রুবাইয়াত হোসেন বাংলাদেশী চলচ্চিত্র নির্মাতা। রুবাইয়াত ২০০২ সালে নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমি থেকে চলচ্চিত্র পরিচালনায় ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কলেজ থেকে উইমেন্স স্টাডিজে স্নাতক এবং পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দক্ষিণ এশীয় গবেষণা এবং নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিশ স্কুল অব আর্টস থেকে চলচ্চিত্র বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ইতিমধ্যে তার তিনটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। প্রথম ছবি মেহেরজান (২০১১) এবং দ্বিতীয় ছবি আন্ডার কনস্ট্রাকশন (২০১৫)। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে তার ‘শিমু’ সিনেমা। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে কানাডার ‘টরেন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল’-ছবিটির প্রিমিয়ার হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন নারী চলচ্চিত্র নির্মাতার চলচ্চিত্র নির্মাণের লড়াই, পারিবারিক-সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়া এবং তার সিনেমা ভাবনাসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষে তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন এহসান মাহমুদ।
ভয়েস অফ আমেরিকা: শুরুতেই আপনাকে অভিনন্দন জানাই । আপনার তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘শিমু’ বাংলাদেশের সিনেমা হলে মুক্তি পেল। এটির শুরুতে নাম ছিল- মেইড ইন বাংলাদেশ। সিনেমাটি এমন সময়ে মুক্তি পেল যখন নারী দিবস নিয়ে আলোচনা চলছে। আপনার ছবিটির কেন্দ্রিয় চরিত্রও নারী। মার্চ মাসে সিনেমাটি মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা ছিল কী?
রুবাইয়াত হোসেন : না বিষয়টি অমন নয়। নারী দিবসে মুক্তি দিতে বিশেষ প্ল্যান ছিল না। দেশের নারীর ক্ষমতায়নে ও আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে পোশাকশিল্পের যে ভূমিকা আছে তার আলোকে নারী পোশাক শ্রমিকদের সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প বলা হয়েছে ছবিটিতে। ‘শিমু’ প্রতিকূলতাকে জয় করে সামনে এগিয়ে চলা সংগ্রামী মানুষের গল্প। বাংলাদেশের যারা শ্রমজীবী নারী তারা যদি ছবিটা দেখেন, তাদের খুব ভালো লাগবে। কারণ, তাদের নিজেদের গল্পটাকে পর্দায় দেখতে পাবেন।
ভয়েস অফ আমেরিকা : একজন নারী নির্মাতা হিসেবে বাংলাদেশে কাজের পরিবেশ কেমন বলে মনে করেন?
রুবাইয়াত হোসেন : আমি যখন শুরু করেছিলাম, তখনকার চেয়ে এখনকার পরিস্থিতি একটু হলেও ভালো। এখন বেশ কিছু তরুণ নারী নির্মাতা ও প্রযোজক কাজ করছেন। এখন আমাদের সাদিয়া খালিদের মতো একজন নারী চলচ্চিত্র সমালোচক আছেন। আরও অনেকেই এ রাস্তায় হাঁটতে ইচ্ছুক। তবে নির্মাতা হওয়া এমন একটা ‘জব’, যেখানে আপনাকে অনেক বেশি চলাফেরা করতে হবে। বাংলাদেশে সেটা কঠিন। আমার পারিবারিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক—সব ধরনের সমর্থন ছিল। এমনকি আমার প্রথম ছবি ‘মেহেরজান’ নিয়ে একটা ‘হইচই’ পড়ে গেল, তখনো আমার পরিবার আমার পাশে ছিল। তবুও শুরুতে এ রাস্তায় চলা কঠিন ছিল। এখন যারা আসছেন, তাদের ২০০ শতাংশ সংগ্রাম করে আসতে হচ্ছে, জায়গা করে নিতে হচ্ছে।
ভয়েস অফ আমেরিকা : আপনার চলচ্চিত্র নির্মাণের শুরুর গল্পটা বলেন ...
রুবাইয়াত হোসেন : আমি ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকতাম, একজন পেইন্টার হবো ভেবে। এখনও আঁকি। ১৮/১৯ বছর বয়সে এসে আমি সত্যজিৎ রায়ের অনেক বই পড়ি, এক সময় ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ নামে একটা বই আমার হাতে আসে, যেটা ফিল্ম নিয়ে, সেটা পড়ে আমি ভীষণ অনুপ্রাণিত হই এবং তার প্রায় সবগুলো সিনেমা একের পর এক দেখতে থাকি। তখন আমার মনে হলো, আমিও তো পারি, এধরণের সিনেমা বানাতে । মূলত তখন থেকেই সিনেমা তৈরির বীজটা আমার ভেতরে ঢুকে। আমার একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি সিনেমা বিষয়ে পড়াশোনা করি, বিভিন্ন কোর্স করি। তারপর নিজে একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনি এবং ছোট ছোট ফটোশ্যুট করে করে শর্টফিল্ম বানাতে শুরু করি। এরই মধ্যে আমি আইন ও সালিশ কেন্দ্রে, নারীপক্ষে, নারী অধিকার নিয়ে কাজ করি। এছাড়াও ব্র্যাকে লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে কাজ করেছি। মুলত আমার প্রস্তুতিটা ছিল দীর্ঘ আট বছরের। এই আটটি বছর নিজেকে একজন ফিল্ম মেকার হিসেবে দাঁড় করাতে সময় নিয়েছি।
ভয়েস অফ আমেরিকা : আপনার চলচ্চিত্রগুলো নারী কেন্দ্রীক, এটার কি কোনো বিশেষ কারণ আছে?
রুবাইয়াত হোসেন: অবশ্যই। চলচ্চিত্রে পুরুষদের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়, এটা শুধু এখন নয়, চলচ্চিত্র জগতের শুরু থেকে নারী বৈষম্যের শিকার। নারীকে দেখানো হয় সৌন্দর্যের বিষয় হিসেবে, কিন্তু প্রাধান্য থাকে পুরুষ অভিনেতার, এই বিষয়টি আসলে আমি মানতে পারি না। মুলত নিজের বক্তব্যটাই আমি আমার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরতে চেয়েছি। এটা আমার সিনেমার রাজনৈতিক বক্তব্য বলা যায়। নারী বৈষম্যের প্রথাগত ধারাটিকে আমি ভেঙে দিতে চাই। নারীর জীবন কতটা জটিল, নিজের অভিজ্ঞতা, পাশের মানুষগুলোর জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি দেখেছি, উপলব্ধি করেছি। আসলে প্রত্যেকেই নিজের গল্পটা পৃথিবীর মানুষকে বলেন নিজের কাজের জায়গা থেকে, আমিও নারীর তথা আমার ক্ষমতায়নের জায়গাটাই তুলে ধরতে চেয়েছি। নারীর সাহসিকতা ও সফলতার গল্প সামনে আনা উচিৎ। সেটি আমি দেখাতে চেষ্টা করি।
ভয়েস অফ আমেরিকা : শিমু/ মেড ইন বাংলাদেশ নির্মাণের নেপথ্যের গল্পটা যদি বলেন ....
রুবাইয়াত হোসেন : রিসার্চের কাজে আমি নারী পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করি। তখন ডালিয়া নামের একজন নারী পোশাক শ্রমিকের সাথে আমার পরিচয় হয়। ওর সাথে পরিচয় হওয়াটাই আসলে এই ছবির মূল ইন্সপিরেশন। ডালিয়া আক্তারের সাথে যখন আমার পরিচয় হয়, তখন তার বয়স ছিলো ২৩, সে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলো এবং তখন সে ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট ছিলো। আমি খুব অবাক হয়ে যাই, এত ছোট একটা মেয়ে, এত বড় একটা দায়িত্ব নিয়ে এত ফাইট সে কীভাবে করছেৃ। এই মেয়েটার মধ্যে যে স্পিরিট, তার ফাইট করার যে পাওয়ার তা আমাকে খুব ইমপ্রেস করে। তখন তার সাথে আমার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। ওর জীবনের ঘটনাগুলোর ভিত্তিতেই মেড ইন বাংলাদেশ ছবিটা তৈরি করি।
ভয়েস অফ আমেরিকা : একজন নারী নির্মাতা হিসেবে চলচ্চিত্রে অন্য তরুণ নারী নির্মাতাদের প্রতি আপনার পরামর্শ আছে কিনা?
রুবাইয়াত হোসেন : আমার শুরুটা কিন্তু আমি নিজে নিজে করেছি। আমি নিজে নিজে কাজটা শিখেছি, নিজের কাজটাকে আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যাল পর্যন্ত নিয়ে যেতে পেরেছি। প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকতে হবে। বসে না থেকে সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে। আসলে বেশি কিছুর প্রয়োজন নাই। এখন তো ইন্টারনেটে অনেক টিউটোরিয়াল আছে, যা আপনাকে অনেক সহযোগিতা করতে পারে।