আর পাঁচটি মেয়ের চেয়ে একটু আলাদা তার কল্পনার জগৎ। কিছুটা চঞ্চল। পাখি হতে চায়, নদীর মাঝি হতে চায়। মোট কথা হারিয়ে যেতে চায় দূর-দূরান্তে। সেই বুড়ির বিয়ে হয়, তার চেয়ে দ্বিগুন বয়সী দোজবর চাচাতো ভাই গফুরের সাথে। আগের পক্ষের দুই ছেলের মাও হতে হয়, যারা একসময় ছিলো বুড়ির খেলার সাথী। শুরু হয় বুড়ির সাংসারিক জীবন। স্বামী, সন্তান সবার ভালোবাসা পায়। গফুরের সাথে বিয়ের অষ্টম বছরে জন্ম নেয়, বুড়ির নিজের সন্তান রইস। বুড়ির মা হওয়ার বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে রইসের জন্মের সাথে সাথে। কারণ, তার আকাঙ্খার সন্তানটি হয় বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধী সন্তানের মা হওয়ার যন্ত্রণা স্পষ্ট হয় বুড়ি চরিত্রটির মাধ্যমে।
একসময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ততদিনে বুড়ির সন্তানরাও বড় হয়েছে। স্বামী বিগত হয়েছে। বড় দুই ছেলেকে বুড়ি উৎসাহ দেয় মুক্তিযুদ্ধে যাবার। নিজের যুদ্ধে যাবার অক্ষমতাকে সে সন্তানদের যুদ্ধে পাঠানোর মাধ্যমে পুষিয়ে নেয়। সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ করে তার নাড়িছেঁড়া সন্তানকে দেশের জন্য বিসর্জনের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন, বুড়ি তার বাড়িতে আশ্রয় নেয়া দুই মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে, নিজের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছেলেকে পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা অন্যতম এই উপন্যাসটির মূল বিষয়বস্তুই হলো, দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য একজন মায়ের এই করুণ ও সাহসী আত্মত্যাগ।
উপন্যাসের লেখিকা, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমার লেখা প্রথম উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি, আমার শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক আবদুল হাফিজ। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে, রেসকোর্সে যাওয়ার সময় আমার সায়েন্স ল্যাবরেটরি কলোনির বাসায়, স্যার আমার খোঁজ নিতে আসেন। তাঁর কাছ থেকে এক মায়ের গল্প শুনি, যিনি দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচানোর জন্য নিজের প্রতিবন্ধী সন্তানকে তুলে দেন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। যশোরের কালীগঞ্জের ঘটনা এটি। স্যার আমাকে ওই মাকে নিয়ে গল্প লিখতে বলেন। প্রথমে ছোটগল্প লেখার কথা ভাবলেও, পরে উপন্যাস লিখি। শুরু করেছি বুড়ির শৈশব থেকে। বারো ভাইবোনের একজন, বুড়ি খুব সচেতনভাবে তার বাবাকে বলে তার নামটি বদলে দিতে। বুড়ির এই ছোট্ট প্রতিবাদ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে সন্তানকে তুলে দেওয়া পর্যন্ত উপন্যাসের পরিসর। এই যে, স্বাধীনতার জন্য যে উৎসর্গ তিনি করলেন, এমন অসংখ্য উৎসর্গের বিনিময়েই আমাদের স্বাধীনতা।
মা উপন্যাসের শহীদ আজাদের মা
সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের অত্যন্ত জনপ্রিয় উপন্যাস“মা। প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ২০২২ সালে এর ১০১তম মুদ্রণ প্রকাশিত হয়েছে। এই উপন্যাসটির কাহিনীও মুক্তিযুদ্ধের একটি সত্য ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা, এক লড়াকু মায়ের গল্প। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন ঢাকা শহর অবরুদ্ধ করে রেখেছিলো, তখন পাকিস্তানি সেনাদের ওপর একের পর এক অপারেশন চালায় ঢাকার আরবান গেরিলা দল। এই গ্রুপের অন্যতম সদস্য ছিলেন তরুণ মাগফার আহমেদ চৌধুরী (আজাদ)। আজাদের বাবা ছিলেন ধর্ণাঢ্য, কারো কারো ভাষায় ঢাকার শহরের সবচেয়ে বড়লোক। বিক্রমপুরের জমিদারের ছেলে। আজাদের মা ছিলেন খর্বাকৃতির, কিন্তু প্রখর তার ব্যক্তিত্ব। তার ছিলো ইস্পাতকঠিন চারিত্রিক দৃঢ়তা, জেদ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবার মানসিকতা। আজাদের মা সাফিয়া বেগম স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মানতে না পেরে, ছেলেকে নিয়ে বের হয়ে আসেন, নিজ নামে রেজিস্ট্রিকৃত ইস্কাটনের রাজপ্রাসাদতুল্য বাড়ি থেকে। স্বামীগৃহ ত্যাগ করার পর, স্বামীর অনেক অনুনয় সত্ত্বেও ফিরে যাননি। নিয়েছিলেন বৈধব্যের সাজ। ছেলেকে অনেক কষ্টে পড়াশোনা করান। পুরনো ঢাকার পৈত্রিক বাড়িতে থাকতেন। এই বাড়ি থেকে ১৯৭১ সালের ৩০ আগষ্ট আজাদকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পাকিস্তানি সেনাদের চরম নির্যাতনের পরও, মুক্তিযোদ্ধা আজাদ কোনো তথ্য দেননি। পাকিস্তানিরা আজাদের মা-কে বলে, আজাদ যদি মুক্তিযোদ্ধাদের নাম-ধাম ও তথ্য প্রকাশ করে, তাহলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। কারাগারে মা দেখা করেন আজাদের সঙ্গে। আজাদকে বলেন, কারো নাম প্রকাশ না করতে। আজাদের কাছে তার মা জানতে পারে, পাকিস্তানি সেনারা তাকে মাটিতে শুতে দিয়েছিলো। আজাদ বলেছিলো, মা দুদিন ভাত খাইনা, ভাত নিয়ে এসো। কিন্তু, এটাই ছিলো আজাদের সঙ্গে তার মায়ের শেষ সাক্ষাৎ। পরের দিন আজাদের মা ভাত নিয়ে রমনা থানায় হাজির হয়েছিলেন, ছেলের দেখা মিলেনি। আর কোনোদিন আজাদ ফিরে আসেনি মায়ের কোলে।
শহীদ আজাদের মা সাফিয়া বেগম ১৪ বছর ভাত খাননি, একবেলা একটা রুটি খেয়ে কাটিয়েছেন। কী শীত, কী গ্রীষ্ম, শানের মেঝেতে শুয়ে কাটিয়েছেন। ঠিক ১৪ বছর পর, ১৯৮৫ সালের ৩০ আগষ্ট এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মা মারা যান। তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী এপিটাফে লেখা হয়“মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগম, শহীদ আজাদের মা।
এই উপন্যাসটি সম্পর্কে লেখক হামীম কামরুল বলেন, “আনিসুল হকের মা উপন্যাসটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। আমরা ম্যাক্সিম গোর্কীর মা উপন্যাসের কথা জানি, যেখানে, মা আসলে বিপ্লবের প্রতীক। শহীদ আজাদের মা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তার সন্তান যেমন দেশের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছে, তেমনি মা তার সন্তানের জন্য, নিজের জীবনকে এক ধরণের কঠিন প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছেন পরবর্তী ১৪ বছর। মৃত্যুর আগে আজাদকে ভাত খাওয়াতে পারেননি বলে, তিনি নিজে আর সারাজীবনে ভাত খাননি।
সাহিত্যে নারী চরিত্র বা মা চরিত্র নিয়ে হামীম কামরুল বললেন, “বাংলা উপন্যাসে কিংবা বিশ্ব সাহিত্যে, নারীকেন্দ্রিক ও নারীর ভূমিকাকে চিহ্নিত করার যে চেষ্টা, সেটা আসলে জীবনসূত্রের উৎসকেই চিহ্নিত করা। সুতরাং, সাহিত্যে মায়ের অবস্থান আসলে চিরায়ত।