বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জীবিকার সন্ধানে প্রতি বছর রাজধানী ঢাকায় আসেন অসংখ্য নিম্নআয়ের মানুষ। বেশির ভাগই শ্রমজীবী। কাজের আশায় ঢাকায় আসা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে ভিটেমাটি হারিয়ে ঢাকামুখী হন।
ঢাকায় আসা এসব মানুষদের অনেকের প্রথম দিকে মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকে না। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তারা খোলা আকাশের নিচেই রাত কাটান। কেউ পলিথিন, প্লাস্টিক বা শক্ত কাগজ দিয়ে কোনো মতে পথের পাশে ঝুপড়ি বানিয়ে থাকেন। আবার কেউ থাকেন রাস্তার পাশে যাত্রী ছাউনিগুলোতে। কেউ রেলস্টেশন। কেউ সারা দিন কাজ করে তরকারির ঝুপড়ি ও খাবারের ভ্যানে রাত পার করেন।
এই মানুষের মধ্যে যাদের এক সময় সামর্থ্য হয় তারা পরে কোনো বস্তিতে বা খুব কম ভাড়ার বাসাবাড়িতে ওঠেন। কিন্তু সামর্থ্য যাদের হয় না তারা থাকার জন্য বেছে নেন রাস্তার পাশের যাত্রী ছাউনি, বাস ডিপো, লঞ্চঘাট ও রেলস্টেশনকে। এ ছাড়া ঢাকায় ভিক্ষুক ও ভবঘুরেসহ আরও কিছু ভাসমান মানুষ দেখতে পাওয়া যায়। তারা বাসটার্মিনাল, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে রাত কাটান। এ ধরনের কিছু মানুষের অন্যতম আশ্রয়স্থল ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন।
শুক্রবার (৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২)। শীতের রাতে সেদিন ঢাকায় বৃষ্টি হচ্ছিল। ঘড়ির কাটায় তখন রাত ৯টা ছাড়িয়েছে কিছু আগে। স্টেশনের ভেতর থেকে হেঁটে বেরিয়ে কিছু যাচ্ছেন যাত্রী। আবার কিছু যাত্রী ঢুকছেন স্টেশনে।
এমন সময়ে স্টেশনের সামনে খোলা জায়গায় চোখ রাখতেই দেখা গেল বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষকে। তারা আলাদা আলাদাভাবে জটলা করে বসে আছেন বিভিন্ন স্থানে। তাদের কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই। ট্রেনের যাত্রীরা স্টেশন ছেড়ে গেলেও তারা থেকে যান স্টেশনেই। কমলাপুর স্টেশনই যেন তাদের ঘর–বাড়ি।
আছিয়া বেগম
স্টেশনের প্লাটফর্মে প্রবেশের মুখেই এক স্থানে দুই নারীর সঙ্গে বসে ছিলেন আছিয়া বেগম (৭০)। গায়ে পুরোনো ও ধুলোমাখা সোয়েটার জড়ানো। তার ওপরে চাপিয়েছেন আরেকটি পুরাতন বিছানার চাদর।
কতদিন ধরে এখানে আছেন জানতে চাইলে আছিয়া বেগম বললেন, “বহুত বছর”। বহুত বছর ঠিক কত বছর জানতে চাইলে বললেন, “নয়-দশ বছর অইবো।”
আছিয়া বেগমের বাড়ি চাঁদপুরে। নদীতে বাড়িঘর ভাঙার পর থেকেই ঢাকায় চলে এসেছিলেন স্বামীহারা এই নারী। দুই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর তার জায়গা হয়েছে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন।
মর্জিনা খাতুন
আছিয়া বেগমের পাশেই বসেছিলেন মর্জিনা খাতুন (৫৬)। তার বাড়ি ময়মনসিংহে। ঢাকার এই কমলাপুর স্টেশনে বসবাস করছেন পাঁচ বছর ধরে। স্টেশনে কেন বসবাস করছেন জানতে চাইলে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি তিনি। শুধু বললেন, “অত কথা কইবার পারবাম না। এখানে অহন ভালা আছি।”
এখানে থেকে খাবার জোগান কী করে জানতে চাইলে বললেন, “আসা যাওয়ার পথে লোকজন যা দেয়, তাতেই অয়।”
কথা বলতে বলতে মর্জিনা খাতুন মাথায় চাদর জড়িয়ে নিলেন একবার।
শীতের কাপড়চোপড় কীভাবে জোগাড় করেছেন জানতে চাইলে জানালেন, শীতের শুরুতে কয়েকজন লোক এসেছিল রাতে। তারা তাদের কম্বল দিয়েছে।
এরপর পাশে রাখা কম্বল গায়ে জড়িয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন তিনি।
আবদুল গাফফার মিয়া
রেলস্টেশনের বাইরের দিকে পাবলিক টয়লেট। সেখানে রয়েছে গোসলের ব্যবস্থাও। তার সামনেই দেখা গেল আরও চার-পাঁচজন শুয়ে আছে নাক-মুখ ঢেকে। তাদের থেকে অল্প দূরে আলাদা হয়ে বসে থাকতে দেখা গেল আবদুল গাফফার মিয়াকে।
জিজ্ঞাসা করে জানা গেল তার বয়স ৬৭–৬৮। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলায়।
বাড়িঘর ছেড়ে কমলাপুর রেলস্টেশনকে ঠিকানা বানানো গাফফার মিয়ার গল্প অন্যরকম। তিনি জানালেন, তার কোনো সন্তান নেই। দীর্ঘ বৈবাহিক জীবনে সন্তান জন্ম দিতে না পারায় তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। প্রায় ১৩ বছর ধরে বাড়িঘর ছেড়ে কমলাপুর স্টেশনেই তিনি বসবাস করছেন।
শীতের রাতে একটি পাতলা কম্বল শরীরের নিচের দিকে জড়িয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। নিচে বিছিয়েছেন কুড়িয়ে আনা পত্রিকা ও পলিথিন।
স্টেশনে খাওয়া-দাওয়া ও গোসল করেন কোথায় জানতে চাইলে গাফফার মিয়া হাসিমুখে দেখালেন সামনের পাবলিক টয়লেট। আর খাবার খান স্টেশনের সামনের রেস্টুরেন্ট থেকে চেয়ে নিয়ে। এ ভাবেই দিন কেটে যায়। আবার মাঝেমাঝে স্টেশনে বিভিন্ন লোকজন ব্যক্তি উদ্যোগ বা কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে খাবারের প্যাকেট দিয়ে যায়। তাতেও দিনের খাবার হয়ে যায়।
বাড়িঘর ছেড়ে বৃদ্ধ বয়সে স্টেশনে কেন থাকছেন কষ্ট করে জানতে চাইলে বললেন, “অখন আর বাড়িত যাইতে চাই না। গিয়ে কী অইব। খালি হাঁপানির টান উঠলে যা কষ্ট অয়। আর কুনো সমস্যা নাই।”
আলমগীর
গাফফার মিয়ার সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম তখন দূর থেকে এক যুবক দাঁড়িয়ে তা লক্ষ্য করছিল। খালি পা। একটা ময়লা চিটচিটে ট্রাউজার পরনে। শরীরে একটা পুরাতন ওভারকোট, যেটির কোনো বোতাম নেই। বুক ও পেট বের হয়ে আছে।
কথা বলে জানা গেল তার নাম আলমগীর। বাড়ি মানিকগঞ্জে। বয়স ১৯। কমলাপুর স্টেশনে থাকছে গত দুই মাস।
বাড়িঘর ছেড়ে এখানে কেন থাকছে, জানতে চাইলে বলল, “ট্রেনে চড়তে ভালো লাগে। ট্রেনে উঠে দূরে যাওয়া যায়। একবার চিটাগং তিন দিন থাকলাম। আবার চলি আসলাম।”
কথা শেষ করে হাসতে হাসতে সামনে চলে গেল আলমগীর। পেছন ঘুরে হাঁটার সময়ে দেখা গেল হাতে মুঠো ধরে রাখা পলিথিন। স্টেশনের একটু পেছনের দিকে যেখানে আলো কম সেখানে আরও কয়েকটি অল্প বয়েসি ছেলে বসে ছিল। তাদের সঙ্গে বসে পলিথিনে নাক ডুবিয়ে রইল।
কমলাপুর রেলস্টেশনের তথ্য ও অনুসন্ধান কক্ষে দায়িত্বরত একজনের কাছে জানতে চাইলাম, এখানে ভাসমান মানুষের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে কোনো তথ্য আছে কিনা? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মরত লোকটি জানালেন, করোনা মহামারীর প্রভাবে লকডাউন শুরু হলে স্টেশনের ভাসমান মানুষদের এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আগের চেয়ে তুলনামূলক ভাসমান লোকেরা কম থাকে।
মুন্নী
কমলাপুর রেলস্টেশনের উল্টোপাশে মতিঝিল যাওয়ার সড়কের দিকে বিআরটিসি বাস কাউন্টারের পাশে দেখা গেল একটি পরিবার। এগারো বছরের ছেলেকে নিয়ে রাতে ঘুমানোর জন্য বিছানা প্রস্তুত করছেন পলিথিন ও ছালার চট দিয়ে। মুন্নী (৩৫) জানালেন স্টেশন এলাকায় তিনি থাকেন প্রায় কুড়ি বছর ধরে। এখানেই তার বিয়ে হয়েছে। তিন সন্তানের মা হয়েছেন। তার স্বামী সিটি কর্পোরশেনের চুক্তিভিত্তিক সুইপারের কাজ করেন। নিজে কমলাপুর এলাকার হোটেলে থালা-বাসন ধোয়ার কাজ করেন। করোনার আগে বস্তিতে থাকতেন বাসা ভাড়া করে। কিন্তু লকডাউনের পরে হোটেল দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের আয়ও কমে যায়, তাই বস্তির বাসা ছেড়ে ফুটপাতেই সংসার নিয়ে বসেছেন।
ঢাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা ৭ হাজারের বেশি
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী ঢাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা ৭ হাজারের বেশি। তবে সরকারের এই তথ্য হালনাগাদ নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৪ সালের পর কোনো নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দিন বলেছেন, “সিটি কর্পোরেশনে ওয়ার্ডভিত্তিক অতি-দরিদ্র, বস্তিবাসী ও দুস্থদের জন্য তাদের কর্মসূচি রয়েছে। তবে ভাসমান মানুষের জন্য কোনো বিশেষ কর্মসূচি নেই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, “আমাদের দেশের এত সংখ্যক ভাসমান মানুষের প্রধান কারণ হচ্ছে আয় বৈষম্য। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে সত্যি, কিন্তু সে তুলনায় আয়ের বৈষম্য কমেনি। এ ছাড়া সবকিছুর কেন্দ্র যেহেতু ঢাকা, তাই ঢাকামুখী মানুষের একটি স্রোত সবসময়ই দেখা যায়। নদীভাঙন, আত্মীয়স্বজন না থাকা থেকে শুরু করে নানা কারণে মানুষ রাজধানীমুখী হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখন সরকার অবশ্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এসবের সুফল পেতে হলে আরও সময় লাগবে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোন তৈরি হচ্ছে। এগুলো তৈরি হওয়ার পর কর্মসংস্থান করা গেলে ঢাকায় মানুষের চাপ কমবে। তবে সবচেয়ে যেটিতে বেশি নজর রাখতে হবে, আয় বৈষম্য কমানো গেলে ভাসমান মানুষ আর দেখতে হবে না।”