রমজান মাসে নিত্যদিনের নিয়মগুলো হঠাৎ করেই পাল্টে যায়। রুটিনের পরিবর্তন প্রভাব পড়ে মনে, শরীরে। এতে অনেকের শরীরবৃত্তীয় কিছু সমস্যাও দেখা দিতে পারে। রোজা রেখে, এতো বেশি সময় ধরে না খেয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। খাবার ও ঘুমের রুটিনের পরিবর্তনের কারণে গ্যাসের সমস্যা, রক্তে সুগার লেভেলের ওঠা-নামা, ব্লাডপ্রেশার লো বা হাই হয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে যাদের দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা রয়েছে ; যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির সমস্যা তাদের জন্য কিছু নিয়ম ও ডাক্তারের পরামর্শ মেনে রোজা রাখা জরুরি। গর্ভবতী মায়েদের রোজা রাখা নির্ভর করে স্বাস্থ্যপিরিস্থিতির ওপর। তাই রমজান মাসে সুস্থ থাকতে সবার জন্যই খাবার, ঘুম, ওষুধ ও ব্যায়ামের সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
রমজানে কীভাবে শরীরের যত্ন নিবেন, কীভাবে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য ও সিয়াম সাধনার সমন্বয় ঘটাবেন সে ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন বারডেম হাসপাতালের পুষ্টি বিভাগের প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান শামসুন্নাহার নাহিদ মহুয়া।
রমজানে যা খাবেন, যা খাবেন না
- এই গরমে রোজা রাখলে প্রথমেই খেয়াল রাখতে হবে, যেন ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা না হয়। প্রতিদিন আড়েই লিটার থেকে ৩ লিটার পানি খাওয়া উচিত এবং সেটাও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে।
- ইফতারিতে যতটা সম্ভব পানি বা তরল খাবার খেতে হবে। যেমন: শরবত, মৌসুমী ফলের রস, ডাবের পানি। এছাড়া যে কোনো রসালো ফল যেমন: বাঙ্গি, তরমুজ, আনারস, বাতাবি লেবু খাওয়া যেতে পারে।
- স্বাভাবিক সময়ের সারাদিনে খাবার ভাগ করতে হবে ইফতার, সন্ধ্যা রাত ও সেহেরিতে।
- ইফতারে ভাজা, ভুনা যথাসম্ভব বাদ দিয়ে দুধ/দই-চিড়া, সাগু, দই দিয়ে লাস্যি, ফালুদা ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া আমিষ খাবার, যেমন: চিকেন, চিকেন স্যুপ, ডিম এগুলোর যে কোনো একটি ও প্রচুর পরিমাণে কাঁচা সবজি ও ফলের সালাদ থাকতে পারে।
- ইফতারের পরিমাণ যেন অনেক বেশী না হয়। সন্ধ্যারাতের খাবার বাদ দেয়া উচিত নয়। তারাবীহর নামাজের পর, অল্প পরিমাণে হলেও, খাবার খেতে হবে।
- সেহরির খাবারটি খেতে হবে সেহরির জন্য বরাদ্দ সময়ের মধ্যে, ডায়াবেটিস রোগীরা একটু দেরিতে খাবেন। খাবারটি পূর্ণাঙ্গ হতে হবে। অর্থাৎ দুপুরের খাবারের সমপরিমাণ।
ডায়াবেটিস রোগীর করণীয়
- ডায়াবেটিস রোগী সব খাবার খেতে পারবেন। তবে, সরাসরি মিষ্টি খাবার বাদ দিতে হবে। ইফতারে চিনি, গুড় বা মধুর তৈরি শরবত, খাবার খাবেন না।
- সেহরিতে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দুধ-ভাত-কলা, দুধ-ভাত-আম, এ ধরণের খাবার খেতে অভ্যস্থ। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের জন্য পরামর্শ হলো , কখনওই তিনটি কার্বোহাইড্রেট একসাথে মিলিয়ে খাবেন না। দুধ-ভাত অথবা ভাত-কলা/আম এভাবে খেতে পারেন। তিনটি কার্বোহাইড্রেট মিলিয়ে খেলে সরাসরি চিনি খাওয়ার মতোই শরীরে ব্লাড সুগারের পরিমান বেড়ে যাবে। এর ফলে ডায়াবেটিস রোগীর হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- যেসব ডায়াবেটিস রোগী মুখে খাওয়ার ওষুধ ও ইনসুলিন নেন, তাদের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম হলো, সকালে ওষুধ বা ইনসুলিনের ডোজটা ইফতারে নেবেন আর রাতের ডোজের হাফ ডোজ সেহরিতে নেবেন। তবে ব্লাডসুগার টেস্ট করে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধের ডোজ ঠিক করে নেয়াই বেশি ভালো। কারণ অনেকের তিনবেলা এমনকি চারবেলাও ইনসুলিন নিতে হয়। তাই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে ডোজ অ্যাডজাস্ট করে নিয়ে রোজা রাখার চেষ্টা করতে হবে।
- ডায়েবেটিস রোগীরা সেহরির পরে না ঘুমিয়ে দুপুরের আগ পর্যন্ত দিনের প্রয়োজনীয় কাজগুলো করবেন। দুপুরের পরে যতটা সম্ভব বিশ্রাম নিতে হবে। কারণ দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকার ফলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই একে প্রতিরোধ করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো দুপুরের পর থেকে কায়িক পরিশ্রম কম করা । তবে বাড়ির নারী সদস্যরা এ সময়ে ইফতার তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকেন। যদি তারা ডায়াবেটিস রোগী হয়ে থাকেন, তাহলে সকালের দিকেই কিছু কাজ গুছিয়ে রাখতে পারেন। আর বাড়িতে ডায়াবেটিস নেই এমন সদস্যের সাহায্য নিয়ে বিকেলে ইফতার তৈরির বাকি কাজ শেষ করতে পারেন। এভাবে নিয়ম মেনে চললে যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা সুস্থ থেকে রোজা রাখতে পারবেন। হাইপোগ্লাইসেমিয়া ও হাইপারগ্লাইসেমিয়া এড়াতে পারবেন।
- রোজা রেখে গ্লুকোমিটার ব্যবহার করে ব্লাডসুগার টেস্ট করা যায়, কারণ মাত্র এক ফোঁটা রক্ত ব্যবহার করে এই মেশিনে ব্লাডসুগার টেস্ট করা হয়। তাই যদি রোগী রোজা রেখে অসুস্থ বোধ করেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে গ্লুকোমিটার দিয়ে রক্ত পরীক্ষা করে ব্লাডসুগার পরিমাপ করে নিতে পারেন।
- রোজা রেখে ইনসুলিন নেয়া যায়, কারণ ইনসুলিন নেয়া হয় চামড়ার নিচে। শরীরের এ জায়গায় রক্তের উপস্থিতি থাকে না। ফলে রোজা ভাঙার সম্ভাবনা নেই। রোজাদার ব্যক্তি ইফতারের ১৫ মিনিট আগে তার প্রয়োজনীয় ডোজের ইনসুলিন নিতে পারবেন।
উচ্চরক্তচাপের রোগীর করণীয়
- উচ্চরক্তচাপের রোগীরা লবণাক্ত খাবার বা যে সব খাবারে আলাদা করে লবণ যোগ করা হয়, সে সব খাবার এড়িয়ে চলবেন।
- পনির, শুটকি মাছ, মুড়ি, বাজারের নুডুলসের প্যাকেটে দেয়া মশলা, প্যাকেটের স্যুপ, এসব খাবারে অরিতিরিক্ত লবণ থাকে। তাই এগুলো বাদ দিতে হবে।
- চর্বি জাতীয় খাবার কম খেতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাদ দিতে হতে পারে।
- যারা উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ খান, চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে।
কখন ঘুমাবেন
পর্যাপ্ত ঘুম খুব জরুরী। সন্ধ্যা রাতের খাবারের পর অবশ্যই ঘুমাতে হবে। অনেকে এই রাতে না ঘুমিয়ে সেহরি পর্যন্ত জেগে থাকেন। এটি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে হবে।
রোজায় ব্যায়াম
- একজন সুস্থ ব্যক্তি ইফতারের পরে ব্যায়াম করতে পারেন। ইফতারের আধা ঘন্টা থেকে ৪৫ মিনিট পরে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট হাঁটতে পারেন।
- ডায়াবেটিস রোগীরা যদি এই রোজার মাসে নিয়মিত বিশ রাকাত তারাবীহ নামাজ দাঁড়িয়ে পড়েন, সেক্ষেত্রে তাদের আলাদা করে ব্যায়াম করার প্রয়োজন নেই।
যাদের জন্য রোজা রাখা স্বাস্থ্যসম্মত নয়
- গর্ভবতী নারীর যদি প্রথম তিন মাস কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যা বোধ না করেন তাহলে রোজা রাখতে পারেন। তবে, তাকে গর্ভকালীন ডায়েট ফলো করতে হবে।
- গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক থেকে সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়ার আগ পর্যন্ত, ভ্রুণের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। তাই, এ সময়টা খাবারের চাহিদা খুব বেশি থাকে। এ সময়ে গর্ভবতী মাকে প্রচুর খেতে হয়। রোজা রেখে খাবারের এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়।
- ১৩-১৪ ঘন্টা না খেয়ে থাকলে শরীরে যে পানিশূন্যতা তৈরি হয়, তা থেকে গর্ভবতী মায়ের ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স হতে পারে, গর্ভস্থ শিশুর পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। তাই এ সময়ে রোজা না রাখাই ভালো।
- যদি কারো ডায়েবেটিক প্রেগনেন্সি থাকে, তার জন্যও রোজা না রাখার পরামর্শ রইলো।
- যাদের কিডনির সমস্যা আছে, কিডনির অসুখ ২য় থেকে ৪র্থ পর্যায়ের মধ্যে আছে, কিংবা ডায়ালাইসিস করতে হয়, তাদের জন্য রোজা রাখা স্বাস্থসম্মত নয়।
- অসুস্থ অবস্থায় ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখা ঠিক নয়। হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া দেখা দিলে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে।