সাক্ষাৎকারঃ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
রিজওয়ানা হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিতে (বেলা) যোগ দেন। গত প্রায় দুই দশক ধরে তিনি বাংলাদেশে পরিবেশ-সুশাসন নিশ্চিত করতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। নিজের কাজের জন্য দেশে ও দেশের বাইরে তিনি বেশকিছু সম্মানজনক পুরষ্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় তাকে ২০০৭ সালে পরিবেশ পদকে ভূষিত করে, ২০০৯ সালে তিনি পরিবেশের জন্য সবচেয়ে সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পুরস্কার ‘গোল্ডম্যান পুরস্কার’ লাভ করেন, ২০১২ সালে র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার অর্জন করেন। সম্প্রতি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক নারী সাহসিকা (ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ-আইডব্লিউওসি) পুরস্কার পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি বেলা’র প্রধান নির্বাহী।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক নারী সাহসিকা পুরষ্কার এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে। ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এহসান মাহমুদ।
ভয়েস অফ আমেরিকা: শুরুতেই আপনাকে অভিনন্দন জানাতে চাই এই বছর যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ’ পুরষ্কার পাওয়ায়। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বছর আইডব্লিউওসি পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেছে। আপনি ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আরও ১১ জন নারী নিজ নিজ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় এই পুরস্কার পাচ্ছেন। আপনি একজন বাংলাদেশি নারী। আপনি কাজ করেন পরিবেশ নিয়ে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই পুরস্কারকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান : আমি মনে করি, আমি যে ক্ষেত্রে কাজ করি সেখানে কাজ করাটি বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আরও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এইদেশের মানুষের একটি বড় অংশের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে প্রকৃতির ওপর। আমাদের দেশটিকে যেহেতু আমরা নদীমাতৃক বলে থাকি, তাই এই নদীকে রক্ষা করতে হবে। আমি কাজ করি এই বিষয়গুলো নিয়ে... মাটি রক্ষা, পানি রক্ষা ও বাতাস রক্ষা। যা এই দেশের জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি কারও জীবনে এই তিনটি (মাটি, পানি, বাতাস) জিনিস নষ্ট হয়ে যায়, আর বাকি সবকিছু যদি থাকেও তাহলে কোনো লাভ নেই। এই তিনটি জিনিস ঠিক রেখে যদি উন্নয়নটা সরকারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী একটু ধীরগতিতেও হয়, আমি মনে করি, তাতে কোনো ক্ষতি নেই।
আমি যেহেতু সম্পদ রক্ষার কথা বলি, তাই অনেকের শত্রুতে পরিণত হই। এখন এই কাজটি করতে গিয়ে যাদের স্বার্থে আঘাত লাগে তারা আমার বিপক্ষে চলে যায়। যারা সম্পদ কুক্ষিগত করতে চায় তারা বিরোধীতা করে। আবার দেখা যায় যারা আর্থিকভাবে ও সম্পদ কুক্ষীগত করার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে তারা সরকারের সাথে সম্পর্ক রাখে। এটা করতে গিয়ে দেশের প্রচলিত আইনে পরিবেশ রক্ষায় যে সুবিধা আমার পাওয়ার কথা তা আমি পাই না। যেমন- এই মুহূর্তে আমি কাজ করছি হবিগঞ্জের সুতাং নদী নিয়ে। সেখানে কয়েকটি কারখানার দূষণে নদীটি মরতে বসেছে। এখন আমার দেখতে হবে- কে বড়? কয়েকটি কারাখানা নাকি একটি নদী? এখন সরকার চাইলে কিন্তু সংবিধানে বা আইনে পরিবেশ রক্ষায় যে ক্ষমতা দেওয়া আছে তা প্রয়োগ করে নদীটি রক্ষা করতে পারে। কারখানা আমরা অন্যত্র করতে পারবো, কিন্তু নদীর ক্ষেত্রে তা পারবো না। আজকাল অনেকেই বলেন, উন্নয়ন করতে গেলে পরিবেশ ধ্বংস হবেই। এই কথাটি ঠিক নয়। কারণ, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ করলেই পরিবেশ ধ্বংস হবে না। এখন এসব কাজ করতে গিয়ে যারা আমার শত্রু হয়েছে তারা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। রাজনৈতিকভাবেও ক্ষমতাশালী এবং অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষমতাশালী। তাদের অর্থ সবসময় তাদের রাজনীতির কাছাকাছি নিয়ে যায়। রাজনীতি যদিও আমার কথা বলে কিন্তু তারা বন্ধুত্ব করে তাদের সাথে।
ফলে বাংলাদেশের প্রেক্ষপটে এই পুরষ্কারটি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, পরিবেশ নিয়ে কাজ করাটা যে গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা গেল। আবার নারী নেৃত্বত্ব দিয়ে এই কঠিন কাজটি করা যাচ্ছে তার একটি স্বীকৃতি পাওয়া গেল। আমি কাজ করতে গিয়ে যাদের শত্রু হয়েছি তাদের সংখ্যা কম হলেও তারা অনেক বেশি ক্ষমতাবান। তাই বাংলাদেশের এই বাস্তবতায় যেখানে গণতন্ত্র অনেক সংকীর্ণ ও সংকুচিত হয়েছে, সেখানে এই পুরস্কার এই বার্তা দেয় যে, আমি যে কাজ করি তার মাধ্যমে কেবল দেশীয় সমর্থন পাই তা নয়, বিদেশি সমর্থনও আছে। অর্থাৎ, পরিবেশ রক্ষায় আমরা যে কাজগুলো করছি তা সঠিক মনে করছেন তারা।
ভয়েস অফ আমেরিকা: এইবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আপনি ঢাকা শহরের বাসিন্দা। এই শহরকে বসবাসের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে অযোগ্য শহরগুলোর একটি তকমা দেওয়া হয়। একজন পরিবেশবাদী হিসেবে আপনি কীভাবে দেখছেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান : ঢাকা শহর যে বসবাসের অযোগ্য সেটি বিদেশি গবেষণা ফল দেখে জানবার দরকার নাই। গতকাল সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যায় একটি দাওয়াত ছিল। আমি ধানমণ্ডি থেকে গুলশানে যাব বলে ঠিক করেছিলাম। আমার ধারণা ছিল রাত ৮ টার মধ্যে পৌঁছে যাব। কিন্তু ধানমণ্ডি থেকে সংসদ ভবন পর্যন্ত এটুকু রাস্তা পার হতেই দেড় ঘণ্টা সময়ের বেশি লেগেছে। এখন এরকম একটি বিরক্তিকর শহরে আমরা থাকছি। যদিও ঢাকা শহর আমার জন্মশহর। বেড়ে ওঠা এখানেই। ঢাকার রাস্তাঘাট, বেইলি রোডের ফুচকা কিংবা ঢাকার উন্মুক্তমঞ্চ সবই ঠিক আছে , সবই আমার পছন্দ। তাই বলে এই ঢাকা শহরেই পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বায়ু আমার গ্রহণ করতে হবে এটা কেন মেনে নেব। কয়েকটি ফ্লাইওভার হবে তারা বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ না করেই নির্মাণ কাজ শুরু করবে, ধুলোয় শহর ভরে উঠবে।
এই শহরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বায়ু দূষণ প্রতিরোধক ব্যবস্থা মানা হবে, সিটি কর্পোরেশনগুলোর ময়লা ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে, নদীগুলো দখলমুক্ত হয়ে যাবে দ্রুত- আমি বলতে পারি, এই শহরের নাগরিকেরা এই আশা ছেড়ে দিয়েছে। এখানে দেখা গেছে একেকটি নদীর নামে একেকটি আবাসন গড়ে ওঠেছে। নদী দখল করে বুড়িগঙ্গা আবাসন, তুরাগ আবাসন করা হয়েছে। আমরা যদি এতো কথা না বলতাম নদীগুলো আরও দখল হয়ে যেত।
ভয়েস অফ আমেরিকা: এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী বলে মনে করেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান : এর জন্য রাজনৈতিক কমিটমেন্ট সবার আগে থাকতে হবে। যদি কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়ে 'শাসক' না হয়ে জনগণের ম্যান্ডেট বাস্তবায়ন করে তখন আমরা তাদের কাছে কোনো দাবি দিতে পারবো। সংস্কার প্রস্তাব করতে পারবো। রাজনৈতিক অঙ্গিকার থাকতে হবে। ক্ষমতায় যারাই থাকবে তারা যাতে মনে করে জনগণই ক্ষমতায় আছে। নইলে সরকার তাদের উন্নয়নের এজেন্ডা দিয়ে এগিয়ে আসবে, উন্নয়নের নামে প্রকৃতি বিনাশ করবে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: আমাদের গণমাধ্যমে যেসব খবর আসে তার অনেকটা জুড়েই রাজধানী। ঢাকার বাইরের অন্য জেলাশহর বা অন্যান্য নদ-নদীর কী অবস্থা আসলে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান : ঢাকায় কোনো কিছু হলে যতো সহজে গণমাধ্যমে উঠে আসে তা সারা দেশের ক্ষেত্রে হয়তো হয় না। এর কারণ হচ্ছে- কেন্দ্রের প্রতি সবারই একটি নজর থাকে। সেটা রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকেন তারা থেকে শুরু করে প্রায় সব ক্ষেত্রেই। আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবসে বেশকিছু খবর দেখতে পেলাম। যার অধিকাংশই ঢাকার বাইরে। রাজধানীতে বা কেন্দ্রে কিছু ঘটলে তা সহজে নীতিনির্ধারণীদের দৃষ্টিতে পড়ে। তবে আমি বলতে পারি, সারা দেশেই ৬৪টি জেলাতেই সাম্প্রতিক সময়ে মানুষ সোচ্চার হয়েছে। সেখানে নদী রক্ষায় বা পরিবেশ রক্ষায় মানুষ একত্রিত হয়েছে, দাবি জানিয়েছে। হাইকোর্ট সারা দেশের নদীগুলো দখলমুক্ত রাখতে নির্দেশনা দিয়েছে। তবে ঢাকা শহরেই যেখানে সিটি কর্পোরেশনের ময়লা ব্যবস্থাপনায় লোকবল এবং অর্থের ঘাটতি আছে সেখানে সারাদেশের বেলাতেও থাকবে এটা ধরে নিতে হবে। তবে আমি যেটা বলতে চাই- এখন মানুষ সচেতন হয়েছে। সোচ্চার হয়েছে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: এইবারের নারী দিবসের বিষয় ছিল ‘টেকসই আগামীর জন্য, জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’। এইবার নারী দিবসের আলোচনায় নারীর ওপর পরিবেশের প্রভাব নিয়ে নানা প্রসঙ্গ আলোচনা হয়েছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান : এই বিষয়টিকে আমি অন্যভাবে দেখাতে চাই। আমরা কিন্তু বলি- মাতৃভাষা। আমরা বলি- নদীমাতৃকা। এই যে মায়ের সাথে দেশকে তুলনা করা হয়, ভাষাকে তুলনা করা হয়, মায়ের সাথে পরিবেশকে তুলনা করা হয়, সেখানেই কিন্তু মায়ের মধ্যদিয়ে নারীর উপস্থিতি চলে আসে।
পরিবেশের উপাদান- মাটি বা পানির কথাই যদি বলি, এসব রক্ষার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবেই আমরা দেখে আসছি নারীরা কাজ করছেন, এগিয়ে আসছেন। কোনো পরিবারের সন্তান যখন খেতে চায় সে বলে- ‘আম্মা ভাত দাও।’ সে বলে না- ‘আব্বা ভাত দাও’। পরিবারে প্রাথমিক চাহিদা মায়ের কাছেই চাওয়া হয়। মা তা সক্ষমতা অনুযায়ী পূরণ করেন। একইভাবে পরিবেশের ওপর যখন কোনো হুমকি এসে পড়ে তখন তার প্রথম অভিঘাত এসে পড়ে নারীর ওপর। প্রাথমিক খাদ্য যোগানদাতা, পানি যোগানদাতা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নারী। তাই পরিবেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলে তার প্রথম প্রভাব নারীর ওপরই পড়ে। সেটা খাদ্য, পানীয়, স্বাস্থ্য যা-ই হোক না কেন- নারীর ওপরই প্রথম প্রভাব পড়ে। তাই এটা অনুধাবন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, পরিবেশের বা প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয়ের কারণে নারী পুরুষের ক্ষেত্রে যে প্রভাব পড়ে তা নারী-পুরুষ সবার ওপরই পড়ে, তবে তা নারীর ওপরই তুলনামূলক বেশি পড়ে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনার কোনো পরামর্শ রয়েছে কিনা?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান : আমার সবসময়েই মনে হয়, একজন মাকে তার সন্তানের আসল ভালো বুঝতে হবে। বড় বড় দালান, বিলাসবহুল গাড়ি, কাড়ি কাড়ি টাকা, দামী খাবার এসব তার আসল ভালো নয়। তার আসল ভালো হলো- তার শিক্ষা এবং তার পরিবেশ প্রকৃতি ঠিক রাখা। তাকে যদি ভেজাল খাবার খেতে হয়, দূষিত বায়ু গ্রহণ করতে হয়, দূষিত পানি পান করতে হয় তাহলে সে এইসব অর্থ দিয়ে করবে কী? তাই একজন মা যদি এইসব বিবেচনায় এনে করণীয় ঠিক করে তাহলে আমাদের পরিবেশের বিষয়টিও ঠিক থাকবে।