করোনায় কর্মজীবন নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিষণ্নতা ও মানসিক চাপ বেড়েছে—শাবিপ্রবির গবেষণা

মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার এবং জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে আছে। (ছবি- ইউএনবি)

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে বিষণ্নতা ও মানসিক চাপ তাদেরকে ভয়ানক স্বাস্থ্য ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কোভিড-১৯ চলাকালে এই বিষণ্নতা ও মানসিক চাপ কয়েকগুণ বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই মানসিক চাপ ও হতাশার পেছনে অন্যতম কারণ কোভিড-১৯ মহামারিতে কর্মসংস্থানের নিরাপত্তাহীনতা।

সম্প্রতি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. জামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে তিনজন শিক্ষার্থী উপমা চৌধুরী, মো. আহসান হাবিব শুভ্র ও সৈয়দ মো. ফারহানের একটি গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।

তাদের গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের করোনা মহামারিতে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে মানসিক অবস্থা এবং হতাশা বৃদ্ধি পায় কি না তা যাচাই করা। গবেষণাটি পরিচালিত হয় ২০২০-২১ সালে এবং সম্প্রতি এর ওপর ভিত্তি করে একটি গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ৬২ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষ এবং মাস্টার্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ওপর পরিচালিত এ গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ (৮০ শতাংশ) শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্নতা রয়েছে এবং ৭০ শতাংশ মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে।

ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের পাশাপাশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ও মানসিক চাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীরাই দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বিষণ্নতা ও মানসিক চাপের শিকার। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের ধারণা কোভিড ১৯ মহামারির কারণে তাদের ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান অনিশ্চিত, তাদের বিষন্নতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।

গবেষণায় দেখা গেছে, উপযুক্ত চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা এবং স্নাতক সম্পন্ন হওয়ার সময়ের সঙ্গে নেতিবাচকভাবে সম্পর্কিত ছিল। আজকাল বেশির ভাগ বেসরকারি কোম্পানি ভালো উদ্ভাবনী এবং সহজেই মানিয়ে নিতে পারে এমন যুবকদের পছন্দ করে। তাই শিক্ষার্থীদের স্নাতক বিলম্ব হওয়ায় তাদের এই সুযোগও বিলম্ব হচ্ছে, যা তাদের অধিক হতাশা ও মানসিক চাপে রাখছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিভাগ ইন্টার্নশিপের সুযোগ দিয়ে থাকে অথবা ইন্টার্নশিপ তাদের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত সেসব শিক্ষার্থীরা বাকি শিক্ষার্থীদের তুলনায় ৩৬ শতাংশ কম বিষণ্নতা এবং মানসিক চাপে ভোগে। যেসব শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিভাগ কোনো ধরনের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কোনো কার্যক্রম বা কোর্সের ব্যবস্থা করে অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে থাকাকালে মাঠ পর্যায়ের যেসব কাজের অভিজ্ঞতা থাকে তা দেওয়ার সুযোগ করে দেয়, সেসব শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে বিষণ্নতা কম পাওয়া গেছে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ ধরনের কার্যক্রমের সুযোগ করে দেয় সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিষণ্নতা ৪৬ শতাংশ কম পাওয়া যায়।

গ্র্যাজুয়েশন বিলম্বিত হওয়া, উপযুক্ত চাকরি পাওয়ার জন্য দক্ষতার অভাব, স্টার্টআপ প্ল্যান এবং তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ইন্টার্নশিপ সুবিধা না পাওয়া হতাশা ও মানসিক চাপে বড় অবদান রাখছে। গ্রাজুয়েশনের পর অনলাইন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রোগ্রাম এবং ইন্টার্নশিপ প্রদানের মাধ্যমে পরিস্থিতি রোধ করতে সরকারের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহযোগিতা করা উচিত, যাতে তারা তাদের মানসিক চাপ মুছে ফেলতে পারে এবং হতাশা ও চাপ কাটিয়ে উঠতে পারে।

বর্তমানে এই মানসিক চাপ ও হতাশা থেকে শিক্ষার্থীদের কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রোগ্রাম আয়োজন করা উচিত।

মূলত এই মানসিক চাপ, হতাশা বা বিষণ্নতার পেছনে যে কারণগুলো যেমন তাদের দক্ষতার অভাব এবং তাদের ইন্টার্নশিপের সুযোগ দেওয়া হয় না, এইসব ব্যাপারগুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সরকার এবং নীতি নির্ধারক সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।

নারী গ্রাজুয়েটরা অধিক বিষন্নতার শিকার পুরুষদের তুলনায়। কারণ বেশির ভাগ নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তাদের কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা কম থাকে এবং তাদের বিভিন্ন পেশার মানুষ যারা কর্মসংস্থানের সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে অধিক যোগাযোগ স্থাপন হয় না। যেসকল শিক্ষার্থীরা শুধু পাঠ্যক্রমভিত্তিক পড়াশোনা করে থাকে তাদের ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকে না। সেক্ষেত্রে এসব শিক্ষার্থীদের হতাশা এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়। তাই শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ইন্টার্নশিপের সুযোগ প্রদান করার মাধ্যমে তাদের মানসিক হতাশা ও চাপ কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করা সম্ভব।

তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত তারা যেন এসকল শিক্ষার্থীদের শিল্প সফর এবং ইন্টার্নশিপের আওতায় এনে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবন সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা দেয়।