বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে শ্রেণিকক্ষে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ইসলাম ধর্মকে অবমাননার অভিযোগে গত ২২ মার্চ বাদী হয়ে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আসাদ। ওই দিনই শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ২৩ মার্চ ও ৪ এপ্রিল আদালতে হৃদয় মণ্ডলের জামিন চাওয়া হয়েছে। তবে আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। এরপর থেকে তিনি কারাগারেই রয়েছেন।
এর আগে গত ২০ মার্চ বিদ্যালয়টির দশম শ্রেণির মানবিক শাখার বিজ্ঞান ক্লাস নিচ্ছিলেন হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। সেখানে একটি বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কয়েকজনের পক্ষে-বিপক্ষ কথোপকথন হয়। একপর্যায়ে কোনো একজন শিক্ষার্থী ওই কথোপকথনের ভিডিও ধারণ করেন এবং বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দীনকে জানান। প্রধান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। এই ঘটনা শিক্ষার্থীরা স্থানীয়দের জানায়। পরদিন সকালে স্থানীয়রা বিদ্যালয়ে এসে ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তারের দাবিতে স্লোগান দেন। এরপর পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে ও শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে আটক করে নিয়ে যায়।
এই ঘটনায় নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষ থেকে কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া জানতে যোগাযোগ করা হয়। নিচে তাদের বক্তব্য তুলে ধরা হল:
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল
শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক
মুন্সিগঞ্জের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের সাথে যা হয়েছে তা আমার জন্য অত্যন্ত দুঃখের। দুঃখের এই কারণে যে, আমি শিক্ষকতা জীবনে বিজ্ঞানই পড়িয়েছি ছাত্র-ছাত্রীদের। আরও বেশি দুঃখের কারণ এই জন্য যে, দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বই যেটি বাংলাদেশের হাইস্কুল পর্যায়ে পড়ানো হয় সেটি সম্পাদনার সাথে আমি জড়িত। আমার সম্পাদনা বা রচিত একটি বই বাচ্চাদের যেখানে এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি, এই বই পড়ান এমন একজন শিক্ষককে করাগারে যেতে হয়েছে, এই দুঃখের তো কোনো শেষ নাই। আমি শুধু একটি কথাই বলতে চাই শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে সসম্মানে মুক্তি দিতে হবে। নইলে আমাকেও যেন গ্রেপ্তার করা হয়।
ড. কাবেরী গায়েন
অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মুন্সিগঞ্জে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে যে অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা বিস্তারিত দেখলাম। ওই ঘটনার কথপোকথনের একটি বিবরণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখতে পেলাম শিক্ষক হিসেবে হৃদয় মণ্ডল খুবই যৌক্তিক কাজটিই করেছেন। তার শিক্ষার্থীদের তিনি সঠিক পদ্বতিতেই বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। সেই আলাপের রেকর্ড করে তাকেই ফাঁসানো হলো। এখন আমাদের দেশে কোনো কিছু ঘটলে সেটিকে যেকোনো উপায়েই হোক ধর্মীয় দিক থেকে বিবেচনা করা হয়। ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার এই প্রবণতা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সব মহলেই দেখা যায়। এখন পরিস্থিতিটা আগের মতো নাই! আমরা যখন পড়াশোনা করেছি, মনে করতে পারি, সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাঙামাটি কলেজে সেখানেও আমাদের স্কুল কলেজে বিজ্ঞান বিষয়ক বই পাওয়া যেত। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী থেকে শুরু করে গল্প উপন্যাস পাওয়া যেত, সেসবের একটি চর্চা হতো। এখন তা আর নেই। সকল স্তরেই ধর্মকে মুখোমুখি নিয়ে আসার একটি প্রচেষ্টা থাকে। হৃদয় মণ্ডলের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এর আগেও আমরা দেখেছি এমন ঘটনায় যাকে আটক করা হয় রাষ্ট্রও সঠিক বিচার করতে পারছে না। হৃদয় মণ্ডলকে জামিন দেওয়া হল না। উল্টো বলা হল, তাকে জামিন দিলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। তাই তাকে জামিন দেওয়া যাবে না। তাকে কারাগারে আটক রেখেই নিরাপত্তা দিতে হবে! কী আশ্চর্য রকম কথা! এমন জায়গায় এসে তাই কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিতে পারে- আমরা এই স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে তাহলে কোন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করলাম যেখানে একজন বিজ্ঞান শিক্ষকের নিরাপত্তা দেওয়া যাবে না?
একজন শিক্ষক হিসেবে আমি শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের নিঃশর্ত ও সসম্মানে মুক্তি চাই। পাশাপাশি প্রশ্ন রাখতে চাই যারা এই ঘটনার পেছনে ছিল তাদের কেন বিচারের আওতায় আনা হবে না? এই ঘটনার কেন নিরপেক্ষ তদন্ত হবে না? স্বাধীনতার এতো বছর পরেও কেন ৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ হাজার বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারিনি? কেন সেখানে যৌক্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে পারিনি- এই প্রশ্নগুলো আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কাছে করতে চাই।
ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ
অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
একজন বিজ্ঞান শিক্ষককে কারাগারে যেতে হয়েছে এটা খুবই দুঃখজনক। বিজ্ঞানমনস্ক জাতি হিসেবে আমরা যে গড়ে ওঠতে পারলাম না, এই শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের ঘটনা তার প্রমাণ। দেশ স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়েও বিজ্ঞান চর্চাকে আমরা বিস্তার করতে পারিনি। ধর্ম এবং বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ ছাড়াই আমরা লেখাপড়া করেছি। ধর্ম মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধ দিবে আবার বিজ্ঞান ছাড়া জীবন অপরিহার্য এটুকু মন রাখলে আমাদের এমন পরিস্থিতি দেখতে হতো না।
অধ্যাপক ড. আব্দুস সামাদ
ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমার মনে হয় এখানে একটি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান পড়িয়ে আসছি, কখনো এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি। বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য একজিন শিক্ষককে কারাগারে যেতে হবে এটা কোনো ক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। অচিরেই এই শিক্ষকের মুক্তি হওয়া উচিৎ এবং এখানে যে কারণে এই ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে হবে।
ড. আসিফ নজরুল
অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এই ঘটনাটিকে আমি অসহিষ্ণুতার একটি বড় উদাহরণ হিসেবে দেখছি। একইসাথে ‘একাডেমিক ফ্রিডম চর্চা’র পরিপন্থী বলেও মনে করছি। আমরা শিক্ষকেরা ক্লাসরুমে যার যা জ্ঞান আছে, চিন্তা আছে তা নিয়ে খোলা আলোচনা করি। এখন যদি কেউ সেইসব কথা রেকর্ড করে মামলা দিয়ে দেয় তাহলে তো আর একাডেমিক ফ্রিডমের বিষয়টাই থাকবে না। এটি খুবই একটি দুঃখজনক নজির স্থাপন করা হয়েছে। আমি অবিলম্বে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের মুক্তি দাবি করছি। আমি মনে করি, আমাদের সমাজকে সমস্ত ব্যাপারে ইতিহাস চর্চার ব্যাপারে, ধর্ম চর্চার ব্যাপারে, রাজনৈতিক চর্চার ব্যাপারে আর সহনশীল হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ড. অনুপম সেন
শিক্ষাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী
শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের সঙ্গে যা হয়েছে তা অমানবিক বললেও কম বলা হবে। এটা ঘটেছে মূলত অজ্ঞতার ফলে। একটি হাইস্কুলের শিক্ষক যিনি দীর্ঘবছর ধরে তার বাচ্চাদের গণিত এবং বিজ্ঞান পড়িয়ে আসছেন তাকে তার শিক্ষার্থীরাই আবার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ তুলছেন এটা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে! সমাজে আমরা যে এতোদিনেও যথাযথ শিক্ষা দিতে পারিনি এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তা-ই আবার দেখা গেল। বিজ্ঞান শিক্ষাকে সমাজের সর্বস্তরে এখনও সঠিকভাবে চর্চা করা হচ্ছে না শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের প্রতি যে অন্যায় করা হল এই ঘটনা তারই প্রমাণ।
মুক্তি চেয়ে ১৮ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি
এদিকে ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগে গ্রেপ্তার মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের নিঃশর্ত মুক্তি চেয়েছেন দেশের ১৮ বিশিষ্ট নাগরিক। এক বিবৃতিতে তারা শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের মুক্তি চেয়েছেন।
বিবৃতিতে তারা বলেছেন, ‘‘আমরা হৃদয় মণ্ডলের নিঃর্শত মুক্তি দাবি করছি। আর যে কিশোর ছাত্ররা মৌলবাদী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে অপমান করে পুলিশে সোপর্দ করেছে তাদের মধ্যে মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।’
গণমাধ্যমে প্রেরিত চিঠিতে বিবৃতিদাতারা হচ্ছেন- আবদুল গাফফার চৌধুরী, সৈয়দ হাসান ইমাম, ড. অনুপম সেন, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, সারওয়ার আলী, আবেদ খান, সেলিনা হোসেন, লায়লা হাসান, আবদুস সেলিম, মফিদুল হক, শফি আহমেদ, শাহরিয়ার কবীর, হারুন হাবীব, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মুনতাসীর মামুন, সারা যাকের ও শিমূল ইউসুফ।