র‍্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার “জটিল ও কঠিন” বিষয়—পার্টনারশিপ ডায়ালগ শেষে বললেন নুল্যান্ড

প্রেস ব্রিফিংয়ে কথা বলছেন বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনৈতিকবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। (ছবি- ইউএনবি)

বাংলাদেশ র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এবং এর সাতজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানালে এটিকে একটি “জটিল ও কঠিন” বিষয় বলে অবহিত করেছেন বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনৈতিকবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড।

রবিবার (২০ মার্চ) ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের অষ্টম “পার্টনারশিপ ডায়ালগ” অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের পদক্ষেপের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ। গত ডিসেম্বরে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এটিই দুই দেশের মধ্যে প্রথম দ্বিপক্ষীয় বৈঠক।

আলোচনার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের নেতা ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এক যৌথ প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা একটি জটিল ও কঠিন বিষয়। তবে গত তিন মাসে (এ বিষয়ে) কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।

তিনি বলেন, “আমি মনে করি এটি স্পষ্টতই একটি জটিল ও কঠিন বিষয়। আমরা আজ এটি নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা গত তিন মাসে অগ্রগতি দেখেছি...।”

নুল্যান্ড আরও বলেছেন, তাদের ইতিমধ্যে ৫০ বছরের “খুব শক্তিশালী” অংশীদারত্ব রয়েছে এবং দুই দেশ এক সঙ্গে আরও অনেক কিছু করতে পারে।

তিনি বলেন, তারা ক্রমবর্ধমান ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রযুক্তি অবকাঠামো, দুই অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আরও কিছু করতে পারে।

বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতা পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনও ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, “সম্প্রতি র‌্যাব এবং এর বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তারা ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন।”

তিনি বলেন, এটি কীভাবে সন্ত্রাসবাদ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ মোকাবিলায় সরকারের প্রচেষ্টাকে প্রভাবিত করতে পারে তা বাংলাদেশ পক্ষ ব্যাখ্যা করেছে।

মাসুদ বিন মোমেন বলেন, “আমরা তাদের র‌্যাব এবং এর পারফরম্যান্স, আমাদের কিছু উদ্যোগের সর্বশেষ বিষয়ে একটি অনানুষ্ঠানিক দলিল দিয়েছি। তারা এটি প্রত্যাহার করবে এবং এটি দেখবে।”

ওয়াশিংটনের সঙ্গে বিস্তৃত অংশীদারত্ব গড়তে আগ্রহী ঢাকা

মাসুদ বিন মোমেন আরও বলেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যেতে দুই দেশই আরও কিছু করতে চায়। এ জন্য “বিস্তৃত অংশীদারত্ব” গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাইডেন প্রশাসনের কাছে উচ্চ প্রত্যাশা রয়েছে।
তিনি বলেন, “এটা আমরা আজ আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের সহকর্মীদের বলেছি। শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে আমাদের যাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে আগ্রহী থাকবে।”

মাসুদ বিন মোমেন বলেন, এবারের অংশীদারত্ব সংলাপ দুটি কারণে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, দুই দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি শিগগিরই উদযাপন করবে। দ্বিতীয়ত, গত দুই বছর কোভিড-১৯ মহামারি তাদের নিয়মিত সংলাপ অনুষ্ঠানে বাধা দিয়েছে।

তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ৪ এপ্রিল ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। দুই দেশ অন্য সম্পৃক্ততা ছাড়াও উচ্চ পর্যায়ের অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সংলাপের পরিকল্পনা করছে। রবিবার দুই পক্ষই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে জোর দিয়ে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সম্পূর্ণ বিষয়ের ওপর “ফলপ্রসূ” আলোচনা করেছে।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, “বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার বহুমুখী সম্পর্ককে গভীরভাবে মূল্য দেয়। যা গণতন্ত্র ও মানবিক মর্যাদা, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার অঙ্গীকার এবং জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।”
তিনি বলেন, দুই দেশ রোহিঙ্গা ইস্যু, করোনার টিকা সহায়তা, উন্নয়ন সহায়তা, নিরাপত্তা খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধির মতো “চমৎকার পারস্পরিক সহযোগিতার” ক্ষেত্রেও আলোচনা করেছে। উচ্চ পর্যায়ের সফর, বিনিয়োগ, বাণিজ্য সুবিধা, সংযোগ, শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়েও মতবিনিময় করেন তারা।

মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল সম্পর্কে মতামত বিনিময় করেছেন তারা এবং জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গিও বিনিময় করেছেন।
বাংলাদেশ পক্ষ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা এবং নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা অব্যাহত রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।

এ ছাড়া গণতান্ত্রিক চর্চা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, শ্রম অধিকার ও ধর্মীয় সম্প্রীতির মতো বিষয়েও ঢাকা তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে বলেও জানান তিনি।

এর আগে সকালে রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার অষ্টম অংশীদারত্ব সংলাপ শুরু হয়। সংলাপে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষের নেতৃত্ব দেন ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড।

এদিকে, এই সংলাপ শুরুর আগে একই স্থানে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও নুল্যান্ড একান্ত বৈঠক করেন।

প্রসঙ্গ র‍্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা

উল্লেখ্য, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান আইজিপি বেনজীর আহমেদও রয়েছেন। এরই মধ্যে তার আমেরিকান ভিসাও বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া র‍্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পৃথক এক ঘোষণায় বেনজীর আহমেদ এবং র‍্যাব ৭–এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত। এতে বলা হয়েছে যে, তারা আইনের শাসন, মানবাধিকারের মর্যাদা ও মৌলিক স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ক্ষুণ্ন করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। র‍্যাব হচ্ছে ২০০৪ সালে গঠিত একটি সম্মিলিত টাস্ক ফোর্স। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং সরকারের নির্দেশে তদন্ত পরিচালনা করা।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বা এনজিওদের অভিযোগ হচ্ছে যে, র‍্যাব ও বাংলাদেশের অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ ব্যক্তির গুম হয়ে যাওয়া এবং ২০১৮ সাল থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের জন্য দায়ী। কোনো কোনো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এই সব ঘটনার শিকার হচ্ছে বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।