ঈদে পরিবারকে পাশে পান না ট্রান্সনারীরা

ঈদে পছন্দসই পোশাক পরতে ভাল লাগে সবারই। কিন্তু পোশাকটা বাইরের আবরণ, যার যেমন পছন্দ। জেন্ডার আইডেন্টিটিও তেমনি ব্যক্তিগত। সমাজে মানুষ হিসেবে সবার সাথে মিলেমিশে বাঁচতে চান, বলেছেন সকলে।

অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্রী মেঘা শর্মা। বয়স ২৩। পড়াশোনার সাথেই ফুলটাইম জব করছেন, মডেলিং করছেন। দেশের প্রথম ট্রান্সনারী এয়ার হোস্টেস হতে চান তিনি।

টাঙ্গাইলের মেয়ে অংকিতা ইসলাম। বয়স ২৫। কর্মরত আছেন ঢাকার একটি বেসরকারী ব্যাংকের এইচ. আর. বিভাগে। আপন বলতে কৃষক বাবা, গৃহিণী মা আর কলেজ পড়ুয়া ভাই। গ্রামে সংসার চলে তাঁর পাঠানো অর্থে।

ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে পড়ছেন ইচ্ছা নাজ। বয়স ২১। ছোটবেলা থেকেই নিজেকে মেয়ে ভাবতেন। অল্প কিছুদিন হল ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে পরিচয় দেয়া শুরু করেছেন। “মানুষ ভাবে, কোন এক সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠিক করেছি, আমি ট্রান্সজেন্ডার। চিন্তাটাই অসম্ভব অবমাননাকর।”

হোচিমিন ইসলাম, ২৭। ২০১৮ সালে নার্সের চাকরি নিয়ে ঢাকা আসা। করোনার শুরুতে আইসিইউতে সেবা দিতে গিয়ে নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। জনস্বাস্থ্যে মাস্টার্স শেষ করে এখন ফের নার্সিং করছেন।

গরমের মধ্যে ঈদ। তাই পাতলা সুতি কিছু পড়বেন, বলেছেন সবাই। সকালে সেমাই-মাংস রান্না করে ডাক দেবেন বান্ধবীদের। সবাই মিলে রিকশা করে ঘুরতে বের হবেন বিকেলে।

হোচিমিনের পছন্দ মেরুন রঙ। অংকিতার নীল আর সাদা। শপিং মেঘার প্রিয় এক্টিভিটি। ইচ্ছা সুযোগ পেলেই অনলাইন আর দোকানে ঘুরে ঘুরে দেখেন হালের ট্রেন্ডস।

ঈদের শপিং চলছে পুরোদস্তুর। অংকিতা আর মেঘা শাড়ি বলতে পাগল। ইচ্ছার ওয়েস্টার্ন গেটাপ বেশি পছন্দ। হোচিমিন সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বিবি রাসেল বা মেধাবী কোন দেশি ডিজাইনারের তৈরি পোশাকে।

মেঘা নিজের ছবি তুলতে ভালবাসেন। প্রচুর তোলেনও ইন্সটাগ্রামের জন্য। ফলো করেন বিশ্বের নামী-দামী মডেলদের। শাড়ি, চুড়ি, ব্লাউজ, গলার হার, আংটি সব নিজের পছন্দে কেনা বা বানানো। পুরো গেটাপে খরচ পড়েছে দশ হাজার টাকার কম।

ক্লাস সিক্স থেকে টিউশনি করে নিজের খরচ চালান অংকিতা। বাবা মা তাঁকে মেনে নিয়েছেন। আত্মীয়রা মেনে নেয়নি এখনও। সুন্দর সাজানো সংসার হবে, বাচ্চা থাকবে, স্বামী থাকবে, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি থাকবে – এমনটা ভাবতেন ছোটবেলায়। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সিঙ্গেল মা হিসেবে এডাপশন বা সারোগেসির কথা ভাবছেন এখন।

ছেলেবেলায় তসলিমা নাসরিন পড়ে হোচিমিন জেনেছিলেন সেক্স চেঞ্জ অপারেশনের কথা। ইন্টারের পর বাবা মারা গেলে বাধ্য হন সংসারের হাল ধরতে। ট্রান্স রাইটস এক্টিভিস্ট হিসেবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আছে তাঁর। সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে সংসদে যেতে চান একসময়।

নিজের পোশাক নিজেই ডিজাইন করেন ইচ্ছা। কৈশরে বিউটি কুইন হবার অনেক সাধ ছিল। এখন হাতের কাছে যে কাপড়ই পান, বানিয়ে ফেলেন মনমত কোন ড্রেস বা গাউন।

স্কুল পড়ুয়া ছোট ভাই বাদে বাসায় আর কেউ এখনও পুরোপুরি মেনে নেয়নি ইচ্ছার রূপান্তর। বাবা বাসায় থাকলে ঘর থেকেই বেরুন না তিনি। চুল না কাটলে ইউনিভার্সিটির ট্যুইশন দেয়া হবে না – পারিবারিক এ সিদ্ধান্তের পর বব কাট দিয়েছিলেন। এখন আবার চুল বড় করছেন।

সুযোগ পেলেই একসাথে সময় কাটানো হয় সবার। দৈনন্দিন আলাপ-আড্ডার পাশাপাশি আলোচনা চলে ট্রান্স-ফেমিনিজম কিংবা সোস্যাল ওয়ার্ক নিয়ে।

মেঘা, অংকিতা, ইচ্ছা বা হোচিমিন, সবাই ছোটবেলা থেকে নানান বুলিইং বা সেক্সুয়াল এবিউজের শিকার হয়েছেন। সেক্স লাইফ নিয়ে ট্রমা কাজ করে এখনও। হোচিমিন বলেন, “একটা ডেটের পর যখন রিয়েলাইজ করি মানুষ হিসেবে আমার কোন ঘাঁটতি নেই, বলে বোঝাতে পারব না কি যে ভাল লেগেছিল”।

সারাদিনের ফটোশ্যুট শেষে স্টুডিওর ওয়াশরুমে মেক আপ তুলছেন ইচ্ছা। এরপর ছেলেদের পোশাক পরে বাড়ি ফিরবেন। গত জন্মদিনে বাবা বাসায় ছিলেন না, তাই সাহস করে শাড়ি পরেছিলেন, সেলফি তুলেছিলেন ভাই বোনের সাথে।