নভেরা আহমেদঃ শহীদ মিনারের অদৃশ্য নকশাকার

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। (ছবি- অ্যাডোবি স্টক)

১৯৫২ সালে সংঘটিত মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির ধারক ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত এই স্মৃতিসৌধের অবস্থান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে।

১৯৫৬ সালে মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের সময় বর্তমান স্থান নির্বাচন করা হয় এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ১৯৬৩ সালে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পর যতবারই শহীদ মিনার তৈরি করা হয়েছে বারবারই তা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।

শহীদ মিনারের ইতিহাস

প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করা হয় ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকালে। ‍ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হোস্টেলের (ব্যারাক) বারো নম্বর শেডের পূর্বপ্রান্তে কোণাকুণিভাবে হোস্টেলের মাঝের রাস্তার গা ঘেঁষে মিনারটি তৈরি করা হয়েছিলো। এর উচ্চতা ছিলো ১০ ফুট, চওড়া ৬ ফুট। মিনারের মূল নকশা করেছিলেন বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দার। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে মিনারটি উদ্বোধন করা হয়। সেদিনই পুলিশ ও সেনাবাহিনী শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলে। এরপর ঢাকা কলেজেও একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়েছিলো, সেটিও তৎকালীন সরকারের নির্দেশে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিলো। শিল্পী হামিদুর রহমান এবং ভাস্কর নভেরা আহমেদের পরিকল্পনা ও নকশা অনুযায়ী ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরুর পর আবার তা বন্ধ করে দিতে হয়েছিলো। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত মানুষ অসমাপ্ত মিনারেই ফুল দিয়েছে। ১৯৬২ সালে মূল নকশা পরিবর্তন করে আরেকটি নকশা করা হয়। নকশা পরিবর্তনের পরামর্শ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি। এরপর দ্রুত মিনারের কাজ শেষ হয়। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এর উদ্বোধন করেন শহীদ বরকতের মা।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি বাহিনী মিনারটি ভেঙে ফেলে এবং সেখানে ‘মসজিদ’ লিখে দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে নতুন করে শহীদ মিনার তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। এবারও মূল নকশা বাদ দিয়ে ১৯৬৩ সালের সংক্ষিপ্ত নকশার ভিত্তিতেই কাজ শেষ করা হয়। ১৯৮৩ সালে মিনার চত্বরের কিছুটা বিস্তার করা হয়। এটাই বর্তমান শহীদ মিনারের রূপ।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মূল নকশা নিয়ে বিতর্ক

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মূল পরিকল্পনা ও নকশা ভাস্কর নভেরা আহমেদ ও শিল্পী হামিদুর রহমানের। অথচ শহীদ মিনারের স্থপতি হিসেবে শুধু হামিদুর রহমানের নামই উল্লেখ করা হয়। ভাস্কর নভেরা আহমেদ রয়ে গেছেন আড়ালে, এক অনুচ্চারিত নাম হিসেবে। অনেকে জানেনই না যে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মূল নকশা পরিকল্পনায় তিনিও হামিদুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন। সৈয়দ শামসুল হক ১৯৯১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘হৃৎকলমের টানে’ বইতে লিখেছেন, “কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা করেছিলেন যে দু’জন তাঁদের একজনের কথা আমরা একেবারেই ভুলে গিয়েছি। প্রথমতঃ আমরা অনেকেই জানি না এই মিনারের নকশা কারা করেছিলেন, যদিও বা জানি তো জানি শুধু শিল্পী হামিদুর রহমানের নাম; খুব কম লোকে চট করে মনে করতে পারে যে হামিদের সংগে আরো এক জন ছিলেন-হামিদের সংগে ছিলেন বলাটা ভুল, বলা উচিত দু’জনে এক সংগে এই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের রূপটি রচনা করেছিলেন; অপর সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন নোভেরা আহমেদ-আমাদের ভাস্করদের ভেতরে কাল, সাহস এবং প্রতিভার প্রেক্ষিতে যিনি প্রথম।

নোভেরা এখন কোথায় আছেন জানি না, অনেকদিন থেকে তিনি দেশে নেই। আর তিনি যখন দেশে নেই তখন তো আমাদের ঐতিহ্য অনুসারে তাঁকে মনে রাখবার দায়ও আমাদের নেই। অতএব আমরা নোভেরাকে বেমালুম ভুলে গেছি। কিছুদিন আগে শিল্পী হামিদুর রহমান, এখন কানাডায় থাকেন, ঢাকায় এসে টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকার দেন। শহীদ মিনারের কথা ওঠে; হামিদুর রহমান সংগতভাবেই দুঃখ প্রকাশ করেন, যে, মিনারের মূল পরিকল্পনার অনেকখানিই এখনো বাস্তবে রূপ পায়নি। হামিদের দুঃখের কথা আমাদেরও দুঃখের কথা, কিন্তু বিশেষভাবে আমাদের আরো একটি দুঃখের কথা এই যে, এ সাক্ষাৎকারে হামিদ নোভেরার নাম করেননি। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দফতরের একটি প্রামান্যচিত্রেও হামিদের বক্তব্য আমরা শুনেছি শহীদ মিনার সম্পর্কে, কিন্তু তাঁকে শুনিনি নোভেরার কথা উল্লেখ করতে। আমি নিশ্চিত যে, যদি হামিদকে প্রশ্ন করা হতো তাহলে নিশ্চয়ই তিনি নোভেরার নাম ও গুরুত্ব উভয়ই তুলে ধরতেন। কিন্তু প্রশ্নকারী যে প্রশ্ন করবেন তাঁকে তো আগে জানতে হবে নোভেরা আহমদ নামে একজন ভাস্করের অস্তিত্বের কথা?”

১৯৫৬ সালে অনেক কেন্দ্রীয় সরকারী অসহযোগীতার মধ্যেও শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এ কারণে কোন নকশার আহবান দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়নি।

পূর্ব পাকিস্তানের সে সময়ের মূখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে এর দায়িত্ব দেন। জয়নুল আবেদিনের স্নেহধন্য ছিলেন হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদ। তাঁরা একই সাথে শিক্ষাজীবন শেষ করে তখন দেশে ফিরেছেন। জয়নুল আবেদিন হামিদকে স্কেচ ও মডেল সহ ডিজাইন দিতে বলেন।

এখানে উল্লেখ্য, সে সময় সরকারের স্থাপত্যবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন জ্যাঁ দেলোরা। এই কাজের তদারকি করার ভার তাঁর উপরে ছিল। তারপর শহীদ মিনারের ডিজাইন নভেরা এবং হামিদুর রহমান মিলেই করেন। এবং পরিকল্পনাটি এসেছিল নভেরার 'Seated Woman' নামের দুটি ভাস্কর্য থেকে। তাঁর এই ভাস্কর্যগুলোতে মাতৃ প্রতিকৃতি ও আনত সন্তানের সম্পর্ক ছিল। এটাই শহীদ মিনারের মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে। অনেকখানি জায়গা নিয়ে বেশ বড় আয়তনের শহীদ মিনার কমপ্লেক্স নির্মাণ করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। মিনারের ভিত্তি সংযুক্ত মূল অংশে মঞ্চের ওপর দাঁড়ানো মা ও তাঁর শহীদ সন্তানের প্রতীক হিসেবে অর্ধবৃত্তাকার স্তম্ভের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। স্তম্ভের গায়ে খোদাই করে বসানোর কথা ছিলো হলুদ ও গাঢ় নীল কাচের অসংখ্য চোখের প্রতীক, সেগুলি থেকে প্রতিফলিত সূর্যের আলো মিনার-চত্বরে বর্ণালির আভা তৈরি করবে এমনই স্বপ্ন দেখেছিলেন নভেরা ও হামিদ। মিনার-স্থাপত্যের সামনে বাংলা বর্ণমালা দিয়ে গাঁথা একটি রেলিং তৈরি করা এবং মিনার চত্বরে দুই বিপরীত শক্তির প্রতীক হিসেবে রক্তমাখা পায়ের ছাপ ও কালো রঙের পায়ের ছাপ আঁকার পরিকল্পনাও মূল নকশায় ছিল। জাদুঘর, পাঠাগার ও সংগ্রাম-বিষয়ক দীর্ঘ দেয়ালচিত্রও (ম্যুরাল) থাকবার কথা ছিলো তবে তাঁদের মূল ডিজাইন এর একটি বড় অংশ পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি এবং আশ্চর্যজনকভাবে স্থপতি হিসাবে নভেরা আহমেদের নাম বাদ পড়ে যায়।

শহীদ মিনারের মূল নকশাকার নভেরা আহমেদ

শহীদ মিনারের মূল নকশার প্রতিলিপির একাংশ।

২০২০ সালে প্রকাশিত হয় কথাসাহিত্যিক আনা ইসলামের ‘নভেরা: বিভুঁইয়ে স্বভূমে’ বইটি। বইয়ের শুরুতেই শহীদ মিনারের মূল নকশার প্রতিলিপির একাংশ যুক্ত করেছেন তিনি। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ১৯৫৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সরকারিভাবে নকশাটি পাশ করা হয়। মূল নকশায় একটি অংশে লেখা ছিল “SHAHEED MEMORIAL: Composer HAMIDUR RAHMAN. Muralist in collaboration with NOVERA AHMED Sculpturer. JEAN DELEURAN. Architect, C.E. B.Dept.’’

তথ্যচিত্র নির্মাতা ভিভিয়ান ভাগের কাছে ২০১৪ সালে প্যারিসে বসে তাঁর শেষ সাক্ষাৎকারে নভেরা শহীদ মিনার প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘সরকারি লোকজন যোগাযোগ করেছে, আমি তাদের আইডিয়ার কথা বলেছি। কী করতে হবে বলেছি। আমাকে অগ্রিম কিছু অর্থ দিতে হবে। তারা দিয়েছে আমাকে।...অনেক কাজ একা করতে হবে বলে হামিদকে বলি সাহায্যের জন্য”

‘নভেরা : বিভুঁইয়ে স্বভূমে’ বইতে লেখককে ২০১০ সালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শিল্পী আমিনুল ইসলাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের গোড়ার কথা বর্ণনা করেন, “১৯৫৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান শহীদ মিনারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অনুরোধ করেন প্রধান প্রকৌশলী জব্বার সাহেব এবং জয়নুল আবেদিনকে। তখন লেকলেন বলে এক ইংরেজ ছিলেন চিফ আর্কিটেক্ট, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের।লেকলেন বললেন, ভাষা আন্দোলনের সিম্বল; বাঙালি আর্কিটেক্টের করা উচিত।...মাজহার সাহেবকে পাঠানো হলো। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি ডিজাইন করতে রাজি ছিলেন না। হামিদ শুনল, শহীদ মিনারের ডিজাইন হবে। হামিদ করিৎকর্মা ছিল তো কথাবার্তায়, বলল যে আর্কিটেক্টরা না করলে আর্টিস্টরা করতে পারে। শহীদ মিনারের ডিজাইনের জন্য পত্রিকায় কোনো বিজ্ঞাপন দেয়া হয়নি। তখন হামিদ আর নভেরা মিলে একটা ডিজাইন দাঁড় করাল। ওটা আমি দেখেছি।...মেইন নকশা নভেরার করা। হামিদ পেইন্টিং ভালো করত। স্কাল্পচার সম্পর্কে কোনো আইডিয়া ছিল না। ...’৫৭ সালের প্রথম থেকেই হামিদ ও নভেরা মিলে শহীদ মিনারের পরিকল্পনা নিয়ে খবই ব্যস্ততায় ছিল ’৫৮ সাল পর্যন্ত। রাত-দিন খেটে অর্ধনির্মিত শহীদ মিনারের বেজমেন্টে একটি ম্যুরাল সম্পন্ন করে হামিদ ১৯৫৮ সালে। এই ম্যুরালটি হামিদের শ্রেষ্ঠ কাজ, যা ১৯৭১-এ ধ্বংস করা হয়।”

একই বইয়ে শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর লিখিত তথ্য দেন, “...আমার মনে আছে ওই সময় আমি এবং আমার বন্ধু (আমার থেকে দুই বছরের সিনিয়র শিল্পী) আমিনুল ইসলাম প্রায়ই বিকেলে আমরা যেতাম হামিদ আর নভেরার সঙ্গে আড্ডা দিতে। একদিন দেখলাম, নভেরা কাদা-মাটি দিয়ে শহীদ মিনারের একটি মডেল তৈরি করছে। মাটির প্রশস্ত চত্বর আর বেশ কিছু লম্বা সিঁড়ি সামনে। পেছনের দিকে গাছের ছোট ছোট ডাল দিয়ে, যা বর্তমানে সিমেন্টের খুঁটি আর লোহার রড দিয়ে তৈরি হয়েছে।”

তবে কেন নভেরা এতদিন মুখ খোলেননি, দাবি করেননি যে তিনিই ভাষার মিনারের প্রকৃত নকশাবিদ, এমন প্রশ্নের জবাবেও নভেরা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, “হামিদ তো ভাস্কর নয়। সে কী করে ডিজাইন করে। আমি মিনারের একটি ছোট্ট মডেল করে দিয়েছিলাম। হামিদের কাছেই আমার করা ড্রয়িংসহ সব কাগজপত্র ছিল।”

বিশিষ্ট শিল্পসমালোচক ও ঢাকা সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুদ্দীন খালেদ ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, “নিঃসন্দেহে শহীদ মিনারের কনসেপ্ট ও নকশা নভেরা আহমেদের। দীর্ঘদিন হামিদুর রহমানের নামই শহীদ মিনারের মূল নকশাকার হিসেবে চলে এসেছে। শহীদ মিনারের নকশায় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের সম্মিলনে যে ধরণের শিল্প নির্মাণ করা হয় এ ধরণের নির্মাণের সঙ্গে হামিদুর রহমানের সম্পর্ক নেই। এ ধরণের কাজ একজন ভাস্করেরই করার কথা। হামিদুর রহমানের মুর‌্যাল করার কথা ছিলো, মিনার করেছে নভেরা আহমেদ। হামিদুর রহমান পেইন্টার ও মুর‌্যালিস্ট। আমরা পরবর্তী সময়ে হামিদুর রহমানের কোনো কাজে শহীদ মিনারের প্রভাব দেখতে পাইনি বা এ ধরণের কোনো ভাস্কর্য ও স্থাপত্য দেখতে পাইনি। অথচ নভেরার অনেক কাজের সাথে শহীদ মিনারের মিল পাওয়া যায়।"

ভাস্কর নভেরা আহমেদের জন্ম ২৯ মার্চ, ১৯৩৯ সাল মতান্তরে ১৯৩০, বাংলাদেশের সুন্দরবনে। মৃত্যু ৬ মে, ২০১৫, ফ্রান্সে। আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পে তিনি অন্যতম। ষাটের দশকে নভেরা ছিলেন একজন উজ্জ্বল, তরুণ ভাস্কর। ১৯৬১ সালে অল পাকিস্তান পেইন্টিং অ্যান্ড স্কাল্পচার এক্সিবিশন আয়োজিত হয়। এই প্রদর্শনীর জন্য নভেরা তার নিজের একটি আবক্ষমূর্তি তৈরি করেন যার নাম দেন ‘চাইল্ড ফিলোসফার’। ভাস্কর্যটির জন্য তিনি প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। তার বিখ্যাত কাজের মধ্যে রয়েছে (১৯৫৮), যুগল (১৯৬৯), ইকারুস (১৯৬৯) ইত্যাদি কাজে মাধ্যমগত চাহিদার কারণেই অবয়বগুলি সরলীকৃত। ওয়েলডেড স্টিলের জেব্রা ক্রসিং (১৯৬৮), লুনাটিক টোটেম বা মেডিটেশন (১৯৬৮)। এছাড়া ২০১৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পর ৪৩টি চিত্রকর্মের হদিশ পাওয়া গেছে। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ৪৫ বছর তিনি প্যারিসে ছিলেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক প্রদান করে।

বাংলাদেশে স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পীর মূল্যায়ন

ভিভিয়ান ভাগের কাছে ২০১৪ সালে প্যারিসে বসে নভেরা বলেন, তিনি দেশে কাজ পাচ্ছিলেন না। বলেন, “একজন নারী হিসেবে তাদের আমার প্রতি বিশ্বাস ছিল না। সরকারের আমার প্রতি খুব আস্থা ছিল না।”

যে সময়ে নভেরা কাজ শুরু করেছিলেন, সেই সময়টায় কাজ করা বাংলাদেশের প্রেক্ষপটে আসলেই ভীষণ কঠিন ছিলে। বিশিষ্ট শিল্পসমালোচক ও ঢাকা সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুদ্দীন খালেদের মতে, “নভেরা দেশ ছাড়ার পেছনে যে কারণগুলো ছিলো তার মধ্যে অন্যতম হলো, আমাদের দেশে সে সময় ভাস্কর্য, পেইন্টিং বা স্থাপত্যশিল্পের সেভাবে মূল্যায়ন ছিলো না। পৃষ্ঠপোষক ছিলো না। সেই অর্থে আজও নেই। সে সময় একেবারেই ছিলো না। স্বভাবতই তিনি তখন দেশ ছেড়েছেন।”

স্থাপত্যশিল্পে বাংলাদেশে নারীর অবস্থান নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকার সাথে কথা বলেছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত স্থপতি, শিক্ষক ও গবেষক নন্দিনী আওয়াল। তার মতে, “নভেরা আহমেদ যে সময়ে কাজ শুরু করেছিলেন সে সময়ের তুলনায়, পরিবেশ ও আর্থ সামাজিক অবস্থার এখন উত্তরণ হয়েছে। এখন স্থাপত্যশিল্প নিয়ে যেসব নারীরা কাজ করছেন তাঁরা তাদের প্রাপ্য স্বীকৃতি পাচ্ছেন। তাঁদের কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে। নারীরা নিজেদের আর্কিটেক্চার ফার্ম তৈরি করে, সেখান থেকে কাজ করে এওয়ার্ড পাচ্ছেন এমন বেশ কিছু ঘটনাও ঘটছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন এবং কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে। এখন দৃশ্যটা অনেকখানি আলাদা।’’

স্থপতি মেহেরুন ফারজানা আর্ক ভিজ লিমিটেড (Archviz Limited) নামক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান স্থপতি ও চেয়ারম্যান। তিনি মূলত পরিবেশবান্ধব শিল্পকারখানা নিয়ে কাজ করেন। বাংলাদেশে স্থাপত্যশিল্পীর মূল্যায়ন প্রসঙ্গে ভয়েস অব আমেরিকাকে তিনি বলেন, “শুধু নারী স্থপতি নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশে সামগ্রিক স্থাপত্য পেশাটি যে পরিমাণ সম্মান পায় সে জায়গায় বাংলাদেশে এ শিল্পটি এখনো পৌছাতে পারেনি। নারী পুরুষ নির্বিশেষে বলতে পারি, আর্কিটেক্টরা এখনো আড়ালেই থেকে যাচ্ছেন। একটা প্রজেক্ট শেষ হওয়ার পরে সাধারণত ইন্ডাষ্ট্রি, কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কাজ শুধুমাত্র তারাই আলোচনায় আসেন। কিন্তু এধরণের কাজে স্থাপত্য শিল্পী ও কলাকুশলীসহ যে একটা দল যুক্ত থাকে ‍তারা গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই আলোচনার বাইরে থেকে যান। তবে এ পেশায় এখন প্রতিবন্ধকতা কমেছে। এখন আর নারী স্থপতিকে কেউ অবমূল্যায়ন করে না বা খাটো করে দেখে না। এটা ঠিক যে, কর্মক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের সঙ্গে টিকে থাকার জন্য এখনও সংগ্রাম করতে হচ্ছে, তবে দক্ষতা প্রমান করতে পারলে দেশে থেকেই এখন এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে, এখন বাংলাদেশে স্থাপত্য চর্চা করা সম্ভব।”