ব্যস্ততম নগরজীবনে রান্না করে খাওয়া অনেক সময়ই বিরাট ঝক্কির কাজ হয়ে দাঁড়ায়। প্রায় সময়ই নানানরকম খাবার দাবার নিজে বানিয়ে খাওয়ার সময় থাকে না। আবার হাতের কাছে সবসময় সব উপকরণও থাকে না। বিশেষ করে কর্মজীবী আর একা থাকা লোকজনের জন্য এ এক বিরাট সমস্যাই বটে। তাছাড়া অফিস টাইম, ট্রাফিক জ্যাম সবকিছু মিলিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় বাইরে কাটাতে বাধ্য হতে হয়। এরপর সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্তি চেপে ধরে। সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন তাই ডাল, আলু সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধর বাইরে আর কিছু করার সময় হয়ে ওঠে না। আবার বন্ধু বান্ধব, পরিবার ও আত্মীয় স্বজন নিয়ে সাপ্তাহিক আড্ডা, উৎসব, গেটটুগেদার ইত্যাদিতেও রান্নার ঝামেলা পোহাতে হলে বিশ্রাম নেয়া হয় না।
তবে নিজে রান্না না করেও ঘরে তৈরি মজার মজার সব আইটেম, পোলাও,বিরিয়ানি, কাবাব থেকে শুরু করে খুদের ভাত, ভর্তা কিংবা বিশেষ উৎসবের বিশেষ খাবার-দাবার ঘরে বসেই খেতে পারার উপায় এখন হাতের নাগালেই আছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অনলাইন ফুড ডেলিভারি। বিশেষ করে করোনার সময় থেকে এ ধরণের উদ্যোগের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করেছে। আর এই খাবারের ব্যবসাগুলোর বেশিরভাগই সামলাচ্ছেন নারী উদ্যোক্তারা। অনলাইনভিত্তিক বলে সাড়াও মিলছে। কারণ মানুষ এখন ঘরে বসে ঘরোয়া পরিবেশে তৈরি স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতেই বেশি পছন্দ করছে। তাছাড়া অনলাইনভিত্তিক প্রচুর ডেলিভারি সার্ভিসও গড়ে উঠেছে, যারা উদ্যোক্তাদের তৈরি বাসার খাবার সময়মতো হাজির করছে ক্রেতাদের সামনে। বড় বড় অনুষ্ঠানের খাবার, এমনকি চল্লিশ-পঞ্চাশজনের খাবারের অর্ডারও নিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। হাঁস ভুনা, কবুতর ভুনা, গরুর ভুড়ি, খুদের ভাত, নানান রকম ভর্তা, হালুয়া, চালের রুটি, ছিটরুটি, চিতই পিঠা, তালের বড়া, খেজুর গুড়ের পায়েসসহ নানান ধরনের দেশী খাবার যা অনেকদিন আগে হয়তো মায়ের হাতে খেয়েছিলেন সেগুলোও আপনার সামনে হাজির করে দিচ্ছেন এইসব উদ্যোক্তারা। তার সাথে সাথে অর্জন করছেন ক্রেতার সন্তুষ্টিও।
সাধারণত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে পেজ খুলে ফুড সার্ভিস দেন অনলাইন উদ্যোক্তারা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের থাকে না কোনো দৃশ্যমান দোকান বা আউটলেট। ফেইসবুক পেজে খাবারের ছবি, পরিমাণ, দাম, অর্ডার করার প্রক্রিয়া, ডেলিভারি চার্জ ইত্যাদি দেয়া থাকে। ক্রেতারা খুদে বার্তা বা ফোন কলের মাধ্যমে খাবার অর্ডার করে থাকেন।
যেহেতু মানুষ অনলাইনে খাবার কিনছেন এবং উৎসবের জন্য খাবার খুঁজছেন তাই এবারও রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে অনলাইন ফুড সার্ভিসগুলো কিছু বিশেষ খাবারের আয়োজন করেছে। এ ধরণের উদ্যোগের সাথে জড়িত কয়েকজনের সাথে ভয়েস অফ আমেরিকা বাংলা সার্ভিসের পক্ষ থেকে কথা বলি। তাদের কাছ থেকে জানতে পারি কী কী খাবার তারা তৈরি করছেন, আসন্ন ঈদ-উল-ফিতরে কী বিশেষ খাবার পাওয়া যাচ্ছে তাদের উদ্যোগে, এসব খাবারের ক্রেতা কারা সহ বিভিন্ন বিষয়।
এন’স কিচেন
এন’স কিচেনের স্বত্বাধিকারী ফাতেমা আবেদীন নাজলা। ২০২০ সাল থেকে অনলাইনে খাবার সরবরাহ শুরু করেছেন। ২০১৬ সালে ‘রূপচাঁদা দ্যা ডেইলি স্টার সুপার শেফ’ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় রানার আপ হওয়ার পর বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগদের উৎসাহেই যেকোনো উৎসবে, গেটটুগেদারে রান্না করা খাবার সাপ্লাই দিতে শুরু করেন। এভাবেই যাত্রাটা শুরু হয়।এন’স কিচেনে পাওয়া যায় ভাত, মাছ,ডাল, শাকসবজি, ভর্তা সহ দেশীয় সকল খাবার। জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে আছে তেহারি, চাওমিন, চিকেন ফ্রাই, স্যান্ডউইচ, পোলাও, চিকেন রোস্ট, বিফ রেজালা, টিকিয়া, ঝাল মাংস ইত্যাদি। এখানে রমজানের সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ হালিম। এছাড়াও কাঁচা আমের শরবত, তেহারি, চাওমিনও বেশ বিক্রি হচ্ছে। ঈদ-উল-ফিতরের আয়োজনেও থাকছে ট্র্যাডিশনাল উৎসবের খাবারগুলো। তার পাশাপাশি থাকছে স্পেশাল শাহী জর্দা। এছাড়া আছে ফ্রোজেন কলিজা সিঙ্গারা, চিকেন টিকিয়া, রোল, সমুচা ইত্যাদি। এন’স কিচেন থেকে পুরো ঢাকা শহরেই খাবার ডেলিভারি করার ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকার অদূরে সাভার ও কেরানীগঞ্জেও খাবার সরবরাহ করা হয়। সাধারণত একদিন আগে অর্ডার দিলেই খাবার সরবরাহ করেন তারা। নাজলা জানালেন, এন’স কিচেনের গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে সমাজের নানা স্তরের মানুষ।
কর্মজীবী, ব্যাচেলর, কর্পোরেট ক্লায়েন্ট যেমন রয়েছে, তেমনি পরিবার, বন্ধুবান্ধবের জন্যও খাবার নেন গ্রাহকেরা।করোনার সময়ে রোগীদের জন্যও খাবার সরবরাহ করেছে এন’স কিচেন। এমনকি আইসিউতে থাকা রোগীদের জন্যও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করছেন তারা। অনেক প্রবাসীও দেশে থাকা তাদের প্রিয়জনদের জন্য খাবার অর্ডার করেন। নাজলা বললেন, “এটা খুবই মজার বিষয়। অনেকেই বিদেশ থেকে যোগাযোগ করে বাবা-মা, ভাই-বোন কিংবা আত্মীয়ের বাসায় খাবার পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ করেন। জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকীসহ বিশেষ দিনগুলোয় পরিবারের জন্য খাবার পাঠিয়ে আনন্দ ভাগ করে নিতে চান প্রবাসীরা। এবারও ঈদের আগের দিন বা ঈদের দিন আপনজনদের খাবার পাঠানোর জন্য অনেক প্রবাসী খাবারের বুকিং দিয়ে রেখেছেন।”
কেক ম্যানিক
কেক ম্যানিকের উদ্যোক্তা কুষ্টিয়ার রুবাইদা আদনীন মিম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি না খুঁজে নিজের এই স্বাধীন ব্যবসাটি খুঁজে নিয়েছেন। রুবাইদা কুষ্টিয়াতেই থাকেন। ২০১৯ সালের শেষের দিক থেকে খাবারের উদ্যোগটি শুরু করেন। শুরুটা ছিলো কিছুটা অন্যরকম। প্রথমদিকে কুষ্টিয়াতে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে চায়ের দোকানগুলোতে হোমমেড কেক বিক্রি করতেন। এভাবেই ধীরে ধীরে অগ্রসর হন এবং কেক ম্যানিক নামে ফেসবুকে পেজ খুলেন। বিভিন্ন ধরণের জন্মদিনের কেক, পাউন্ড কেক, কাপ কেক, ব্রাউনি নিয়মিত করে থাকেন। তবে তাঁর উদ্যোগের ঈদের স্পেশাল আইটেম হোমমেড লাচ্ছা সেমাই। লাচ্ছা সেমাই তিনি সারা বাংলাদেশে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সরবরাহ করছেন। এবার সেমাইয়ের প্রচুর অর্ডার পাচ্ছেন। বললেন, “ঈদ-উল-ফিতরকে বলা হয় সেমাইয়ের ঈদ। এই ঈদে প্রতিটি বাসায় সেমাই রান্না করা হয়। অথচ সেমাইয়ের কারখানাগুলোতে খুব অস্বাস্থ্যকর উপায়ে সেমাই তৈরি হয়। তাই অনেকেই এখন বাসায় তৈরি সেমাই কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন।” এছাড়াও তিনি কুষ্টিয়া শহরে নিয়মিত কেকের অর্ডার নেন। জানালেন, গ্রাহকদের একটা বড় অংশ আছেন যারা দেশের বাইরে থাকেন। কুষ্টিয়া শহরে থাকা প্রিয়জনদের বিশেষ দিনগুলোতে সারপ্রাইজ দিতে তারা রুবাইদার দ্বারস্থ হন। সাধারণত দুই থেকে তিনদিন আগে কেক ম্যানিকে অর্ডার দিতে হয়।
টেস্ট এন বাইট
ফারজানা আফরোজ ২০২০ সালে যাত্রা শুরু করেন টেস্ট এন বাইট নিয়ে। পথ চলার শুরুটা তার জন্য কঠিন ছিলো। একজন সিঙ্গেল মাদার হিসেবে সন্তানের দায়দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের একটা পরিচিতি গড়ে তোলার ইচ্ছে থেকেই ঘরে বসে শুরু করেন অনলাইনে খাবারের ব্যবসা। রান্নার প্রতি ভালোবাসা ছিলো ছোটবেলা থেকে। সেটাকেই সঙ্গী করে শুরু করেন পথচলা। টেস্ট এন বাইট থেকে নিয়মিত পাওয়া যায় ফ্রোজেন সিঙ্গারা, সমুচা, আলু-কিমা কাবাব, রোল, রুটি, পরোটা, হোমমেড চার ধরনের ব্রেড, ফ্রুট কেক, পাউন্ড কেক, জার কেক, পান্না কোটা, নবাবী সেমাই, এগ পুডিং, ডাবের পুডিং, নকশি পিঠা, খেজুর পিঠা ইত্যাদি। ফারজানা বললেন, টেস্ট এন বাইটের নবাবী সেমাই ও ডাবের পুডিং খুব বেশি পছন্দ করে সবাই। এছাড়া অন্যান্য আইটেমগুলোরও নিয়মিত গ্রাহক রয়েছে। ক্রেতাদের মধ্যে কর্মজীবি ও ব্যাচেলর বেশি। পুরো ঢাকা শহরেই খাবার সাপ্লাই দিয়ে থাকেন। কমপক্ষে দুই দিন আগে খাবারের অর্ডার করলে গ্রাহকের চাহিদা মোতাবেক খাবার সরবরাহ করতে পারেন বলে জানালেন। ঈদের জন্য নবাবী সেমাই, চাওমিন, চিকেন সাসলিক, চিকেন টিক্কা মাসালা, বাটার নান আরো কিছু আইটেম এনেছেন তিনি। গ্রাহকদের সুবিধার জন্য সুলভ মূল্যে ছোট ছোট প্যাকেজের ব্যবস্থা করেছেন।
সারারা’স অর্গানিক কিচেন
২০২০ সাল থেকে সারারা’স অর্গানিক কিচেন অনলাইনে খাবার সরবরাহ করে যাচ্ছে। মূলত লাঞ্চ বা ডিনারের জন্য প্রধান খাবার অর্থাৎ পোলাও-রোস্ট, তেহারি, খুদের ভাত ও কয়েক রকমের ভর্তা, ফ্রাইড রাইস, চিকেন ফ্রাই, চিলি চিকেন, সবজি, মালাই জরদা, পুডিং, নবাবী সেমাই ইত্যাদি করা হয়। রমজান মাসে ইফতার উপলক্ষ্যে মোরগ পোলাও, চিকেন বিরিয়ানির প্যাকেজ করা হয়েছে। এর সঙ্গে থাকছে পেয়াজু, আলুর চপ, বেগুনি, ছোলার একটি বক্স। এছাড়া গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ীও খাবারের প্যাকেজ তৈরি করা হয়। সারারা’স কিচেনের স্বত্বাধিকারী সুমী সুলতানা। সুমী ২০২০ সালে উদ্যোক্তাদের একটা ফেইসবুকভিত্তিক গ্রুপ থেকে প্রথম কাজ শুরু করেন। সুমী জানালেন তাঁর কিচেন থেকে ঈদের বিশেষ আয়োজনের মধ্যে থাকছে মুরগীর রোস্ট, গরুর মাংসের রেজালা ও কালা ভুনা, ফ্রোজেন চিকেন সাসলিক, ফ্রোজেন চিকেন চাপ। এছাড়া অন্যান্য মেন্যুগুলোতো থাকছেই। ঈদের আগেরদিন পর্যন্ত এ খাবারগুলো সারারা’স অর্গানিক কিচেন থেকে সরবরাহ করা হবে। ঢাকা শহরের সব জায়গাতেই খাবার ডেলিভারি দেয়া হয়।
সমাজের সব স্তরের গ্রাহক খাবার নেন বলে জানালেন সুমী সুলতানা। এছাড়া পারিবারিক, সামাজিক যে কোনো অনুষ্ঠানে, অফিসিয়াল গেটটুগেদারের জন্যও গ্রাহকরা খাবার নিয়ে থাকেন। অনেক কর্পোরেট ইভেন্টের খাবার সরবরাহ করেন বলে জানালেন। করোনার সময়ে বেশ কিছু করোনা আক্রান্তদের বাসায় খাবার ডেলিভারি দিয়েছেন সুমী। করোনার সময়ে থেকে এখন অর্ডার বেশি পাচ্ছেন বলে জানালেন। বড় বড় অনুষ্ঠানের খাবারের অর্ডারই বেশি পাচ্ছেন।